ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন: কী আছে মমতার ভাগ্যে

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ১ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১১:৫৬, ২ এপ্রিল ২০২১
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন: কী আছে মমতার ভাগ্যে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ২৭ মার্চ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় কেন্দ্রে ভোটারদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষও হয়েছে। আজ ১ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন।

প্রথম ধাপের ভোটেই বিজেপির বিরুদ্ধে ইভিএম জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। পাশাপাশি নির্বাচনের মধ্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার অভিযোগ- প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের দায়ে তার ভিসা বাতিল হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায় প্রভাবিত অনেকগুলো নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। বাংলাদেশের মতুয়া সম্প্রদায়ের অনেকের আত্মীয়-স্বজন পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন। মোদির তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মানে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের একটি প্রভাব পড়া। মমতা বলেন, ‘২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যখন এক বাংলাদেশি অভিনেতা আমাদের র্যা লিতে যোগ দেন, তখন বিজেপি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলে তার ভিসা বাতিল করে। এখন নির্বাচনের সময় আপনি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে এক শ্রেণির মানুষের কাছে ভোট চাইছেন। আপনার ভিসা কেন বাতিল করা হবে না?’

মূলত নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি মন্দিরে পূজা দেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে এসব অভিযোগ করেন মমতা। ওড়াকান্দি মতুয়া সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি আসনে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মমতার অভিযোগ: ‘তারা প্রায়ই বলে, মমতা বাংলাদেশ থেকে মানুষ নিয়ে এসেছে, অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখন ভোট মার্কেটিং করতে বাংলাদেশে চলে গেছেন।’

মমতা সত্তরের দশকে নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন কংগ্রেস দিয়ে। প্রথম সাফল্য দেখিয়েছিলেন ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ানকে হারিয়ে। পরের পনেরো বছর তার বিকাশের কাল। নব্বইয়ের শেষে কংগ্রেস ভেঙে করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনশ টাকার শাড়ি পরা, দেড়শ টাকার বিদ্যাসাগরী চটিধারী, কালিঘাটের টালির ঘরের বাসিন্দা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষের প্রতি আপাত প্রতিশ্রুত হিসেবেই দেখা গেছে। যে পার্টিতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কায়েম হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার প্রধান বিপরীত স্বর। কেন্দ্রেও মন্ত্রী হয়েছিলেন। দুই দফায় রেলমন্ত্রী হিসেবে তার কাজ বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। এসব কাটিয়ে তার সবচেয়ে বড় কীর্তি ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটানো। যেখানে তিনি পরিবর্তনের শ্লোগান তুলে মানুষকে মাতিয়েছিলেন।

কিন্ত সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে তুমুল আন্দোলনে তিনি যে প্রতিশ্রুতিগুলো মানুষকে দিয়েছিলেন, তার কিছুই মেটাতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রথম দফায় কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন করে নির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল এবং সরকার গঠন করেছিল। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি  মমতার কংগ্রেস আর ইন্দিরার কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয় করেছিলেন। এ কোয়ালিশন বেশিদিন টেকেনি। সিপিএম তথা বামজোটের ৩৪ বছরের রাজত্ব উচ্ছেদ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতময় এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, এক সময় মনে হয়েছিল দিল্লিতে নড়বড়ে কংগ্রেস রাজত্বের উচ্ছেদ ঘটার পর মমতাই দিল্লির মসনদে বসবেন এবং দ্বিতীয় ইন্দিরা হবেন। কিন্তু তিনি তা পরেননি। কারণ ভারতজুড়ে মোদির উত্থান। ভারতের বহুরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসীন হলো। তবে তারা পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী দল হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ মমতা ঝড়ে তখনও কাঁপছে পশ্চিমবঙ্গ। এবার এই ঝড় থামিয়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থান করে নিতে চাচ্ছে বিজেপি। 

পশ্চিমবঙ্গে বাম যুক্তফ্রন্টের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর। তৃণমূল শাসনের পঁচন শুরু হয় তাদের এক মেয়াদের শাসনের পরই। তৃণমূল মূলত কংগ্রেস ত্যাগী এবং কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত কিছু নেতা এবং অন্যান্য দলের কাছ থেকেও ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে বের করে আনা নেতা ও কর্মী মিলে গড়া একটি দল। এর প্রমাণ কিন্তু এই নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে। দলছুটের হিড়িক। দল বদলের হিড়িক দেখে মনে হয় রাজনীতিকরা দেশের জন্য কিংবা মানুষের জন্য রাজনীতি করেন না, করেন ব্যক্তিতন্ত্রের জন্য, নিজের লাভ-লোকসানের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে সিপিএম ও বামফ্রন্টকে ধ্বংস করতে গিয়ে মমতা সেক্যুলারিজমকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। সিপিএম ও কংগ্রেসের সেক্যুলার রাজনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি। ত্রিপুরায় বাম শাসন উচ্ছেদ করার পর বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ প্রদর্শন করার  শক্তি অর্জন করেছে।

