ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এলডিসি থেকে উত্তরণ: বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ৩ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:৪১, ৩ মার্চ ২০২১
এলডিসি থেকে উত্তরণ: বদলে যাওয়া বাংলাদেশ

রূপকল্প-২০২১ এর আলোকে ‘মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন আমাদের অর্থনীতির পথচলায় সত্যিকার অর্থেই এক মাইলফলক। একথা অনস্বীকার্য, সরকার অত্যন্ত সফলভাবে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মধ্যম-আয়ে উন্নীত হবার বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কতটুকু অর্জন হয়েছে সেটি ভিন্ন বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলেও দেশের মানুষ আজ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে, আমরা এ রকম একটি অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারব। অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য এ বিশ্বাস তাৎপর্য বহন করে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ আলাদাভাবে পৃথিবীর দেশগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এবং একইসঙ্গে জাতিসংঘের বিবেচনায় স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে।

জাতিসংঘ তিনটি সূচকের (মাথাপিছু জিএনআই, মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক) উপর ভিত্তি করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের হিসাব করে। সরকার ঘোষিত রূপকল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে বাংলাদেশকে মধ্যম সারির দেশে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালে ‘উন্নত দেশে’ উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে মধ্যম সারির দেশ ধারণায় বিশ্বব্যাংক প্রণীত ‘মধ্যম আয়ের দেশের’ সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার মূলত জাতিসংঘের ধারণাকে প্রতিফলিত করে এবং আমরা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাসের দ্বিতীয় অর্থাৎ মধ্যম ধাপে উন্নীত হয়েছি যা আমাদের রূপকল্প-২০২১ এর সফল বাস্তবায়নেরই প্রতিচ্ছবি। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতা এবং বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতায় আমরা রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের দূরদর্শিতার প্রশংসা করতে চাই। ২০৪১ সালে ‘উন্নত দেশ’ হবার পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের ‘২০২১-২০৪১ মেয়াদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়’ বিশ্বব্যাংকের যে শ্রেনিবিন্যাস রয়েছে তার প্রতিফলন ঘটেছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০৩১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেনিবিন্যাস অনুসারে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উচ্চ-আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। ২০১৮ সালে আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের ম্যারাথন উন্নয়ন যাত্রায় প্রথম মাইলফলক। এটি আসলেই একটি বড় সাফল্য। কারণ বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের আয়-ভিত্তিক দেশগুলোর তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করলে জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাসটি অনেক ব্যাপক ও নিবিড় বলে ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আগামীর বাংলাদেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে আলোচনাই এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য।

দুভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ অর্জন করা যায়। প্রথমত, যে কোনো দুটি শর্ত প্রতিপালন করলে। দ্বিতীয়ত, শুধু মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হলে অর্থাৎ ১২৩০ মার্কিন ডলারের দ্বিগুণ ২৪৬০ মার্কিন ডলার হলে। বর্তমান সরকারের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হবার সব শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবার জন্য প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হয়েছিলাম। সে সময়কার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১২৭৪ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচকের মান ৭৩.২ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান ২৫.২ ছিল। সাধারণত উত্তরণের বিষয়টি প্রতি তিন বছর পরপর জাতিসংঘের ‘Committee for Development Policy (CDP)’ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে।  সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, ২০২১ সাল পর্যন্ত এ অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে অনুমোদন পেতে হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ বিবেচনায় প্রস্তুতি নিতে বাড়তি দু’বছর সময় দেওয়া হয়েছে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন প্রস্তুতি হিসেবে তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর সময় পাওয়া গিয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমাদের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে। ২০২০ সাল শেষে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় (জিএনআই) ১৮২৭ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচকের মান ৭৫.৩ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান ২৭.৩।

উত্তরণের সুফল আলোচনা করলে অনেকগুলো বিষয় উঠে আসে। দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এ অর্জন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং বিশ্ব অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে যা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যা উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো তৈরির পথ সুগম করবে। এতে শিল্পের আধুনিকায়নের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে এবং উদ্যোক্তা ও শ্রমিক উভয়ের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে ডব্লিউটিওর কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়া যাবে না। যেমন, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, নানা রকম ছাড়, দীর্ঘ বাস্তবায়ন কাল ইত্যাদি। এ ছাড়া WTO এর এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বাণিজ্য সহজীকরণের জন্য অনুদান পাবে না। মোটাদাগে, স্বল্পোন্নত দেশগুলো চার ধরণের সুবিধা প্রাপ্ত হয়। প্রথমত: GSP (Everything but arms) ও ডিউটি-ফ্রি কোটা-ফ্রি (DFQF) সুবিধা। দ্বিতীয়ত: বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বিভিন্ন Special and Differential Treatment. তৃতীয়ত: আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ODA) এবং অন্যান্য উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং সর্বোপরী, জাতিসংঘে এসব দেশের অনুদান অনেক কম দিতে হয়।

