ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সত্য প্রকাশে সাহসী মকসুদ ভাই

হাসান তারিক চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৭:১৩, ২ মার্চ ২০২১
সত্য প্রকাশে সাহসী মকসুদ ভাই

সৈয়দ আবুল মকসুদ (১৯৪৬-২০২১)

সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাই এভাবে চলে যাবেন- চিন্তাও করতে পারিনি! তাঁর বয়স ৭৪ হয়েছিল সত্যিই; কিন্তু তিনি ছিলেন বয়সের উর্ধ্বে ওঠা এক মানুষ। স্বাস্থ্যবিধি মানতেন। মিতাহারী ছিলেন। নানা কু-অভ্যাস এবং খাইখাই স্বভাব তাঁর ছিল না। ফলে আমার ধারণা ছিল, তিনি অন্তত একশ বছর দাপটের সঙ্গে বেঁচে থাকবেন।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। লেখালেখির সূত্রে পরিচয়। সে পরিচয়ের হাত ধরে নানাবিধ নাগরিক আন্দোলন এবং সামাজিক আন্দোলনে একসঙ্গে মিছিলে হাঁটা। মানববন্ধনে পাশাপাশি দাঁড়ানো। তাঁর তেজী কিন্তু সুস্থির সান্নিধ্যে নিজেকে ঋদ্ধ করা। মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নিজের অজান্তেই এক দারুণ ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছে গিয়েছিল। যে ঘনিষ্ঠতার দাবিতে আমি তাঁর মতো একজন জ্যেষ্ঠ মানুষকে সামনাসামনি সমালোচনা করতে পারতাম। আমার মতো একজন অখ্যাত লোককে দেশে-বিদেশে যে কয়েকজন প্রবীণ সীমাহীন আশকারা দিয়েছেন- মকসুদ ভাই তাঁদের অন্যতম। মনের বিশালত্ব না থাকলে সাধারণত কোনো অগ্রজ তাঁর অনুজকে এই অধিকার দেন না। লেখক, সাংবাদিক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন সে রকমই এক বিশাল মনের মানুষ।

যাদের বয়স এখন ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। সেইসব টগবগে তরুণদের কাছে সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন এক বিরাট কৌতূহলের বিষয়। শিশুকাল থেকেই তাদের জিজ্ঞাসা এই মানুষটি কেন দুই থান সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরেন? লোকটি অন্যসব মানুষের থেকে একটু আলাদা কেন? এভাবেই নিজের জীবনযাত্রার মধ্য দিয়েই মকসুদ ভাই তরুণ সমাজের কাছে এক বিরাট প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থেই এক বিরাট প্রশ্ন! প্রচলিত জরাজীর্ণ প্রথা ভাঙার প্রশ্ন।

সবাই জানে, ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ব্রিটিশ-আমেরিকান যুদ্ধবাজ সরকার ইরাকে এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন বাসনা চরিতার্থ করা। মকসুদ ভাই সেদিন থেকেই মানবতা-বিরোধী অপরাধের প্রতিবাদে দুই থান সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান শুরু করেন। অবিভক্ত ভারতের ব্রিটিশ কলোনি-বিরোধী লড়াইয়ের কালে মহাত্মা গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ সম্পর্কে যাঁদের কিছুটা ধারণা ছিল তাঁরা হয়তো শুরুতেই বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন। যারা সেটি জানতেন না, তারা অনেকেই ব্যাপারটিকে বাড়াবাড়ি বিবেচনা করছেন। কেউ কেউ উপহাসও করেছেন। কিন্তু মকসুদ ভাই এতে বিচলিত হননি। তিনি নিজের বিশ্বাস এবং আচরণে অবিচল ছিলেন। পশ্চিমা যুদ্ধবাজ চক্রের এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শান্তির স্বপক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন; লেখনিতে এবং জবানীতে।

আমি মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিতাম। বলতাম, আপনি একা সাদা কাপড় পরছেন। একই ইস্যুতে আর দ্বিতীয় কাউকে তো সাদা কাপড় পরিয়ে সত্যাগ্রহ করাতে পারলেন না! শুনে তিনি মৃদু হাসতেন। একদিন বলেছিলেন, এটা আমার তরিকা। অন্যরা যার যার মতো তাঁদের নিজেদের মতো করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে। আমি তো আমার তরিকা কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারি না। রেশমি, মোলায়েম এবং আরামপ্রিয় বুদ্ধিজীবীদের যখন কোনো প্রতিবাদী মিছিলে দেখা যায় না, তখন মকসুদ ভাইকে প্রায় সব প্রতিবাদী মিছিলেই সাথী হিসেবে পেয়েছি। তপ্ত দুপুরে এবং কনকনে শীতে। ঢাকার রাজপথে এবং গ্রামের মাটির রাস্তায়। কখনো ভুমিদস্যুদের কবল থেকে নদী, জলাশয়, খেলার মাঠ বাঁচাতে, আবার কখনো রাষ্ট্রীয় হামলা থেকে জীবন ও মুক্ত জবানকে বাঁচাতে।