বিজেপি আমলে ভারত কেমন চলছে? গত আশি বছরের মধ্যে ভারতে এখন ধনী-গরিবের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৮ কোটি রুপি যা মাত্র ছয় বছর আগেও ছিল ৩২ হাজার ১০৯ কোটি রুপি।  এসব অর্থের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক থেকে অর্থাৎ জনগণের টাকা লোপাট করে। ভারত এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় সম্পদ-বৈষম্যের দেশ। ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘ক্রেডিট সুইস’-এর গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্টের তথ্য মতে দুনিয়ায় আলট্রা ধনীরা যেখানে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বানিয়েছেন, এমন দেশের তালিকায় প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, তারপর চীন ও জার্মানি, তারপরেই ভারতের নাম। ভারতীয় ধনীদের সম্পদের বড় অংশ বেড়েছে বিজেপির আমলে। (দেশ রূপান্তর, ২৩ মার্চ ২০২১)

২০০১ সালের অক্টোবরে ভারতের গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। এর আগ পর্যন্ত গুজরাটে আদানি গ্রুপ সে রকম বলার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো কোম্পানি ছিল না। মোদি গুজরাটের মুখমন্ত্রী ছিলেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। আদানি এ সময় সম্পদ বানিয়েছে ২.৬ বিলিয়ন ডলার। আর মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই সম্পদে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারে। বিজেপি শাসিত সব রাজ্যেই বেকারত্বেও হার বেশি, কৃষকের আত্মহত্যার হার বেশি। বিজেপির এই নেতিবাচক দিকগুলো তৃণমূল সেভাবে তুলে ধরতে পারছে না। এগুলো জনগণ ভালোভাবে বুঝলে এবং জেনে থাকলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আসার কথা নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গ ছিল এত বছর বাম রাজনীতি ঘাঁটি।

মমতা সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন নন্দীগ্রাম নিয়ে। আমাদের মনে আছে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন জানিয়ে এবং সেই বিদ্রোহের মাথায় পা রেখে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। কৃষকদের স্বার্থহানি ঘটিয়ে সেখানে বৃহৎ শিল্পপতিদের কারখানা স্থাপনের সুবিধা দিতে গিয়ে, কৃষক হত্যা করে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে। কৃষকদের আসলে কারা হত্যা করেছিল, পুলিশ না অন্য কোনো দুষ্কৃতকারী সেই হিসাব এখন কিছুটা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। সেই নন্দীগ্রামে তৃণমূলের আগের অবস্থা নেই। তৃণমূল সরকারও কৃষকবিরোধী শিল্পপতিদের অনুগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। তার দল থেকে বহু জাদরেল নেতা বেরিয়ে গেছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছেন টালিউডের তারকারা। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তারকারা কি রাজনীতি বুঝেন? সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজন যদি রাজনীতির মূল মঞ্চে চলে আসে তাহলে রাজনীতির লাভ না ক্ষতি-  দেখার অপেক্ষায় আছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

মমতা পশ্চিমবঙ্গে এখনো ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয়। কিন্তু তার দল তৃণমূল কিন্তু তা নয়। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বহু অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা জনপ্রিয় নন। কিন্তু বিজেপি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে জয়ী হয় তাহলে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কোনো দলই আর ভারতে থাকলো না। বামপন্থীদের ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গও যদি হাতছাড়া হয়, তাহলে বিশ্বের বিশাল গণতান্ত্রিক দেশটিতে বামপন্থী সংগঠন সেই অর্থে আর থাকছে না। 
নব্বইয়ের শেষে মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের মাধ্যমে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তার অন্যতম একটি আদর্শিক ভিত্তি ছিল রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্র থেকে বের করে আনা। অবিবাহিত ও নিঃসন্তান মমতার ওপর মানুষের সে আস্থা তৈরিও হয়েছিল। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই নীতি নিয়েই চলেছিলেন। কিন্তু প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই তিনি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন এবং পার্টির ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অথচ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অন্তহীন অভিযোগ জমা পড়েছে। ফলে দলের বাঘা বাঘা নেতাদের পার্টি ছাড়তে হয়েছে। এটিও তৃণমূলের একটি বড় নেতিবাচক দিক।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির যে সমীকরণ দেখা যাচ্ছে তাতে মমতার সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত নিজের দল টিকিয়ে রাখা। এটি করতে হলে দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে পারিবারতন্ত্রের ফাঁদ থেকে। দ্বিতীয়ত আসন্ন নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসা। বিজেপি ছাড়া বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট মিলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে মমতার ক্ষমতায় ফেরাটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুতরাং এ কথা বলা যেতেই পারে পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক ঝড়ো সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন। 

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়