ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স্বাধীন দেশেও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল মুক্তির জন্য

জাফর ওয়াজেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ২০ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৭:০৬, ২০ মার্চ ২০২১
স্বাধীন দেশেও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল মুক্তির জন্য

বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির। সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল বাঙালী। বীরের মতো লড়াই করে স্বাধীন ভূ-খণ্ড অর্জন করেছে তারা। বিশ্ব মানচিত্রে সার্বভৌম দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুক্তির পথ তিনি দেখিয়েছেন, কিন্তু সেই পথ পরিক্রমকালে ঘাতকের কালো হাত কেড়ে নেয় তাঁর জীবন।

যে বজ্রকণ্ঠ কোটি কোটি বাঙালীকে উদ্দীপ্ত করেছিল, আন্দোলিত করেছিল, সেই মহামানবকে আততায়ীরা হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, সপরিবারে। স্বাধীনতা পরবর্তী মুক্তি সংগ্রামের চাকা অচল করে দেওয়ার জন্য ঘাতকরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সমাজে, বাঙালীর মনে এবং ইতিহাসে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দাপট পরিলক্ষিত হয় তাঁর হত্যাযজ্ঞের পর। কিন্তু অজস্র দুর্গতিতেও বাঙালী স্বাধীনতাকে আঁকড়ে থাকে। এটা বাস্তবিক যে- স্বাধীনতার অভিশাপও স্বীকার্য, অধীনতার আতঙ্ক অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সমাজ গঠনে, বাংলাদেশের ইতিহাসে, বাংলাদেশের মনে এমন বিশেষ দুর্লঙ্ঘ বাধা রয়েছে, যার ফলে যে স্বাধীনতাবোধ জেগে উঠেছিল, সেই স্বাধীনতা মরীচিকায় পরিণত হলো পঁচাত্তর পরবর্তীকালে।

ইতিহাস বলে, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালীর মাত্র নয়, সমগ্র মানব সমাজের ইতিহাসেই এক অবিনাশী গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ তো সঠিক এবং সত্য যে, সমকাল যে মূল্যই দিক না কেন, ক্ষণকাল ভুলিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন, আজকের বাঙালী সত্তার এই সারসত্য চেপে রাখা যায়নি, যাবেও না ভবিষ্যতে। যত দিন যায়, ততোই বঙ্গবন্ধু প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রতিটি পাতায়, বাঙালী জাতির আত্মমর্যাদাপূর্ণ হওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে।

সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তাঁর শুধু স্বপ্নই ছিল না। নিজেকেও তৈরি করেছিলেন সেই স্বপ্নপূরণের হাল ধরার জন্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ভাগ্যবিধাতা হিসেবে তিনি মূল্যায়িত হয়েছেন একাত্তর সালে। তাই স্বাধীনতার পূণ্যলগ্নে একাত্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক প্রফেসর মাহমুদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসেও এমন আর আসেনি; খুব কম দেশেই আসে। যেন এক অলৌকিক ঘটনা। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শেখ মুজিব।’

সত্যিই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অসাধারণ মহিমায় জেগে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী। কিন্তু এই জেগে ওঠা ফানুসের মতো ছিল না। কিন্তু ফানুসেই যেন পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায়। পরাজিত শত্রুরা থেমে ছিল না। তারা স্বাধীন ভূ-খণ্ড পাওয়া বাঙালী জাতির মুক্তির পথ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছিল। তাই দেখা যায়, সামরিক শাসক ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনকালে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু উপাধি মেনে না নেওয়ার মতো আস্পর্ধা দেখিয়েছে জান্তাশাসক; যিনি আবার বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও পরিস্থিতির চাপে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঘাতক এবং পরাজিত শক্তির কাছে সম্ভবত ভূমিকম্পসম ছিল বলেই তারা ভীতসন্তস্ত্র হয়ে পড়েছিল। ‘শেখ মুজিব’ নামটি উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি ক্ষমতা দখলকারী জান্তারা। তারা বুঝতো, বঙ্গবন্ধুর অবদান এ দেশে ভাবীকালের মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ অবদান। বিষয়টি তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর নাম ভুলিয়ে দেওয়ার নানা ষড়যন্ত্র করে তারা। ইতিহাস বিকৃত করতেও বুক কাঁপেনি তাদের। কিন্তু এ দেশের মানুষ জানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্থির লক্ষ্য সামনে রেখে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন। জনগণকে সংগঠিত করেছেন। কোথাও মাথা নত করেননি; আপোস দূরে থাক। জেল, জুলুম, হুলিয়া, অত্যাচার ইত্যাদি কোনো কিছুতেই ভীত হননি। অথচ তাঁকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা আজও অব্যাহত। স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা থেমে নেই।

শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল যারা, তারা স্বাধীনতার চার দশক পর উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, মুজিবকে অস্বীকার করার অর্থ কার্যত তাদের নিজেদেরই অস্বীকার করা। নিজেদের অস্তিত্ব যখন তারা হারাতে বসেছে মুজিব বিরোধীতার চৌহদ্দীতে তখনই উপলব্ধি করেছে- মুজিব ছাড়া তাদের কোনো ইতিহাস নেই। তাই আজ তারা মুজিব বন্দনা শুধু নয়, সঠিক ইতিহাসেরও সন্ধান করছে। এতোকাল পরে এসে তারা এমনও উপলব্ধি করছে যে, বঙ্গবন্ধু তো শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি নন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ধারার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন তিনি সেই ধারাকে অস্বীকার করা যাবে না। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার অর্থ কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে অস্বীকার করা।

জাতি হিসেবে বাঙালীর জানা যে, এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবা শেখ মুজিবের পেছনে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ, যাদের ‘নাক উঁচা’ ভাব তারা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। এদের অনেকে স্বাধীনতা চেয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা চায়নি। যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তাদের মুজিব বিরোধিতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাত্তরের পরাজিতরা সাহস ও শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা করেছে। মুজিব বিরোধিতার নামে তারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকাই লাভ করেনি; লাভ করেছিল একটি মূল্যবোধ। যা সন্নিবেশিত হয়েছিল সংবিধানে চার মূলনীতি হিসেবে। সেই মূলনীতিগুলো জান্তাশাসকরা পদদলিত করেছে। আর এসবই করা হয়েছিল পরাজিত শক্তির স্বার্থরক্ষায়।

এদের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে সকল শ্রেণীর দেশবাসীর স্বার্থে জাতীয় বিকাশের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তা এগুতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা সে প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। এমনকি নানা ধরনের বিকৃতি দেখা দেয় সমগ্র প্রক্রিয়ায়। অবশ্য এই ঘুণে ধরার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব থেকেই। আসলে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরো আগেই। যে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেই প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রাবস্থায় বহিষ্কার করা হয়েছিল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করায়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু আচার্য বা চ্যান্সেলর হিসেবে সমাবর্তনে যোগ দিতে চেয়েছিলেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। কিন্তু ঘাতকরা তার আগেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। বঙ্গবন্ধুর আর ক্যাম্পাসে যাওয়া হলো না। এই ঘটনার কয়েক বছর আগেও অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে অপদস্থ করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। জাতির পিতার অবস্থান ও সম্মান দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কার্পণ্য থাকার কথা নয় যেখানে, সেখানে ‘মুড়ি-মুড়কি একদর’ করার এই প্রবণতা অত্যন্ত গর্হিত। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বঙ্গবন্ধু হত্যা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হত্যার বিচার চেয়েছিল ছাত্র প্রতিনিধিরা। কর্তৃপক্ষ সে সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারেনি সামরিক জান্তার ভয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশেও শেখ মুজিবের সংগ্রাম ছিল মুক্তির জন্য। উপনিবেশ ও পাকিস্তানি দাসত্ববৃত্তির মনোভাব থেকে মুক্তি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি, দুর্নীতি, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, নাশকতা, নৃশংসতা, পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্তির লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন। দুর্নীতির বিষবাষ্প থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। এমনকি নিজ দলের সংসদ সদস্যসহ দলীয় লোকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান ছিল বলেই তিনি ইতিহাসে অনন্য স্থানে আসীন।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষাধর্মী কাজ খুব কম। এমনকি তার সৃষ্ট দলটি ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকলেও বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কার্পণ্যবোধ করে। সেতু, কালভার্ট, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়েও অধিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্ম ও আদর্শকে জনগণের সামনে তুলে ধরা। যারা এ দায়িত্ব পালনে অপারগ বা অনীহা প্রদর্শন করেন, ইতিহাস শুধু নয়, জাতিও তাদের ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিবকে চাপা দিয়ে রাখার সব আয়োজন ব্যর্থ হোক। মুক্ত হোন তিনি জনগণের কাছে। 

লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়