ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এলডিসি: সুবিধা বঞ্চিত নয়, ভাবতে হবে অর্জন নিয়ে   

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ১ মার্চ ২০২১  
এলডিসি: সুবিধা বঞ্চিত নয়, ভাবতে হবে অর্জন নিয়ে   

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে এসে ঐতিহাসিক গর্বের অর্জন হলো আমাদের। বাংলাদেশ পা রাখতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। সবকিছু ঠিক থাকলে মাত্র পাঁচ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে। প্রতিটি অর্জনের যেমন খুশির সংবাদ থাকে, থাকে চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের পরবর্তী পাঁচ বছরের চ্যালেঞ্জ হলো- এই উত্তরণ প্রক্রিয়া মসৃণ, বাধাবিঘ্নহীন এবং পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলা করা।

এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে এবং গত দুদিন ধরে যে বিষয়টি বেশি আলোচনায় এসেছে, তা হলো এলডিসি থেকে বের হলে কিছু সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। কিন্তু আমাদের সামনে যে অফার সম্ভাবনার দ্বার খুলতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এসব আমাদের আসলে খুব বেশি দরকারও নেই। একবার ভাবুন, ক’দিন পরেই বাংলাদেশের দিকে বিশ্ব তাকাবে নতুন দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে করুণার ছিটেফোঁটাও থাকবে না।

বলা হচ্ছে, স্বীকৃতি মিললে রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় পাওয়া শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ২০২৬ সালে বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সেই চাপ মোকাবিলার সক্ষমতা উদ্যোক্তাদের এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। আগামীতে এ সক্ষমতা আরও বাড়বে। খুব দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়, কয়েক বছর পর আমরা আর জিএসপি নিয়ে ভাববোই না। এলডিসি থেকে বের হলে ইউরোপিয় ইউনিয়নের জিএসপির পরিবর্তে জিএসপি প্লাস কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) এবং আঞ্চলিক জোটগুলোয় (আরটিএ) বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সুযোগ হবে।

আমাদের এখন ভাবতে হবে রাজস্ব এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ নিয়ে। এগুলোই একটি দেশের উন্নয়নের অক্সিজেন। আলোচনা হচ্ছে আরও তিনটি বিষয় নিয়ে।
১. ‘বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠবে উন্নয়নশীল দেশে পা রাখার পর।’ আমরা সবাই জানি, আমাদের সুষম রিজার্ভের ইতিহাসের পেছনে রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ঢল। বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানোর বিষয়ে উৎসাহিত করতে সরকার যে নগদ সহায়তা দিয়ে আসছে পরবর্তী যে কোনো একটি বাজেটে এটি প্রত্যাহার করে নিতে হতে পারে সরকারকে।

২. ‘ভর্তুকি’। এলডিসি হিসেবে যে কোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে। এখনো কৃষক বাজারব্যবস্থার আধুনিকীকরণের অভাবে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  আরও বিভিন্ন কারণে অন্তত আরও দশটি বছর সরকারকে কৃষিখাতে ভর্তুকি দিয়ে আসতে হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল বাংলাদেশে সেই সুযোগ থাকতে পারে বড়জোর ২০২৭ সাল পর্যন্ত।

৩. ‘বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প।’ এরই মধ্যে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না। এর কারণ, মেধাস্বত্বের ওপর অর্থ দেওয়া হলে ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা বেশি পেয়েছে।  কিন্তু এটি বন্ধ হয়ে যাবে।

তবে এটি বলাই যায়, এসব চ্যালেঞ্জ সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। সে পথে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ভালো করে আসছে। এখন প্রয়োজন কিছু বিষয়ে সমন্বয় করে নেওয়া।  একটা উদাহরণ দেওয়া যাক:

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগ হিসাবে কাজ করে। আইন, নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে মন্ত্রিসভা ও মন্ত্রিসভা কমিটিকে সহায়তা প্রদান, গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ এবং মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম পরিবীক্ষণের মাধ্যমে সুশাসন সংহতকরণ ও সোনার বাংলা বিনির্মাণ হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অভীষ্ট লক্ষ্য। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটি সরাসরি সরকারের কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নয়। ফলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হাতে গোনা দুয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত নয়। পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশনের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম সহজীকরণের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেতৃত্বে প্রতিটি মন্ত্রণালয় বিভাগ অধিদপ্তর বা দপ্তর ও তার অধীন কার্যালয়ে যে ইনোভেশন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে, সময় এসেছে তা গতিশীল করার।

একটি বিষয় পরিষ্কর করার দরকার বোধ করছি। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রভাব হিসেবে অনেকেই বলছেন যে, সামনের দিনে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাম্প্রতিক একটি ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে- গবেষণায় দেখা গেছে ‘বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা যথা বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, এডিবি প্রভৃতি কর্তৃক তাদের উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে দেশটি এলডিসি কিনা সে বিষয়টি কোনো গুরুত্ব বহন করে না। বরং দেশটির চাহিদা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বিবেচনাই বেশি প্রভাবিত করে।’

অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বেগের খুব বেশি কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। বরং অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। বেশি ঋণ নিতে পারলে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি খরচ করতে পারবে বাংলাদেশ। আবার অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মোকাবিলায় যথেষ্ট সক্ষমতা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে।

বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি পর্যায়ে রয়েছে। এলডিসি থেকে বের হলে গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। এর মাধ্যমে মানব উন্নয়নের অগ্রগতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হবে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে সনাতনী চেতনার পরিবর্তন ঘটবে। এটি বিশ্বায়নের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপদ ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।

উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো উৎসাহী হবেন। একটি দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়। সর্বোপরি, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, সঠিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ও নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানিখাতের নিশ্চয়তা পেলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারবে। 

সার্বিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে বাস্তবধর্মী ও সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণের বিকল্প নেই। বিশেষ করে শিল্প ও সমষ্টিক অর্থনৈতিক খাতে যথাযথ কৌশল গ্রহণ করতে হবে যাতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব। এতে রপ্তানী পণ্যের বহুমুখীনতা সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ২০২৪ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দক্ষ, জবাবদিহিতামূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়তে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।  (২০২৪ সাল নতুন সরকারের গঠনের বছর)। সে লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হচ্ছে, এসডিজি বাস্তবায়নের কৌশল পুনঃর্বিবেচিত হচ্ছে, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা হচ্ছে- এগুলোর সমন্বয় এই মুহূর্তে জরুরি। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়