মকসুদ ভাই নিভৃতে চলতে পছন্দ করতেন। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা তাঁর মধ্যে দেখা যায় নি। আমার ধারণা, তাঁর এই নিভৃতে চলাফেরার বড় কারণ ছিল পক্ষপাতহীন এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে ঘটনা প্রবাহ এবং সমাজ জীবনকে দেখতে চাওয়া। যেটি তাঁর নানা লেখায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যারা মকসুদ ভাইয়ের কলামগুলো নিয়মিত পড়েছেন, তাঁরা বেশ ভালো করেই জানেন তিনি কি পরিমান সত্যানুসন্ধানী এবং ইতিহাস আশ্রয়ী ছিলেন। সম্ভবত তাঁর এই সত্যানুসন্ধানী মন তাঁকে এ যুগের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ঠেলে দিয়েছিল। এ রকম নীতিনিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি ছিলেন আপসহীন। বাসসের চাকরি খুইয়েছেন নীতিনিষ্ঠার কারণে। হয়তো মাথা নত করলে, তাঁর চাকরিটা টিকে যেত। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি। শাসকের কাছে অপ্রিয় কিন্তু জনতার জন্য জরুরি বিষয় তিনি নিজের লেখায় টেনে আনতেন। এই তো আমাদের সাদামাটা মকসুদ ভাই।

ভিনসেন্ট সিয়েন তাঁর 'Lead, Kindly Light' গ্রন্থে লিখেছেন সত্যাগ্রহ হলো গান্ধীর চূড়ান্ত আবিষ্কার বা সৃষ্টি। তাঁর মতে, গান্ধী তথাকথিত শান্তিবাদী ছিলেন না, সম্মুখ যুদ্ধের পক্ষপাতী না হলেও তার কাছে যুদ্ধের বিকল্প যে ক্ষুরধার তরবারি ছিল, তা নৈতিক বিকল্প যা সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত। বাস্তবিক অর্থেই মকসুদ ভাই বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনে দায়িত্বহীনতার বিপরীতে এক নৈতিক বিকল্পের ধারা তৈরি করেছিলেন। বাগাড়ম্বর দিয়ে নয়। বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে। গান্ধী বলতেন, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মূল কথা হলো, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নৈতিক শক্তির উপর পূর্ণ আস্থা। মকসুদ ভাই তাঁর ৭৪ বছরের কর্ম জীবনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন নৈতিক শক্তির উপর আস্থার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো কমতি ছিল না। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যে ঘাটতি আজ বিরাট সংকটের জন্ম দিয়েছে।

আজ অনেক ক্ষেত্রেই সংযমের বেশ প্রয়োজনিয়তা প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। কি খাদ্যাভ্যাসে, কি আচরণে। এ প্রসঙ্গে মকসুদ ভাই চির স্মরণীয় হয়ে রইবেন তাঁর সংযমী বৈশিষ্ট্যের জন্যই। যারা মকসুদ ভাইকে বিভিন্ন সভা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখেছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। বছর দশেক আগে, একবার কলকাতার এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে বসেছি। দেখি পাশের টেবিলে বসে আগেই খাচ্ছিলেন মকসুদ ভাই। আমাকে দেখে বললেন, খাওয়া শেষ করে চলো একসঙ্গে কিছুক্ষণ হাঁটি এবং কথা বলি। আমি সানন্দে রাজি হলাম। বের হবার মুহূর্তে বিল দিতে গিয়ে আমি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। খুবই সাধারণ আহার করে আমার খাবারের বিল হয়েছিল ১৪০ রুপি, আর মকসুদ ভাই তাঁর বিল দিলেন মাত্র ২৫ রুপি। এই ছিল তাঁর সাদাসিধে জীবন। কথায় কথায় বললেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব গান্ধীজীর উপর গবেষণার কাজে। এভাবে কাজকে প্রধান এবং আহারকে প্রায় গৌণ রেখেই পথ চলেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। পেশাজীবী ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা         
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়