ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার কতটা প্রস্তুত?

বিভুরঞ্জন সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০০, ১৭ এপ্রিল ২০২১  
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার কতটা প্রস্তুত?

প্রথম দফার চাইতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ বেশি আগ্রাসীরূপে আমাদের দেশসহ কয়েকটি দেশে মরণ কামড় হেনেছে। একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা তিন ডিজিটে পৌঁছেছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার দুটোই কেবল বাড়ছে। কোথায় গিয়ে এটা থামবে কেউ বলতে পারছেন না।

আগে বয়স্করা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও এবার কম বয়সীদেরও করোনা রেহাই দিচ্ছে না। গত বছর ৮ মার্চ সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ৯৫ দিনে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ১৫ দিনেই মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। গত এক বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে দশ হাজার। দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মৃত্যুর তালিকায় আছেন। শহরে মৃত্যুর হার বেশি হলেও, গ্রামে একেবারে বিস্তৃত হয়নি- তেমন দাবি করা যাবে না।

করোনার বিস্তৃতি রোধে সাধারণ মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, বাইরে বেরুলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ দূরত্ব মনে চলার বিধি মেনে না চললে করোনার বিস্তার ঠেকানো যাবে না। আমাদের অনেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা আছে। এটা খুবই ক্ষতিকর। সরকার কঠোরতা দেখালে লাভ নেই, মানুষ যদি নিয়ম মানতে না চায়। ঢিলেঢালা লকডাউনের সমালোচনা করে আমরা নিজেরাই অহেতুক বাইরে বের হয়ে সমস্যা তৈরি করছি। নিজের জীবন রক্ষায় নিজে সচেতন না হয়ে সরকারকে দোষ দিয়ে আমরা দুঃসময় দূর করতে পারবো না। নিজেও বাঁচবো, অন্যকেও বাঁচাবো- এই প্রতিজ্ঞা নিতে হবে সবাইকে।

করোনা মোকাবিলায় কোনো দেশই পুরো সফলতা দেখাতে পারেনি। একেক দেশের সমস্যা ও বাস্তবতা একেক রকম। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধের সেরা উপায় হিসেবে বিবেচিত। এ পর্যন্ত মৃত্যু সীমিত রাখতে পেরেছে সামান্য দুয়েকটি দেশ। তবে যেসব দেশ করোনাকে খাটো করে দেখেছে, একে প্রতিরোধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, নাস্তানাবুদ হচ্ছে সেসব দেশই বেশি। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলোও করোনা প্রতিরোধে সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। পৃথিবীতে স্বাস্থ্য খাত তথা জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি যে দুয়েকটি ছোট দেশ ছাড়া কারো কাছেই বেশি গুরুত্ব পায়নি, সেটা স্পষ্ট হয়ছে করোনা হানা দেওয়ার পর। করোনার ঝড়ো হাওয়া পৃথিবীকে টালমাটাল করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত না করে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে কোনো দেশ যে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হতে পারে না, সামরিক শক্তি যে কোনো দেশের আপৎকালীন রক্ষাকবজ নয়, সেটাও সম্ভবত অনেকের বিবেচনায় এসেছে।

চিকিৎসা খাতে বেসরকারি উদ্যোগও যে কতটা ভঙ্গুর সেটাও করোনাকালে অনেক দেশেই দেখা গেছে। বিপদের সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। কোনো কোনো দেশে তাই বাধ্য হয়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল সরকার অধিগ্রহণ করেছে। এটা প্রমাণ হয়েছে যে, সবাইকে মোটামুটি মানের চিকিৎসাসেবা দিতে হলেও সরকারি চিকিৎসা কাঠামোকেই পরিপুষ্ট করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে।

আমাদের দেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি-দুর্বলতা আছে। কেনাকাটায় চুরি-ডাকাতির খবরও জানা যাচ্ছে। তারপরও করোনাকালে সরকারি ব্যবস্থাই অধিক কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সময় পেয়েও আমাদের সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হয়নি বলে সমালোচনা আছে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর, রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা- সব কিছুতেই ঘাটতি ছিল আমাদের। অন্যসব দেশে, এমনকি আমেরিকাতেও এসবের অভাব আছে। আমাদের দেশে বাড়তি সমস্যা হলো দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা। আমাদের দেশে কয়টি ভেন্টিলেটর আছে, তার মধ্যে সচল আছে কয়টি, সে তথ্যও আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কাছে ছিল না। দেশে সাধারণভাবে কত রোগীর ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দরকার হয়, তাও হয়তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা নেই। তাই ভেন্টিলেটরের গুরুত্ব এতদিন অনুভূত হয়নি। মহামারির সময় এটা আরও প্রকটভাবে সামনে এসেছে।

