ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাজেট কি করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কথা বলছে? 

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৪ জুন ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৬, ৪ জুন ২০২১
বাজেট কি করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কথা বলছে? 

করোনাসৃষ্ট মহামারিতে ধুঁকছে পৃথিবী। একই ঢেউয়ের আঘাত এসে লেগেছে দেশে। সেই আঘাত থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও মুক্ত নয়। দশ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতা বন্ধ আছে। অনেকে বেকার হয়ে গেছেন এবং অনেকে বাধ্য হয়ে সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন পেশায় নিযুক্ত রয়েছেন। কেজি স্কুল ও কারিগরিসহ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গছে। কিন্তু বাজেটে এসব খাতে ব্যয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রস্তাব রাখা হয়নি।

বেসরকারি কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর আরোপ করা হয়েছে। তাদের আয়ের ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। দেশে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। মান যাতে অর্জিত হয় সেজন্য অত্যাধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রচলন করার জন্য বাজেট প্রয়োজন। অথচ এই বাজেটে বিষয়টির উল্লেখ নেই। রয়েছে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে করা নেওয়ার একটি ঘোষণা। এটি শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণের কৌশল বলেই আমার মনে হয়েছে। 

২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর এটি ছিল ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। মাধ্যমিকে করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব। একইভাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২২ কোটি টাকা। শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয় শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে। এটি অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু এর বাইরেও আরো অনেক খাত রয়েছে। সেগুলোও কম জরুরি নয়। যেমন শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিষয়ভিত্তিক, পেডাগজিক্যাল এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ।  এখন প্রশিক্ষণ হচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, নায়েম এবং সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রশিক্ষণে বাজেট আছে। সুতরাং খরচ করতে বাধা নেই। কিন্তু এটি কী কাজে লাগল বা না-লাগল, কার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, কীভাবে তাদের বাছাই করতে হবে এগুলো কিছুই দেখা হয় না। শুধু বাজেট আছে বলেই খরচ করতে হবে কেন? তারপরও শিক্ষার বাজেট থেকে যায়।

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজ শিক্ষকদের এবং বিসিএস নন-ক্যাডার এবং সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা যখন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন তারা কিন্তু শিক্ষার্থীই, একজন শিক্ষক হিসেবে তাদের জানা প্রয়োজন শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক এই আধুনিক যুগে কেমন হওয়া প্রয়োজন, কোন বিষয় কীভাবে পড়াতে হবে, শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, দুরন্ত শিক্ষার্থীদের কীভাবে ম্যানেজ করতে হবে  ইত্যাদি। অথচ এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ না দিয়েই তাদের সরাসরি শ্রেণিকক্ষে প্রেরণ করা হয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ যাতে যথাসময়ে সম্পন্ন হয়, এখানে যাতে বাজেট ঘাটতি না থাকে সে বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে। আমরা জানি যে, হাজার হাজার শিক্ষক আছেন যাদের কোনো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হয়নি। আবার অনেক শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন তাদেরকেও প্রশিক্ষণে ডাকা হয়। আবার প্রশিক্ষণ শুধু টিটিসি বা নায়েমে ডেকেই দিতে হবে সেটিও নয়। কারণ শিক্ষকগণ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এসে যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাদের শ্রেণিকক্ষগুলোর অবস্থা সেখান থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। ফলে অধিকাংশ প্রশিক্ষণই কাজে লাগে না। এটির দিকেও নজর দিতে হবে।

করোনার কারণে বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুশ্রমও বাড়ছে। শিক্ষায় চলমান এই বিপর্যয় রোধকল্পে শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। উপরন্তু ইউনেস্কো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ শিক্ষাখাতে ব্যয় করার জন্য যে সুপারিশ আছে বাংলাদেশের তা মেনে চলা উচিত। আগামী ২-৩ বছর মেয়াদি একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ এর ফলে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ১১-১২ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটি যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে রাখা প্রয়োজন যা প্রাথমিক স্তরের জন্য ১:৩০, নিন্ম মাধ্যমিক, মাধ্যমকি ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য ১:৪০ এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১:২৫ এর বেশি নয়। এসব বিষয়ের প্রতিফলন বাজেটে ঘটেনি।

তবে, এমপিও কাঠামোর মধ্য না থাকা বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর সংশোধিত (২০২০-২০২১) বাজেটে অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য ৪০ কোটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ভবন মেরামত ও সংস্কার খাতে ৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় এসব অঙ্ক যদিও অপ্রতুল, তারপরেও ভালো পদক্ষেপ বলতে হবে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নতুন এমপিও’র বাজেট রাখা হয়েছে। এটি করতে  হবে। কারণ এতে দেশের সম্পদের একটা ভারসাম্য রক্ষিত হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণ হয়। এখানে গ্রামীণ শিক্ষিত বেকারদের চাকরি হয়, গ্রামীণ অর্ধ-সচ্ছল ও অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়। 

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়