ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এক পা নিয়ে খেলে যেভাবে জয়ী হলেন মমতা

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ৩ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:৫৬, ৩ মে ২০২১
এক পা নিয়ে খেলে যেভাবে জয়ী হলেন মমতা

টানা তৃতীয়বারের মতো পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে বেসামাল ঢেউ শুরু হয়েছিল, তা আপাতত থামল। বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে মাঠে নেমেছিলেন তাতে এ লড়াই শেষ পর্যন্ত মোদি বনাম মমতার যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল!

শোনা যায়, মোদি এতটাই মড়িয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, একমাসে ২২ বার কলকাতা এসেছিলেন। তবে বিজেপি-তৃণমূলের এই লড়াইয়ে বাম-কংগ্রেস দৃশ্যের আড়ালে চলে গেল। এবং এটা স্পষ্ট তাদের হারিয়ে ফেলা জায়গাটাই দখল করেছে বিজেপি। যাই হোক, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান শেষে নিজ আসনে হেরে গেলেও তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন মমতা। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে ছয়মাসের মধ্যে কোনো আসনে জয়ী হয়ে আসতে হয়। এই পথ মমতার জন্য খোলাই রয়েছে। তবে, দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কারণ বাম-কংগ্রেসকে হারিয়ে এবার দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে বিজেপি!

বিজেপির প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা অমিত শাহ বাংলার গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে বলেছিলেন- বিজেপি জিতলে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে একটি পাখিও ঢুকতে পারবে না। কথাটি দুই বাংলার মানুষের মধ্যে যে সখ্য রয়েছে সেখানে আঘাত লাগার মতো। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের বুকে আঘাতটি লেগেছে। বাংলাদেশ থেকে কোন স্বার্থে ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটবে? ভারতের অর্থনীতি কিংবা সামাজিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে কি খুব বেশি ভালো? পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিজেপির এই  অবৈধ অনুপ্রবেশকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছে। তবে, ২০১৬ সালে বিজেপি যেখানে ৩টি আসন পেয়েছিল, এবার  সেখানে পেলো ৭৬টি আসন। এটি বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, অর্থ এবং নায়ক-নায়িকাদের দ্বারা প্রচারণা চালানোর ফল।

গোটা ভারতে বিজেপি শাসনের যে প্রভাব ও ফল তা নিশ্চয়ই পশ্চিমবেঙ্গর জনগণের জানা। গত ৮০ বছরের মধ্যে ভারতে এখন ধনী-গরিবের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। মন্দ ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৮ কোটি রুপি যা মাত্র ৬ বছর আগেও ছিল ৩২ হাজার ১০৯ কোটি রুপি। শুধু বিজেপি আমলে দেশটিতে ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ নিয়েছে ধনিক শ্রেণী। এসব  অর্থের বড় অংশ নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক থেকে অর্থাৎ জনগণের টাকা লোপাট করে। ভারত এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় সম্পদ-বৈষম্যের দেশ। বিজেপি শাসিত সব রাজ্যে বেকারত্বের হার বেশি, কৃষকের আত্মহত্যার হার বেশি। এগুলো জনগণ জানে। মোদি সরকার সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ‘বিদেশি সাহায্য নেব না’ সূত্রের মাধ্যমে দারিদ্র্য ঢাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারলেন না। পরে বিশ্বের ২০টি দেশ থেকেই সাহায্য নিতে হয়েছে। তার মধ্যে শত্রু চীনও রয়েছে। আর এসব কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ধরাশায়ী হয়েছে।

তবে, বাম-কংগ্রেস জোটের শোচনীয় অবস্থা কল্পনাতীত। যে রাজনৈতিক জোট টানা ৭ বার, ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে, সেই বামফ্রন্টের এই অবস্থা! তবে, এই ব্যর্থতাকে ভারতে বামপন্থার ব্যর্থতা হিসেবে দেখারও অবকাশ নেই। কারণ একই সময়ের নির্বাচনে কেরালায় একই দলের লোকেরা আবারও ক্ষমতায় এসেছে। পাশের রাজ্যে বিহারেও কয়েকমাস আগের নির্বাচনে বাম দলগুলো অতীতের চেয়ে অনেক বেশি আসন পেয়েছে। ২০১১ সালে মমতা যখন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ক্ষমতায় আসেন তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল নন্দীগ্রাম। সে সময় মমতার সহযোগী শুভেন্দু অধিকারীই এবার ছিলেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেয়া শুভেন্দুকে অবশ্য মমতা হারাতে পারেননি।

সাবেক কংগ্রেস নেতা শুভেন্দু ২০০৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে পরের বছর নন্দীগ্রামে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ওই এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নিলে রুখে দাঁড়ান তিনি। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্ব দেয়া শুভেন্দু সে সময় মমতার ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠেন এবং পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতার ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করেন। এরপর তৃণমূল থেকে লোকসভার সদস্য এবং পরে বিধানসভার সদস্য নির্বাচত হয়েছিলেন তিনি। পরে ২০১৬ সালে তিনি মমতার সরকারে পরিবহনমন্ত্রী হন এবং গতবছর মন্ত্রিত্ব ও দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। অর্থাৎ মমতাকে শুধু বিজেপির সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি। তাকে নিজদল ছেড়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। সেই লড়াই বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন মমতা।  

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়