ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা বেড়েছে

শেখ আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ২৯ মে ২০২১  
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা বেড়েছে

বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা ও দুর্যোগ পূর্বাভাসে সক্ষমতা বেড়েছে। আবহাওয়াজনিত যে কোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সদা তৎপর বাংলাদেশের আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর ক্ষেত্রেও এ কথার সত্যতা পাওয়া গেছে। যদিও এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত দেশে ইয়াসের আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এখন ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তা মোকাবিলার পদক্ষেপ নেয়ার সময়।

এ ধরনের দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পেতে কয়েক দিন সময় লেগে যায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বৃদ্ধি পায়। নিম্নাঞ্চলের চর প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, নোয়াখালীর মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি ইয়াসে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।

এবার জেনে নেয়া যাক ঘূর্ণিঝড় কী এবং কীভাবে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেন? ঘূর্ণিঝড় হলো ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া। যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এ ধরনের ঝড়-বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে দুর্যোগের সৃষ্টি হয় বটে। কিন্তু এটা আবহাওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে।

গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০টি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যে অল্পসংখ্যক উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে। বিজ্ঞানীদের মতে, ঘূর্ণিঝড় সাধারণত দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর এবং ১৪০ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের পূর্বে অবস্থিত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ব্যতীত সব উঞ্চমণ্ডলীয় সাগর বক্ষে সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো ১. উত্তর ভারত মহাসাগর ২. দক্ষিণ পশ্চিম ভারত মহাসাগর ৩. উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ৪. উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চল ৫. উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চল ৬. দক্ষিণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়ার এলাকা। বিভিন্ন সাগর বক্ষে ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন নাম দেয়া হয়।  

বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগরের খুব নিকটবর্তী এবং পাশাপাশি অংশ। অন্যান্য সাগর বক্ষে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কিছুটা কম হলেও এর চারপাশের দেশগুলোতে জীবন ও সম্পদ হানির পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ফানেল আকৃতির। সমুদ্রের সোপান অগভীর, উচ্চ জ্যোতির্জোয়ার এবং উপকূলের চারপাশে রয়েছে সমতল নিন্মাঞ্চল। বাংলাদেশ ও আশপাশ এলাকায় উঞ্চমণ্ডলীয় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় প্রধানত সৃষ্টি হয় প্রাক-বর্ষা, মধ্য-বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে।

ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি সৃষ্টি হয় সমুদ্রের বিশালতায়। সমুদ্রের বিশাল জলরাশিই ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির সিংহভাগ সরবরাহ করে। আর সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হলে ঘূর্ণিঝড় পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য আরো অনেকগুলো অনুকূল শর্তের প্রয়োজন হয়। এগুলোর মধ্যে ‘কোরিওলিস বল’ বায়ুমণ্ডলের অস্থিরতা, বাতাসের উল্লম্ব কুন্তন, বায়ুমণ্ডলের গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বায়ুমণ্ডলের নিন্মস্তরে কেন্দ্রমুখী প্রবাহ এবং উচ্চস্তরে কেন্দ্রবিমুখী প্রবাহ ইত্যাদি অন্যতম। ‘কোরিওলিস বল’ হচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত বল বা অক্ষাংশের ফাংশন। বিষুব রেখায় এর মান শূন্য এবং পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে এর মান সবচেয়ে বেশি। উত্তর গোলার্ধে এ বল চলন্ত বস্তুর গতিপথের ডানদিকে বিক্ষেপ ঘটায়। এ বলের মান যতো বেশি হবে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে বায়ুর ঘূর্ণন ক্ষমতা ততো বেশি হবে। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য এর সংকট মান হচ্ছে অক্ষাংশের পরিমাণে ৫ ডিগ্রি উত্তর বা দক্ষিণ। অর্থাৎ বিষুব রেখার ৫ ডিগ্রির মধ্যে কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে না। উল্লেখ্য, বায়ুমণ্ডলের অস্থিরতা মাপা হয় ভূপৃষ্ট এবং ৬ কিলোমিটার উচ্চতা পরিমাণ স্থানের সুপ্ত তাপমাত্রার পার্থক্য দ্বারা। এই পার্থক্য ১.৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। বাতাসের উল্লম্ব কুন্তন পরিমাপ করা হয় ১.৫ কিলোমিটার ও ১২ কিলোমিটার উচ্চতার বায়ুবেগের আনুভূমিক (পুর্ব-পশ্চিম) উপাংশের পার্থক্য দ্বারা। এই পার্থক্য ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটারের কম হতে পারে। এর মান শূন্যের যত কাছাকাছি হবে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও ততো বেশি হবে।

ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি, তীব্রতা এবং এর গতিপথ নির্ণয় করা হয় ভূপৃষ্ট থেকে বেশ উচ্চ বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন প্রকার আবহাওয়া উপাত্ত অঙ্কন, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে। বিভিন্ন সময়ে আবহাওয়ার নানাবিধ উপাদানের বিভিন্ন প্রকার পর্যবেক্ষণের পাঠ নেয়া হয়। যেমন পর্যবেক্ষণগুলোর নাম হচ্ছে: ১। সিনোপটিক পর্যবেক্ষণ ২। পাইলট বেলুন পর্যবেক্ষণ ৩। উইন্ড সাউন্ড পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।

এই পর্যবেক্ষণগুলোর সময়সূচি বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত। যা বিশ্বের সমস্ত দেশের আবহাওয়া বিভাগ অনুসরণ করে। এসব পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রাপ্ত আবহাওয়ার উপাদানগুলো চতুর্মাত্রিক বিশ্লেষণের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের কাঠামো ও অবস্থান নিরুপণ করা সম্ভব হয়। এগুলো ছাড়াও রয়েছে রাডার পর্যবেক্ষণ। ঘূর্ণিঝড় যখন রাডারের আওতার মধ্যে এসে পড়ে তখন দিন রাত ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং এই পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ নির্ণয় করা হয়। এই গতিপথ ও আবহাওয়ার উপাত্ত বিশ্লেষণ দ্বারা প্রাপ্ত গতিপথ তুলনা করে সঠিক গতিপথের পূর্বাভাস দেয়া হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে বর্তমানে ৪০০ কিলোমিটার রেঞ্চ বিশিষ্ট তিনটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার যুক্ত রাডার রয়েছে। এই রাডারের সাহায্যে ঘূর্ণিঝড়ের মেঘরাশি কেমন করে আবর্তিত হচ্ছে, মেঘরাশির উচ্চতা এবং এর গতি কোন দিকে তা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। রাডারের চিত্র থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ বাতাসের গতি এবং ঘূর্ণিঝড়ের গতি নির্ণয় করা সম্ভব।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকেই এমন ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করে আসছে বাংলার মানুষ। বারবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে উপকূলবর্তী মানুষের। তবে সচেতনতা, সু ব্যবস্থাপনার অভাবে একযুগ আগে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জীবন ও সম্পদ হানির পরিমাণ ছিলো অনেক বেশি। দিন বদলে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় শেখ হাসিনা সরকার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সফলতা এসেছে মূলত আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ থেকে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষেত্রেও আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। 

 
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়