উত্তরণের সরাসরি প্রভাব মূলত রপ্তানি বাণিজ্যে পড়বে যা বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্যে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিতে পারে। কারণ আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ইইউ বর্তমানে বাংলাদেশের ৯৭.৮ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজকের এ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। তাই এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে রপ্তানি খাত সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে আমাদের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এলডিসি হওয়ায় বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব নিয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ইউরোপের বাজারে ২১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে যার মধ্যে ১৯.৬ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে ১২ শতাংশ অগ্রাধিকার ট্যারিফ ও রুলস্ অব অরিজিনের এর ক্ষেত্রে একস্তর রূপান্তর (One Stage Transformation) সুবিধা দিয়ে থাকে।

উত্তরণের পর বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৬.৭ শতাংশ ট্যারিফ দিতে হবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে বিবেচনা করলে গবেষণার ফল থেকে দেখা যায় রপ্তানি আয় ৫.৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ (২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পর্যন্ত কমে যেতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এ বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত কমতে পারে। এছাড়া, রপ্তানিযোগ্য পণ্যে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়েও নতুন শর্ত আরোপ সাপেক্ষে রপ্তানি ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও একিভূতকরণের জন্য EIF (Enhance Integrated Framework) এর আওতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত সহায়তা কমে যেতে পারে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ আরও বলছে, এ সব সুবিধাদি বিবেচনায় সার্বিকভাবে রপ্তানির ক্ষতি ৫ শতাংশ ধরে হিসাব করলে ২০২৭ সালে তা ৭ বিলিয়ন পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

উত্তরণের পর উন্নত দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। আমাদের অর্থনীতিতে এ আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার অবদান এখন মাত্র জিডিপির এক শতাংশ হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে এর ভূমিকা রয়েছে। ২০১২-১৫ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ODA (Official Development Assistant) বরাদ্দের মধ্যে বাংলাদেশ একাই পেয়েছে মোট বরাদ্দের ৭ শতাংশ।

এছাড়া, দাতা দেশগুলোর মোট জাতীয় আয়ের ০.১৫-০.২০ শতাংশ হতে প্রদত্ত এলডিসি হিসেবে সহজ শর্তে প্রাপ্ত ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যাবে না; তখন তুলনামূলক বেশি সুদে ও কঠিন শর্তে ঋণ নিতে হবে। ঋণের বিপরীতে উচ্চহারের সুদ দিতে হবে বিধায় যে কোনো বিদেশি ঋণের প্রকল্পে খরচ বেড়ে যেতে পারে যা আর্থিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। উপরন্তু, TRIPS (Trade Related Intellectual Property Rights) এর আওতায় কৃষি বহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে পেটেন্ট এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। TRIPS চুক্তির অনুচ্ছেদ ৭০.৮ ও ৭০.৯ এর আওতায় প্যাটেন্ট সংক্রান্ত বিধানের ক্ষেত্রে ১ জানুয়ারি ২০৩৩ সালের পর ঔষধ প্রস্তুতকরণে অব্যাহতিপ্রাপ্ত দেশের তালিকা থেকে আমাদের বের হয়ে যেতে হবে। এছাড়া, TRIPS  চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬৬.২ অনুসারে উন্নত দেশ কর্তৃক তাদের প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের এলডিসিতে প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য বিভিন্ন সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে থাকে যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হতে পারে।

এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রত্যেক সদস্য দেশকে তার জাতীয় আয়ের ০.০১ শতাংশ চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশকে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান। ২০২৬ সালের পর এ ধরনের টিকিট পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয় যা হয়তো আর পাওয়া যাবে না। এছাড়া, বিশেষ বিবেচনায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলোতে সরকার কর্তৃক নগদ আর্থিক সহায়তা ও ভর্তুকি দেবার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ শিল্প ও কৃষিখাতের বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এ ধরনের ভর্তুকি দিয়ে থাকে যা উত্তরণের কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অধিকন্তু, UNFCC (United Nations Framework on Climate Change) কর্তৃক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য প্রবর্তিত এলডিসির ফান্ড হতে সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এ মুহূর্তে করণীয় কী? জিএসপি প্লাস নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাবে। মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া, বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দ্বিপাক্ষিক নতুন চুক্তির দিকে অধিক মনোযোগ দেয়া যেতে পারে।

