ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বইমেলায় শিশুদের বই: কী লিখছি আমরা?

আহমেদ রিয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫১, ৩০ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:৫৩, ৩০ মার্চ ২০২১
বইমেলায় শিশুদের বই: কী লিখছি আমরা?

করোনার কারণে এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হয়েছে শীতের বদলে বসন্তকালে। বইমেলার এ সময়ে বেশ গরম পড়েছে, দেশের উপর তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে মেলার পরিসর বেড়েছে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ- পনেরো লাখ বর্গফুট।

এ বছর ৫৪০টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৮৩৪টি স্টল। সঙ্গে প্যাভিলিয়ন আছে ৩৩টি। এর মধ্যে সামান্য কিছু সরকারি ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় প্রত্যেক প্রকাশনীর স্টলে শিশুদের বই পাওয়া যায়। শিশুকিশোরদের বইয়ের কমতি নেই।
এই যে মেলাজুড়ে শিশুদের এত এত বই, কিন্তু মেলায় শিশুরা কোথায়? এবার গ্রন্থমেলায় শিশুপ্রহর রাখা হয়নি। তবে শিশু চত্বর একটা আছে। ওখানে শিশুদের প্রকাশনীর স্টল আছে ৯৭টি। শিশুচত্বর বাদে মেলা প্রাঙ্গণ খুবই গোছানো। স্টলসারির সামনে প্রশস্ত জায়গা। প্যাভিলিয়নগুলোর চারপাশ খোলামেলা। মেলায় আগত পাঠক ও বইক্রেতারা স্বচ্ছন্দে মেলায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। কিন্তু শিশু চত্বর!

শিশু চত্বর ভীষণ রকম সংকীর্ণ। অপ্রশস্ত গলি। বরং শিশু চত্বর হওয়া দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি খোলামেলা। কারণ বইমেলায় শিশুরা একা আসে না। সঙ্গে অভিভাবকরাও আসেন। অন্য জায়গার তুলনায় জনসমাগম বেশি হয়। তবে শিশু চত্বরের সঙ্গে মেলায় প্রকাশিত শিশুদের বইয়ের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শিশু চত্বরের এবারের দৈন্যদশা না হয় আগামীবার কাটিয়ে ওঠা যাবে। বাংলা একাডেমি সচেষ্ট হলেই সেটা সম্ভব। কিন্তু শিশুদের জন্য প্রকাশিত বইয়ের দুর্দশা! ওটা কাটিয়ে উঠতে হলে যে সবারই সচেষ্ট হওয়ার দরকার।

প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা কেন্দ্র করে শিশুদের জন্য প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু শিশুদের জন্য প্রকাশিত সব বই-ই কি শিশুতোষ? বিগত কয়েক বছরে এই শিশুতোষ বই নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু শিশুতোষ বইয়ের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড এখনও তৈরি হয়নি। এই মানদণ্ড কিন্তু আইন করে কিংবা নীতিমালা প্রণয়ন করে হয় না। এটা দায়িত্বশীলতা থেকে তৈরি হয়। এখন প্রশ্ন হলো কাকে হতে হবে দায়িত্বশীল?
শিশুকিশোরদের বইয়ের বেলায় আসলে দায়িত্বশীল হতে হয় সবাইকে। লেখক, আঁকিয়ে, বানান সমন্বয়ক, প্রকাশক, অভিভাবক, ক্রেতা- সবাইকে।

শিশুদের জন্য বই আর বড়দের জন্য বইয়ে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। শিশুদের বইয়ের শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, কাহিনিবিন্যাস, অলঙ্করণ, বইয়ের আকার, ছাপার মান- এ সব কিছুতে অতিরিক্ত সাবধান থাকতে হয়। শিশুদের দৈহিক গঠনের জন্য যেমন অতিরিক্ত যত্নের দরকার হয়, ঠিক তেমনি শিশুদের বইয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি যত্ন থাকতে হয়। বইমেলায় শিশুদের বই হাতে নিলে যে কোনো সচেতন অভিভাবক বুঝতে পারবেন, কোন বইটায় যত্ন আছে আর কোন বইয়ে নেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শিশুদের জন্য প্রকাশিত বেশিরভাগ বইয়ের কাহিনি থেকে শুরু করে বই প্রকাশের সবগুলো ধাপে অযত্নের ছাপই বেশি চোখে পড়ে। খুব কমসংখ্যক বইতেই যত্নের ছাপ পাওয়া যায়। এই অযত্নের দায় লেখক যেমন এড়াতে পারেন না, তেমনি এড়াতে পারেন না এর সঙ্গে যুক্ত কেউ-ই। অনেক সময় শিশুদের জন্য প্রকাশিত কিছু বই দেখলে মনে হয়, যত্ন বিষয়টাই বুঝি কেউ জানেন না।

