ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কমিটির সুপারিশ নারীর প্রতি অবমাননা

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ১৯ জুন ২০২১   আপডেট: ২১:০৪, ১৯ জুন ২০২১
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কমিটির সুপারিশ নারীর প্রতি অবমাননা

সম্প্রতি জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে মৃত মুক্তিযোদ্ধার গার্ড অব অনারে সরকারের পক্ষে মহিলা কর্মকর্তা অংশ নিতে পারবে না, বিকল্প হিসেবে পুরুষ কর্মকর্তা সেখানে অংশ নেবেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ চেতনার ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশ চলে সংবিধান মোতাবেক। সংবিধানে যেখানে ধর্ম, বর্ণ ও নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, বৈষম্য অস্বীকার করা হয়েছে সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কীভাবে এ ধরনের সুপারিশ করে আমার বোধগম্য নয়। এই সুপারিশ শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ-বিরোধীই নয়, সংবিধান-বিরোধীও বটে।

সংবিধানের ১০ নং অনুচ্ছেদে আছে, “জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।” সংবিধানে যেখানে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে সেখানে গার্ড অব অনার থেকে মহিলাদের বিরত রাখা সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি নয় কি?

অনুচ্ছেদ ২৮ (১) এ আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।” সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নারী হওয়ার কারণে, অমুসলিম হওয়ার কারণে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত করতে পারে না, করলে তা হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অনুচ্ছে ২৮ (২) এ আছে, “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবে।” এ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাহলে নারী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে একজন পুরুষ কর্মকর্তাকে মৃত মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিলে কি নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকে? নারী কর্মকর্তাকে বসিয়ে রেখে তার বিকল্প হিসেবে অন্য একজন পুরুষকে দিয়ে সে কাজ করালে সেই নারীকে কি হেয় করা হয় না? এটা কি নারী-পুরুষের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য নয়?

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ ২৭ অনুচ্ছেদেরও পরিপন্থি।  এ ধরনের সুপারিশে মৌলবাদীরা উৎসাহিত হবে। এখানে আরেকটি বিষয় রয়েছে- গার্ড অব অনার এক বিষয়, জানাযা আরেক বিষয়। মহিলা জানাযায় অংশ নিতে পারেন না বলে গার্ড অব অনারে অংশ নিতে পারবেন না এটা যুক্তি হতে পারে না। মহিলারা জানাযায় অংশ নিতে পারবেন না এমন কথা পবিত্র কোরআন শরিফে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এটা জানি, মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়তে পারেন, ইমামতিও করতে পারেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়লে পেছনের কাতারে পড়বে। আর ইমামতি করলে কাতারের মধ্যখানে দাঁড়াবে। ১৫০০ বছর আগে আরব দেশ ছিল অসভ্য-অমার্জিত দেশ। সেখানে মেয়েদের তেমন কোনো অধিকার ছিল না বললেই চলে। সে অবস্থায় সে যুগে রাসুল (সা.) মেয়েদের যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন তা অতুলনীয়।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের কথা উহ্য রেখে বলা যায়- সংবিধানে নারীকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে সে সংবিধান বহাল থাকতে সে অধিকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করে কোন আইনের ভিত্তিতে? তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে এ সুপারিশ করেছে। ধর্মে কি গার্ড অব অনারের কথা আছে? ধর্মে আছে জানাযা, নামাজের কথা। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসে তারা শাস্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে- কীভাবে নারী-পুরুষের ভেদ তৈরি করা যায়! আর এসব দেখে মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘খালেদ’ কবিতার কথা। কবি লিখেছেন:
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনো বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা হাদিস চষে।’

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য যেখানে নারীদের ধাপে ধাপে মুক্তি দিচ্ছে, স্বাধীনতা দিচ্ছে, অধিকার দিচ্ছে, সেখানে এই কমিটি নারীর অধিকার সংকোচনে সুপারিশ করেছে ভাবতেই অবাক লাগে! অথচ দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সর্বস্তরে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে নিযুক্ত করতে না-পারলে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই সংবিধানে নারীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সংসদ সদস্য শাহজাহান খানের মতো লোকও গার্ড অব অনার থেকে নারীকে বাদ দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছেন। অথচ তিনি এক সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রগতিশীল নেতা ছিলেন। যার ধ্যান-জ্ঞান ছিল মানুষকে ধর্মের বেড়াজাল থেকে বের করে আনা। আর আজ তিনিই মৌলবাদের আদর্শ ধারণ করছেন।

আজকাল বিভিন্ন দেশ উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিচ্ছে। হিন্দু ধর্মে নারী পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেত না। ভারত ২০০৫ সালে আইন করে পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। এটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়। সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়ে সমান উত্তরাধিকার নীতি বহাল রাখেন। অন্য ধর্মগুলো যেখানে পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারীকে কোনো অধিকার দেয়নি, সেখানে ইসলাম ধর্ম নারীকে ভাইয়ের অর্ধেক অধিকার দিয়েছে। আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারী শাসকও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে একটা ভালো এবং মানবিক আইন করে গেছেন। তা হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন। ঐ আইনের পূর্বে দাদা জীবিত থাকতে পিতা মারা গেলে মৃত ব্যক্তির সন্তানেরা অর্থাৎ ঐ দাদার নাতি-নাতনিরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। সম্পত্তির মালিক হতো চাচারা। আর এতিমরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতো। বিষয়টি আইয়ুব খানকে ব্যথিত করে। তিনি আইন করে সম্পত্তিতে এতিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেন। এ নিয়ে মৌলবাদীরা প্রতিবাদ করে বলেছিল-  আইয়ুব খান কি আল্লাহর চেয়ে বেশি বুঝে? আল্লাহ যেখানে দেয়নি, সেখানে আইয়ুব খান দেওয়ার কে? কিন্তু আইয়ুব তাতে কর্ণপাত করেননি।

তাই সংসদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে আবেদন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসুন। বঙ্গবন্ধু একটা সাম্প্রদায়িক জাতিকে অসাম্প্রদায়িক জাতিতে রূপান্তর এবং তার ভিত্তিতে একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংবিধান তৈরি করতে পারলে আপনেরা পারবেন না কেন? নেশামুক্তকে নেশাযুক্ত করা সহজ। কিন্তু নেশাযুক্তকে নেশামুক্ত করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু সেই কঠিন অসাধ্য কাজটিই করেছেন। অথচ আমরা তা ধরে রাখতে পারলাম না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? 

তাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কমিটির সুপারিশ শুধু নারীর প্রতি অবমাননা নয়, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সর্বোপরী সংবিধানকে অবমাননা। বৈষম্য সৃষ্টিতে নয়, বৈষম্য অবসানে অবদান রাখুন। আমাদের তালেবান না বানিয়ে বাঙালিই থাকতে দিন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়