এলডিসি থেকে চূড়ান্তভাবে বের হবার জন্য বাংলাদেশ পাঁচ বছর ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সুবিধা ভোগ করার জন্য ছয় বছর সময় পাবে। যেহেতু করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অতিরিক্ত দুবছর বাড়ানো হয়েছে তাই স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সুবিধা ভোগের সময়ও বৃদ্ধি পেতে পারে, যা হয়তো ২০২৯ পর্যন্ত বাড়ানো হবে। তবে সে হিসাবে এগুলে চলবে না। এ যুগান্তকারী অর্জন আমাদের সম্মানের পাশাপাশি দায়িত্বও বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী বছরগুলোতে প্রতিযোগিতা নির্ভরতার জন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আশা করা হচ্ছে, দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের মানোন্নয়ন হওয়ায় বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়বে। এ সময়ে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসবে বলেই আমার ধারণা। সর্বোপরি, এ মর্যাদা আমারা যোগ্যতার ভিত্তিতে অর্জন করেছি, এটি কারও করুণা নয়। বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলো যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে করে, এ উত্তরনের ফলে আমরা হয়তো তার কিছু কিছু হারাবো। কিন্তু আমাদের এখন এগিয়ে যাবার সময়, যাতে সাহায্যের বদলে পদ্মা সেতুর মতো নিজেরাই সবকিছু করতে পারি। এজন্য খুব বিশদভাবে একটি গবেষণা হওয়া খুবই জরুরি। আমাদের প্রকৃত লাভ-ক্ষতির সমীকরণ বের করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হবার রোডম্যাপ এখনই তৈরি করতে হবে। সে বাস্তবতায় গবেষকদের অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী। এর নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চের ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সমষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর কোনো নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বিগত সময়ে ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঈর্ষনীয় রিজার্ভ আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতিকে নির্দেশ করে। ইতিহাস বলছে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর ধারণা করা হয়েছিল আমাদের রপ্তানি কমবে। কিন্তু রপ্তানিতে সেরকম কোনো সমস্যা হয়নি। জনমিতিক মুনাফা ও আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার কারণে আমাদের সমষ্টিক অর্থনীতিতে সার্বিক চাহিদার কোনো ঘাটতি নেই যা আমাদের আশাবাদী করে তোলে।

প্রসঙ্গত, উন্নত দেশসমূহ জাতিসংঘের নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে প্রতিপালন করে না। উন্নত দেশগুলোর তাদের মোট জাতীয় আয়ের ০.১৫-০.২০ শতাংশ হতে এলডিসিকে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও তা প্রদান করে না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী মোট সহায়তার মাত্র ৩ শতাংশ পেয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেটে বৈদেশিক সহায়তার অবদান ১৫ শতাংশের নিচে। ফলশ্রুতিতে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, এলডিসিভুক্ত প্রথম দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার নিজস্ব অর্থায়নে ইতোমধ্যে ‘জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত আমাদের আইনও কার্যকর হয়েছে।

বলতে দ্বিধা নেই, সব সম্ভাবনাই একেকটি চ্যালেঞ্জ। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ হতে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ পর্বে আমরা যেন ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’-এ না পড়ি। পরিসংখ্যান বলছে, নিম্ন মধ্যম-আয়ের দেশ হতে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশে উন্নীত হবার অনেক উদাহরণ থাকলেও পৃথিবীর অনেক দেশ উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ হতে উচ্চ আয়ের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। একে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এ ধরনের ফাঁদের মধ্যে রয়েছে। যে কয়টি দেশ সফলভাবে এ ফাঁদকে জয় করেছে সেগুলো হল সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৮৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি দেশ উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের ধাপে উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে সমাধানের পথ একটাই, সম্পদ সৃষ্টির জন্য প্রযুক্তি ও প্রকৃত উদ্ভাবন (innovation) কে অধিক গুরুত্ব দেয়া যা উচ্চতর গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়ানো ছাড়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, আমরা এখন যে জনমিতিক মুনাফা উপভোগ করছি অর্থাৎ, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি কর্মক্ষম জনসংখ্যার বিদ্যমান আধিক্য (৬৬%) তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনকে টেকসই ও গতিশীল করতে এ পর্যায়ে তারুণ্যে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। ২০৩০ সালে এ জনিমিতিক মুনাফা সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে এবং পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে ফলে অর্থনীতিতে তখন কর্মহীন লোকের সংখ্যা বেশি হবে।

স্বাধীনতার সুফল সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে পোঁছে দিয়ে তাকে ফলপ্রসূ করতে আমাদের আসলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন ঘিরে সরকারের ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ এর আলোকে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য যা বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ এমন এক সময়ে এ সুপারিশ পেল যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছি। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় বলতে চাই, ‘এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।’

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