ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শ্রীলঙ্কায় হার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্বলতা

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ৫ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:১৪, ৫ মে ২০২১
শ্রীলঙ্কায় হার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্বলতা

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ২য় টেস্টে বাংলাদেশের হার এড়ানো যায়নি। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে যখন ৩৭ রানে শেষ ৭ উইকেট হারায় তখন এ টেস্ট জেতার আশা শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪০০ রান চেজ করে জেতার রেকর্ড মাত্র ৪টি। তাই অলৌকিক কিছু আর ঘটেনি। অথচ শুনেছিলাম আমরা শ্রীলঙ্কায় জয়ের জন্যই গিয়েছি। জেতার কৌশল হিসেবে খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু ফ্ল্যাট ব্যাটিং উইকেটে এ রকম একটি খর্ব শক্তির দলের কাছে পরাজয় আমাদের দু’দশকের টেস্ট স্ট্যাটাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আবেগ এবং আক্ষেপ সমান গতিতে চলে। নিজের সামান্য ক্রিকেট অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে কিছু লিখতে চাই।

প্রথমত, আমাদের দেশে যেসব ক্রিকেট মাঠ রয়েছে সেগুলোর উইকেটে বৈচিত্র্য নেই। সব জায়গায় পিচ প্রায় ব্যাটিং সহায়ক। কিছুটা স্পিন কাজ করে। এ কথা সত্য যে, উপমহাদেশে কিছু ব্যতিক্রম বাদে (ওয়াংখেরে, লাহোর ইত্যাদি) সব পিচই অনেক বেশি স্পিন বান্ধব। কিন্তু দেশের বাইরে খেলতে গেলে স্পিনিং, ঘাসযুক্ত, বাউন্সি ইত্যাদি উইকেটে খেলতে হয় যা আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করে।

যেমন: ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার পিচ আমাদের মতো নয়; পিচে অনেক বাউন্স। যে কারণে সেসব দেশে দৃষ্টিনন্দন কাভার ড্রাইভ কমই দেখা যায়। আমাদের দেশে ৮-১০ হাত খুড়লেই মাটির নিচে থেকে পানি বের হবে, তাই পিচে বাউন্স পাওয়া সহজ নয়। সে বাস্তবতায় একটা গুড লেন্থ বল ইংল্যান্ডের পিচে ব্যাটসম্যানের জন্য যতটুকু উঠে আসবে, এদেশে ততটুকু উঠবে না। ফলে ব্যাটিংটা অনেক সহজ হয়ে যায়। বিষয়টি নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্যও সত্য। ফলে আমাদের উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা দেশের বাইরে কাজে লাগে না।

যদি মিরপুর মাঠে কোনো বল হাঁটু সমান ওঠে তাহলে ইংল্যান্ডে নিশ্চিতভাবে তা কোমর সমান আসবে। আপনি কীভাবে খেলবেন? আমরা কোমর সমান বল সাধারণত গ্ল্যান্স করি, যেখানে সাধারণত ডিপ-ফাইন লেগ কিংবা ফাইন লেগ থেকে এক রান হয়। কিন্তু পুল বা হুক খেলতে পারলে চার বা ছয় রান হতো। আমরা যেসব পিচে খেলে অভ্যস্ত সেখানে পুল বা হুক শট শেখা খুব কঠিন। ফলে, বলপ্রতি ৩ থেকে ৫ রানের মতো পার্থক্য হয়ে যায় এবং টেকনিক্যালি আমরা পিছিয়ে যাই। 