আমাদের দেশে বড় সমস্যা হলো, আমরা কোনো ক্ষেত্রেই ন্যায্যতা বা সমতার নীতি অনুসরণ করি না। যাদের আছে, তাদের আরো দেওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় প্রথম আসে। যাদের কিছু নেই, তাদের পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আসে দ্বিতীয় ধাপে। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত এবং দুস্থ মানুষদের জন্য বর্তমান সরকার আগে থেকেই নানা ধরনের সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নগদ অনুদানসহ নানা সহায়তার আওতায় আছে লাখ লাখ মানুষ। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে তুলনামূলকভাবে অগ্রগতির ধারায় তার স্বীকৃতি দেশের বাইরে থেকেও পাওয়া গেছে। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে হাঁটছি। কিন্তু করোনা প্রতিরোধের জন্য কয়েক দিনের লকডাউনের ধাক্কা সামলানোর সামর্থও যে আমাদের এখনও হয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে। আমাদের দেশে উপার্জনহীন মানুষের সংখ্যা কম নয়। স্বল্প উপার্জন করা বা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যাও হাতে গোনার বাইরে। অসময়ের জন্য কোনো সঞ্চয় নেই এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক । এসব মানুষ সরকারের কোনো হিসাবের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। ফলে কঠোর লকডাউনের প্রসঙ্গ এলে মানুষের না খেয়ে থাকার বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে চলে আসে। গত বছর লকডাউনের সময় সরকার ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। বেসরকারিভাবেও কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সহায়তা রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের বিকল্প হতে পারে না।

দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই বলে সরকার বারবার আশ্বস্ত করার পরও হাহাকার আগেও কমেনি, এবারও কমবে না। আগের বছরই বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদনে করোনার কারণে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল। আধপেটা খেয়ে, ক্ষুধা পেটে রেখে ঘুমাতে যায় এমন মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ। করোনার জেরে গত বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা বাস্তবে কি হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।  
বাংলাদেশে কি খাদ্য সংকট দেখা দেবে? মানুষকে কি অনাহারে থাকতে হবে? না খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা কি ঘটবে? সরকারি তরফ থেকে জোর দিয়েই বলা হচ্ছে যে, দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা অমূলক। ধানসহ অন্য সব কৃষি ফলন (বিভিন্ন ধরনের সবজি) যদি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে যদি কড়া মনোযোগ রাখা যায় তাহলে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় এখনই অস্থির হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের ঠিক দাম পায় নিশ্চিত করতে হবে। কৃষককে যদি এই দুঃসময়েও পানির দামে ধান বিক্রি করতে হয়, মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়ারা যদি এবারও মুনাফা বাণিজ্যে নামে তাহলে সেটা ভবিষ্যতের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ, সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকেও রাখতে হবে কঠোর নজরদারি।

কেউ কেউ এমন আশঙ্কা করছেন যে, বাজারে খাদ্যসামগ্রী থাকলেও আয়-রোজগার না থাকায় অনেকেরই তা কেনার সামর্থ থাকবে না। মানুষের কর্মহীনতা নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। এটা একটা গুরুতপূর্ণ বিষয়। আয়হীন কয়েক কোটি মানুষের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে হবে। সরকারের সামর্থেও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের অঢেল রাষ্ট্রীয় সম্পদ নেই। তারপরও আছে সম্পদ ব্যবহারের সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব। সরকারের জন্যও পরিস্থিতি কোনো বিবেচনাতেই অনুকূল নয়। সরকারকে তাই ঝেড়ে কাশতে হবে। কতটুকু সম্পদ আছে, কীভাবে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা যাবে তা কোনো রাখডাক না করে প্রকাশ করতে হবে। মানুষের কাছে সব তথ্য থাকলে কোনো সন্দেহ তৈরি হবে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পানি ঘোলা করার সুযোগ পাবে না।

সমস্যা অগ্রাহ্য করা যাবে না। সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই অর্থ সরকার কোথা থেকে পাবে? ‘অংশীদারি অর্থনীতি’ বলে একটি কথা হালে চালু হয়েছে। বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের একটি অংশ সরকার নিয়ে নেবে এবং তা গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেবে। এটা অবশ্য সহজ কাজ নয়। আমাদের দেশের বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা সব সময় সরকারের কাছ থেকেই সুবিধা নেয়ার ফিকিরে থাকেন। তারা কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফন্দি খোঁজেন। এখন বলবেন, আমাদের ব্যবসাই তো লাটে উঠেছে। লাভ কোথায় যে তার অংশ দেব? যদি এভাবে অর্থ সংগ্রহ একেবারেই সম্ভব না হয়, তাহলে সরকার ‘সম্পদ কর’ বসানোর কথা ভাবতে পারে। দেশে এখন অনেক কোটিপতি। শীর্ষ স্থানীয় সম্পদশালীদের ওপর তিন/চার শতাংশ হারে সম্পদ কর বসিয়ে সরকার আপৎকালীন অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। কোনো দেশের বিশেষ মডেল অনুসরণ না করে নিজেদের সংকট সমাধানে নিজেদেরই সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

করোনা একদিকে স্বাস্থ্য সংকট, অন্যদিকে তা অর্থনৈতিক সংকটও বটে। এখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের স্বার্থে সরকারকে একদিকে মানবিক গুণের প্রকাশ দেখাতে হবে, অন্যদিকে পরার্থপরতার অর্থনীতি অনুসরণে বিত্তবানদের বাধ্য করতে প্রয়োজনে যতটুকু কঠোর হওয়া প্রয়োজন, ততটুকু কঠোরতাও দেখাতে হবে। গত এক বছরে সরকারের নিশ্চয়ই কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছু না জেনে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি নিশ্চয়ই এবার কিছু জানার পর হবে না। মৃত্যুর সংখ্যা দেখে হতবিহ্বল না হয়ে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার দৃঢ়তা সরকারকে দেখাতে হবে। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়