অনেক বিখ্যাত লেখক আছেন, যাঁরা বড়দের জন্য লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ব্যস, ওই খ্যাতিকে পুঁজি করে তিনি ছোটদের জন্য লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু ছোটদের জন্য লিখতে হলে যে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে লিখতে হয়, কিংবা বিশেষ যত্নে লিখতে হয়- সেটা ভাবার সময় কোথায়? বিখ্যাত লেখক শিশুকিশোরদের জন্য লিখে ফেললেন। প্রকাশকও প্রবল আগ্রহে সে বই প্রকাশ করে ফেললেন।
অনেক অভিভাবক খ্যাতির জোশেই খ্যাতিমান লেখকের বই কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু বইয়ের মূল পাঠক সে বই থেকে আনন্দ নিতে পারছে কিনা- কেউ ভাবেন না। তবে অনেক লেখকের অযত্নটা পাঠক ঠিক ধরে ফেলেন, পাঠকের বয়স যত কমই হোক না কেন। আসলে শিশুদের ঠকানো মোটেও সহজ নয়। ধরা পড়তেই হবে।

এ বিষয়ে একটি সত্যিকার ঘটনার কথা বলতেই হয়। একটি আর্ন্তজাতিক প্রকাশনা সংস্থা প্রতিবছর বই প্রকাশ করে। সে বই সরকারি স্কুলে ক্লাসরুম পাঠাগারে বিলি করে। তো সেই প্রকাশনা সংস্থা বই প্রকাশ করার আগে বইয়ের মূল পাঠকদের হাতে প্রকাশিতব্য বইটির কপি নিয়ে যায়। তারপর পাঠকের রিভিউসহ আরো অনেক কিছু পর্যালোচনা করে তারপর বই প্রকাশ করে। তেমনি এক বইয়ে একটি কাহিনি ছিল- ছাগল গাঁদাফুল গাছ খেয়ে ফেলেছে। ব্যস, অমনি সিরাজগঞ্জের দুর্গম চরাঞ্চলের এক স্কুলের খুদে পাঠক ওই তথ্যে আপত্তি জানাল। বলল, ছাগল তো গাঁদাফুল গাছ খায় না।

তথ্যটা লেখককে জানানো হলো। লেখক আসলে ভেবেছিলেন, ছাগল যেহেতু সব খায়, গাঁদাফুল গাছও খায় নিশ্চয়ই। কিন্তু ছাগল যে সত্যি সত্যি গাঁদাফুল গাছ খায় না, এটা লেখক বুঝতে পারেননি। এ বিষয়ে লেখকের জানার অভাব ছিল। কিন্তু সেই শিশুপাঠক ঠিকই ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছে। শিশুসাহিত্যের লেখক হিসেবে এতটা সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে কি আমরা ভাবি? শিশুপাঠকরা কিন্তু ঠিকই ভাবে।

শিশুদের জন্য বইয়ের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে বয়স উপযোগী বই। লেখকরা এখানেও হিমশিম খান। লেখক যখন কোনো শিশুর উপযোগী লেখা লিখবেন, সেটা কোন বয়সি শিশুর জন্য লিখছেন ভাবা দরকার। সাত বছর বয়সি শিশুর উপযোগী লেখা আর বারো বছর বয়স উপযোগী শিশুর জন্য লেখা নিশ্চয়ই এক রকম হবে না!
কিছুদিন আগে আমার সন্তান-বয়সি এক কিশোরকে তুমুল গালিগালাজ করতে শুনলাম। খবর নিয়ে জানলাম, ওই কিশোর বইপড়ুয়া। প্রচুর গল্পের বই পড়ে। অবাক হলাম- বইপড়ুয়া কী করে এরকম গালিগালাজ করে? তারপর যেটা জানা গেল, তাতে বেশ অবাক হলাম। ওই কিশোর ইদানিং এমন কিছু বই পড়েছে, যেগুলোতে গালিগালাজ আছে। এবং বইগুলো কিশোরদের জন্য লেখা। এবং বেশ নামি লেখকের বই।

প্রশ্ন হলো লেখক কেন বইতে অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করেছেন? দুটো কারণে ঘটতে পারে। হয়ত ওগুলো লেখকের অবচেতন মনে ঢুকে পড়েছে। লেখার সময় লেখক সতর্ক ছিলেন না। বইমেলা আর প্রকাশকের চাপে তিনি কেবল লিখেছেন। কী লিখেছেন সেটা খেয়াল করেননি। কিংবা লেখক হয়ত ভেবেছেন, সমাজের চলমান শব্দগুলোই তিনি বইতে ব্যবহার করবেন। আসলে আমাদের পরিচিত জগতকে শিশুকিশোর সাহিত্যে কতখানি আনা দরকার আর কতখানি এড়ানো উচিত, সেটাও ভাবার দরকার আছে।

কিশোরদের জন্য লেখা একটা বই চোখে পড়ল- ‘গলাকাটা দানো’। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে যে কারো গায়ে কাঁটা দেওয়ার কথা। একটা দানোর কাটা মাথা ধরে আছে এক তরবারিঅলা মানুষ। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন দানোর মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। আরেকটি বইয়ের নাম ‘তমুক মামার গার্লফ্রেন্ড’। খুব বিখ্যাত এক লেখকের বই। এবং এটাও শিশুতোষ বই!
আরেক বিখ্যাত লেখক, যিনি কিশোরদের কাছে খুবই জনপ্রিয়, কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর বইয়ের এক জায়গায় আছে- টেলিভিশন থেকে একটা ভূত বেরিয়ে কিশোরীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
শিশুকিশোরদের বইয়ে এসব বিষয় থাকাটা কতখানি ভয়ঙ্কর, সেটা নিয়ে না ভাবলে কি চলে!