দ্বিতীয়ত, পিচের বিষয়টি বাদ দিলেও আমাদের ব্যাটসম্যানদের টেকনিক্যালি আরও দুর্বলতা রয়েছে। আগে এমনও দেখা গিয়েছে যে, ব্যাটসম্যান রান নেবার সময় এক হাতে ব্যাট নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। অথচ দু’হাতে ব্যাট নিয়েই রান নিতে হয়। একজন ব্যাটসম্যান তখনই দুর্দান্ত যখন তিনি উইকেটের চারপাশে খেলতে পারেন। বাংলাদেশ দলে এমন কোনো ব্যাটসম্যান নেই যিনি চারপাশে শট খেলতে পারেন। সাকিবের কথাই যদি বলেন তাহলে দেখবেন যে স্কয়ার অফ ডি উইকেট- এ তিনি যতটুকু পারদর্শী সোজা ব্যাটে ততটা নন। তাই পয়েন্ট বা ডিপ পয়েন্ট কিংবা ঘালিতে ফিল্ডার রেখে তাকে সহজেই তালুবন্দি করা যেতে পারে। এ দুর্বলতাটুকু বিপক্ষ দলের বোলারদের জন্য যথেষ্ট। সৌম্য সরকারকেও উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে; যার অফ-সাইডে বল খেলার সামর্থ্য নেই। তামিমও আগে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে শট খেলতেন, যদিও এখন এ প্রবণতা থেকে তিনি বের হয়ে এসেছেন।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ দল নিয়ে যে বিষয়টি দর্শক হিসেবে আমাদের কষ্ট দিয়েছে তা হলো দল নির্বাচন এবং বিশেষ করে সেরা একাদশ নির্বাচনে অনেক সময় পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়া হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, পেশাদারিত্ব হলো টাকার বিনিময়ে ভালো খেলা। আপনি বেশি রান করলে কিংবা উইকেট বেশি পেলে টাকা বেশি পাবেন; এটাই পেশাদারিত্ব। যেহেতু খুব উঁচু মানের ঘরোয়া লীগ নেই (একটি কারণ হলো বিদেশি খেলোয়াড় নেই) তাই খেলোয়াড় বাছাই ও সেরা একাদশ নির্বাচন করা সহজ নয়। কাউকে দেশের হয়ে খেলতে দেবার জন্য যতভাবে পরীক্ষা করা দরকার সে প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করা জরুরি।

চতুর্থত, তিন ফরম্যাটের ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং এর কৌশল একেবারেই আলাদা। টেস্টে যদি ২০০ রান এবং বিপক্ষ দলকে অলআউট করার মানসিকতা না থাকে তবে কোনোভাবেই তা আন্তর্জাতিক কৌশলের সাথে যায় না। ওয়ানডেতে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিঙ্গেল-ডাবল নিয়েও খেলতে হয় আবার চার-ছক্কাও মারতে হয়। টেকনিক্যালি দুর্বল হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় না। তাই সিঙ্গেল-ডাবল নেয়া যেমন শিখতে হয় তেমনি চার-ছক্কা মারাও শিখতে হয়। টি-২০ তে ছক্কা মারার জন্য যে টেকনিক আর শক্তি দরকার তা বোধকরি আমাদের কারোরই নেই। আমরা একজন ঈশান কিশান (ভারতীয় উইকেট কিপার ও ব্যাটসম্যান, যিনি ভারতীয় দলেও নিয়মিত নন) এর মতো খেলোয়াড়ও তৈরি করতে পারিনি!

আন্তর্জাতিক বোলিং এ-ও অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়। ইদানিং স্লোয়ার বল করা শিল্পে পরিণত হয়েছে। অথচ মুস্তাফিজ ছাড়া আর কেউ পারদর্শী নন। পার্শ্ববর্তী ভারতের বোলাররা যেভাবে গড়ে ১৪০ কি.মি. গতিতে বল করেছেন সেখানে আমাদের গড় গতি ১২৫ কি.মি.। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বোলারদের বিরুদ্ধে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের খেলা অনেক সহজ হয়ে যায়। আমরা এখনও উইকেটে সরাসরি বল করাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। এ যুগের ব্যাটসম্যানদের উইকেট-টু-উইকেট বল করা মানে বল ডিপ-মিড উইকেট বা মিড-অন দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। তাই বাউন্স, স্লোয়ার, অফস্ট্যাম্পের বাইরে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে লেগ স্ট্যাম্পের বাইরেও খুব পরিকল্পনা করে বোলিং করার কৌশল শিখতে হবে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে আমরা একজন ডানহাতি লেগ-স্পিনারের অভাব ভোগ করছি; বাম-হাতি অফ-ব্রেক বোলার দিয়ে আর কতদিন?

ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভালো ফিল্ডার একজন ভালো ব্যাটসম্যানের চেয়েও বেশি কার্যকর। একজন ভালো ব্যাটসম্যান সবসময় ৫০-১০০ রান করতে পারবেন না কিন্তু একজন ভালো ফিল্ডার হাফ চান্সের ক্যাচগুলো নিতে পারবেন কিংবা ২০-৩০ রান আটকাতে পারবেন। এছাড়া কিপিংয়ে মুশফিকের কারণে আমাদের ব্যর্থতার অনেক নজির রয়েছে।

পঞ্চমত, আমাদের সাবেক কোচ এডি বাড়লোর হাত ধরে বয়সভিত্তিক যে ক্রিকেট কাঠামো গড়ে উঠেছে তা যথাযথভাবে কার্যকর নয়। ১৭ বা ১৯ বছর বয়সী খেলোয়াড়গণের অনেক বিক্ষিপ্ত সাফল্য থাকলেও পরবর্তীতে কেন তারা আর ভালো করছে না সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আইপিএলকে ষ্ট্যান্ডার্ড ধরলেও দেখা যায় সেখানে আফগানিস্থানের মতো একটি দেশের তিনজন ক্রিকেটার সম্পৃক্ত রয়েছেন। 

ষষ্ঠত, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিকেটারদের কমিটমেন্টে ঘাটতি রয়েছে। ব্যাটসম্যানরা ৫০ রানকে ১০০ তে কিংবা একজন বোলার মার খেয়ে নিজেকে নতুনভাবে খেলায় নিয়ে আসতে পারছেন না। ব্যক্তিগত পারফরমেন্সগুলো দেখলে অন্তত তাই মনে হয়!

সপ্তমত, বড় দলগুলোর বিপক্ষে ব্যাটসম্যান বা বোলার হিসেবে ম্যাচ উইনার কি কেউ আছেন? বিগত দিনে ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে অনেকগুলো ম্যাচ আমাদের খুব স্বল্প ব্যবধানে হারতে হয়েছে। খেলায় চাপ নেবার জন্য যে মানসিক শক্তি দরকার তা অনেকাংশেই আমাদের নেই।

ক্রিকেট খেলায় অধিনায়কের গুরুত্ব অনেক। কারণ খেলার প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে একজন অধিনায়কের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে সবার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনা। অধিনায়ক হিসেবে কাউকে বিবেচনা করতে হলে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে- তার পারফরম্যান্স, ক্রিকেট সেন্স ও ব্যক্তিত্ব। আমার মনে হয় সব ফরম্যাটে আলাদা অধিনায়ক নির্বাচনের সময় এখনও আমাদের আসেনি। টেস্টের মতো এরকম গুরুত্বপূর্ণ ফরম্যাটে মুমিনুল কোনোভাবেই দলনেতা হতে পারেন না। যার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে কোনো ক্যারিশমা নেই তিনি দলকে কীভাবে উজ্জীবিত করবেন?

আমাদের দলের উপর মিডিয়ার প্রভাবও রয়েছে। অনেক পত্রিকা রয়েছে যারা সরাসরি বিশেষ খেলোয়াড়দের সমর্থন দিয়ে থাকে যা কার্যত দল নির্বাচন ও মাঠেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম। দল ধারাবাহিক ব্যর্থ হলে আমাদের কোচিং স্টাফদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। 

ক্রিকেটার কেন ভুলে যান যে ১৬ কোটি মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নের জায়গাটুকু নষ্ট করে দেবার অধিকার তাদের নেই। ক্রিকেটারদের মনে রাখতে হবে তারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। একমাত্র পেশাদার মানসিকতাই তাদের জনগণের কাঠগড়া থেকে মুক্তি দিতে পারে। বোর্ড, টিম ম্যানেজমেন্ট ও খেলোয়াড়গণ অনেক বেশি পেশাদার মনোভাব দেখালে সার্বিকভাবে আমাদের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। 


লেখক: একজন ক্রিকেটপ্রেমী
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়