ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উত্তাল কলকাতার রাজনীতি

পৃথ্বীশ ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ১৮ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:৪৭, ১৮ মে ২০২১
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উত্তাল কলকাতার রাজনীতি

দুয়ারে শমন। তবু রাজনীতি রয়েছে রাজনীতিতেই!

করোনা আতঙ্কে কাঁপছে গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গও। একের পর এক মৃত্যু হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছে লাগাতার। তবু তারই মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত চরমে। লকডাউনের মধ্যেও যার জেরে রণক্ষেত্র নিজাম প্যালেস; যা করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলবে বলেই আশঙ্কা।

সোমবার সকালে আচমকা নারদা-কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হয় রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। গ্রেপ্তার হন বিধায়ক মদন মিত্র। গ্রেপ্তার হন একদা মহানাগরিক শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল হয়ে যায় বঙ্গ রাজনীতি। কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় সিবিআই-এর দপ্তর নিজাম প্যালেস চত্বর।

বিষয়টি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। পৌনে এগারোটা নাগাদ তিনি সেখানে পৌঁছান। ধর্নায় বসে তাঁকেও গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা নিজাম প্যালেসের গেট টপকে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি চার্জ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। অনেকে আহতও হন। তখন শুরু হয় ইটবৃষ্টি। বোতল থেকে চটি- বাদ থাকে না কোনো কিছু। যার লক্ষ্য অতি অবশ্যই কেন্দ্রীয় বাহিনী। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় নিজাম প্যালেস।

প্রাথমিকভাবে ঠিক ছিল যে, এদিনই আদালতে পেশ করা হবে ধৃত রাজনীতিবিদদের। কিন্তু বাইরে তুমুল বিক্ষোভের মধ্যে আদালতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় দেখে শুরু হয় ভার্চুয়াল শুনানি। প্রকাশ্যে কোভিড পরিস্থিতির কারণেই ভার্চুয়াল শুনানি হওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েন রাজ্যপাল ধনখড়ও। একের পর এক টুইটে বিদ্ধ করতে থাকেন রাজ্য সরকারকে। পাল্টা হুঙ্কার ছাড়ে তৃণমূলও।

মজার বিষয় হলো, ভার্চুয়াল শুনানির ক্ষেত্রে করোনার প্রসঙ্গ তোলা হলেও, এদিন যে সামাজিক দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে জমায়েতের ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে নীরবতা সর্বত্র। এ যেন যাত্রাপালার সেই সুর- ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না...!

করোনার বিরুদ্ধে লড়াই যখন তুঙ্গে, তখন কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের এই আবহ স্বাভাবিকভাবেই জন্ম দিচ্ছে অনেক প্রশ্নের। নারদা কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে এসেছিল ২০১৬ সালে। সেই পুরনো কাসুন্দি এতদিন পরে তুলে আনা হলো কেন? ভোটের ফল বিরুদ্ধে গিয়েছে বলেই কি শুরু থেকেই তৃণমূলকে চাপে ফেলার কৌশল?

কারা ঘুষ নিয়েছে, কারা ঘুষ নেওয়ার পক্ষে কী যুক্তি সাজিয়েছে, সেই প্রসঙ্গই যে এখন অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, ঘুষ নেওয়াদের কেউ কেউ এখন দল পাল্টে সসম্মানে বিজেপিতেই আছেন। যদিও তাঁদের ডাকা বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। ধৃতদের মধ্যে তিনজনই তৃণমূলের। আর শোভন চট্টোপাধ্যায় বিজেপিতে গিয়েও সুবিধা করতে পারেননি। তিনি এবার তৃণমূলে ফেরার কথা ভাবছেন বলেই খবর। অর্থাৎ যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারদা মামলার কারণে, তাঁরা কেউ বিজেপির গুড বুকে নেই।

প্রশ্ন উঠছে যে, নারদা কাণ্ডে ঘুষ নেওয়াই যদি অপরাধ হয়, তাহলে মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন কোন গর্বে? তাঁদেরও তো গ্রেপ্তার হওয়া উচিত। তা হয়নি বলেই উঠছে রাজনীতির প্রসঙ্গ।

বিজেপি প্রচারপর্বে বারবার ‘ডাবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব খাড়া করেছিল। বলেছিল, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ভালো হলে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে চড়চড় করে এগিয়ে যাবে বাংলা। ঘটবে শিল্পের বিকাশ। যদিও দেশের যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি সরকার, সেখানে সর্বত্র এমন উন্নতি নজরে পড়েনি। ফলে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারকে ফাঁকা প্রতিশ্রুতি হিসেবেই দেখেছে বাংলার মানুষ। বরং ভয় পেয়েছে বিজেপি এলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি না বিগড়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ না নষ্ট হয়। যার জেরেই তৃণমূলকে আরও একবার সরকারে এনেছে মানুষ। এর নেপথ্যে তৃণমূলের ভালো কিছু কাজ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিজেপি এলে কী হবে সেই আশঙ্কাও। কারণ দুর্নীতিতে তৃণমূল যে কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই, তা বাংলার মানুষের কাছে পরিষ্কার। কিন্তু তারপরও মমতার সরকারের একটা জনদরদী মুখ রয়েছে।

উল্টোদিকে, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা চিহ্নিত হয়েছেন ‘বর্গী’ হিসেবে। বাংলাকে জিততে প্রাণান্ত করেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে মোদী-শাহ জুটিকে। সেই জ্বালাই হয়তো এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে এভাবে মেটাতে চাইছেন তাঁরা। তাই বলে করোনা আটকাতে যখন লকডাউন চালু করতে হয়েছে, গরিব মানুষদের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন নতুনভাবে দাবার বোর্ডে সিবিআই নামের বোড়ের চাল দেওয়া কি সত্যিই উচিত? এখন তো সব ভেদাভেদ ভুলে, বিবাদ তুচ্ছ করে মানুষের সেবায় প্রাণ উৎসর্গ করার সময়। ভোটের আগে মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়ে কত আশ্বাস, কত হাহাকার! এখনই তো তার সময়। কবির কথায়, মানুষ বড় কাঁদছে, মানুষ বড় অসহায়, তুমি তার পাশে দাঁড়াও...।

তা না করে রাজ্যময় নতুন করে হিংসা-প্রতিহিংসার আগুনে উসকানি দেওয়ার সত্যিই কি যৌক্তিকতা রয়েছে? বিক্ষোভ, জমায়েত, আন্দোলন যে করোনার আঁতুড়ঘরে পরিণত হতে পারে, এই সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির কি এতই অভাব? নাকি এটাই রাজনীতির দাবা খেলার নিয়ম? কে জানে!

ভোটে খেলা হওয়ার অঙ্গীকার ছিল। ভোটপর্ব মিটেছে। খেলার ফল বেরিয়েও গিয়েছে। এবার শুরু নতুন খেলা। অর্থাৎ খেলা এখনও শেষ হয়নি- পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!

তাতে দু’চারটে তুচ্ছ মানুষ মরলেই বা কী? কে কবে ক্ষমতায় বসে মানুষের কথা ভেবেছে!

লেখক: সাংবাদিক, কলকাতা থেকে 

পড়ুন: আমাকেও গ্রেপ্তার করুন: মমতা

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়