আমাদের সাহিত্যে সম্পাদনা তো প্রায় নেই। সম্পাদনা করে বই প্রকাশের চর্চার অভ্যাসটাও আমাদের নেই। আর নেই বলেই যা তা বই প্রকাশিত হচ্ছে। শিশুদের জন্য প্রকাশিত সিংহভাগ বইতেই তথ্য, বানান ও বাক্য ভুলে ভরা। এর সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে নেটবই। বাংলাদেশের প্রায় নব্বইভাগ বই প্রকাশ হয় বাংলাবাজার থেকে। বাংলাবাজারে নেটবই কথাটা বহুল প্রচলিত। অনেক প্রকাশক নেটবই প্রকাশ করেন। নেট থেকে তথ্য নামিয়ে হুবহু ছাপিয়ে বই প্রকাশ করেন। ওসব বইতে এতটাই ভুল থাকে যে, শুদ্ধটাই খুঁজে বের করা মুশকিল! কিন্তু অবাক হলেও সত্যি যে, ওসব বইয়ের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। কারণ?

স্কুলের পাঠাগারে বই কেনার একটা বাজেট থাকে। সরকারি স্কুলে তো থাকেই, অনেক বেসরকারি স্কুলেও থাকে। এছাড়া বিভিন্ন দিবসে পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া হয় কোথাও কোথাও। তো ওসব স্কুলের শিক্ষকরা বাংলাবাজারে বই কিনতে এসে, বইয়ের মান দেখেন না। তাঁরা দেখেন কোন বইতে সবচেয়ে বেশি কমিশন পাওয়া যাবে। ভুলে ভরা নেটবই তাঁরা কিনে নিয়ে যান ষাট-সত্তর পার্সেন্ট কমিশনে। তারপর সেই ভুলে ভরা নেটবই জায়গা করে নেয় স্কুলের পাঠাগার কিংবা শিক্ষার্থীদের হাতে। বিভিন্ন স্কুলের পাঠাগারে খোঁজ করলেই কিন্তু এর সত্যতা মিলবে।

সত্যতা মিলবে বইমেলায় গেলেও। বইমেলার শিশুকিশোরদের জন্য প্রকাশিত বেশিরভাগ বইতেই চোখধাঁধানো ছবি। কিন্তু লেখায় অসংখ্য ভুল। এবং বেশিরভাগ বই নেটবই। সবমিলিয়ে মনে হয় শিশুকিশোরদের জন্য প্রকাশিত বই প্রকাশ করা খুবই সহজ। এবং এসব দেখার বা পর্যবেক্ষণ করার কেউ নেই। এসব বইয়ের বিক্রিও যে কোনো মৌলিক বইয়ের চেয়ে বেশি। তো মৌলিক বইয়ের চেয়ে যখন এসব নেটবইয়ের বিক্রি বেশি তাহলে প্রকাশকরা কেন ছাপবে না?

প্রশ্ন হচ্ছে এসব বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কি প্রকাশকের কোনো দায়িত্ববোধ নেই? কোত্থেকে থাকবে? লেখক হিসেবে যদি আমাদেরই দায়িত্ববোধ না থাকে, বইয়ের ক্রেতা হিসেবে যদি আমরাও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকি- প্রকাশকের কাছ থেকে সেটা আশা করি কী করে?

শিশুকিশোরদের বইয়ের এ দুর্দশার চিত্র অনেক বছর ধরেই চলছে। সামনে হয়ত আরো চলবে। তবে এতসব নিরাশার মাঝেও কিছু আশার বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন বেশ কিছু লেখক ও প্রকাশক এগিয়ে এসেছেন। জেনে বুঝে এসব লেখক যেমন শিশুকিশোরদের বয়স উপযোগী বই লিখছেন, তেমনি কিছু প্রকাশক এসব বই সম্পাদনা করে প্রকাশ করছেন। শিশুকিশোর পাঠক ও অভিভাবকরা এখন এসব সুপাঠ্য বইগুলো খুঁজে নিলেই হয়। কারণ, আশার বাতিটা টিমটিম করে একসময় নিভে যাবে? নাকি জ্বলজ্বল করে জলে উঠবে, নির্ভর করছে শিশুকিশোর পাঠক ও তাদের অভিভাবকের উপর।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়