ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রস্তুতি নিয়ে খুলতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ১১ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:৫৪, ১১ মার্চ ২০২১
প্রস্তুতি নিয়ে খুলতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

আমাদের প্রচলিত হিসাবে ৩৬৫দিন ৬ ঘণ্টায় এক বছর হয়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ৩০ মার্চ খুলে দেয়, তাহলে ৩৭৭ দিন পর অর্থাৎ এক বছরেরও বেশি সময় পরে সেগুলো খুলবে।

বিগত বছরগুলোতে একটি সাধারণ রুটিন ছিল যে, ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি এবং ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ফল প্রকাশের পর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রস্তুতি নেবে শিক্ষার্থীরা। সব কিছুতেই করোনার কারণে ছেদ পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। টানা বন্ধে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে অন্তত দেড় বছরের সেশনজট। পরীক্ষাজটও লেগেছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। সবকিছুই এলোমেলো করে দিয়েছে করোনা।

এ কারণে ২০২১ সালের শিক্ষাবর্ষে  এসএসসি ও এইচএসসির সিলেবাস কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে সরকার। করোনায় বাতিল করতে হয়েছে সর্বশেষ এইচএসসি, প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। ২০২০ সালের বার্ষিক পরীক্ষাগুলোও বাতিল করতে হয়েছে। ফলে ঘরবন্দি শিশুরা গত বছরের পাঠ্যসূচির বহু কিছু রপ্ত করতে পারেনি। চলতি শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সেসব পুষিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এই ভয়াবহ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে গাইডলাইন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে ডজনখানেক প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয়। ৩০ মার্চের আগেই শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাই শিক্ষা বিভাগের জন্য ১২ লাখ টিকা রিজার্ভ করা হয়েছে যেটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য, সিলেবাস ইত্যদি বিষয়েও সরকারের নানা সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলার পর চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাঠগ্রহণ শুরু করবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস শুরু করার প্রস্তুতিও চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের মুখেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ নতুন করে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ করা হয়েছে, রাখা হয়েছে ফাস্ট এইড বক্স। এক লাখ শিক্ষককে সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্টের ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উদ্যোগ।

বিদ্যালয়ে এসে ঘরবন্দি থাকা শিশুর কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারবেন তারা। এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতদিন বন্ধ থাকা বিদ্যালয়ের পানির ট্যাংকগুলোতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবণু। সঠিকভাবে পরিষ্কার না করে এই পানি পান করলে শিশুরা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হবে। পানির পাইপের ভেতরে জমে থাক ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্লিচিং পাউডারসহ অন্যান্য জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। এ সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। বিদ্যালয়ের রুমে জমে থাকা ধুলো-ময়লা থেকে সর্দি বা এলার্জি জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এখানেও ভালোভাবে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দিতে হবে। বিদ্যালয়ের টয়লেটগুলো জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পুরাতন ইলেকট্রিক পয়েন্ট, সুইচ, তারগুলো হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক। ফ্যান, লাইট এগুলো ভালোভাবে চেক করতে হবে। যেসব বিদ্যালয়ে অগ্নি নির্বাপনের সিলিন্ডার আছে সেগুলোও ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতিস্বরূপ ধোয়া, মোছার কাজ চলছে, সেইসঙ্গে এই বিষয়গুলোর প্রতিও জোর দিতে হবে।

গত বছরের মে মাস থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা এবং জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকা, দুর্বল ও ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তির উচ্চমূল্যের কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষেই অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ব্যাচের ভর্তিও পিছিয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অন্তত ৫০০ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে ২৪ মে। ১৭ মে হল খোলা হবে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আবাসিক হলগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের চলতি ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০টি আবাসিক হল রয়েছে। সেগুলোতে প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী থাকেন। এটিও সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলতে হবে।

করোনায় শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য এখন সুস্পষ্ট। শহুরে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে। এমনকি পরীক্ষাও দিচ্ছে। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা স্কুল কলেজের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন বা সরাসরি প্রাইভেট পড়ছে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। মফস্বলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের টেলিভিশন, স্মার্টফোন বা অনলাইন ক্লাসের জন্য অন্য কোনো ডিভাইস নেই। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন করে বৈষম্য দেখা দিয়েছে।

এত কিছুর মধ্যে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। বিভিন্ন দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘প্যান্ডেমিক ক্লাসরুম’ উদ্বোধন করেছে ইউনিসেফ। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য বলছে পুরোপুরি ও আংশিকভাবে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী ৮ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশুর পড়াশোনা অব্যাহতভাবে বাধার মুখে পড়েছে। প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন ব্যক্তিগত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ হারিয়েছে। বাংলাদেশের স্কুল খোলার ঘোষণাকে ইউনিসেফ স্বাগত জানিয়েছে। আমরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কামিটিগুলোকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই খুলতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়