ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

লকডাউনের এই চক্র থেকে মুক্তির উপায় কী?

কামরুল আহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩২, ২৬ জুন ২০২১  
লকডাউনের এই চক্র থেকে মুক্তির উপায় কী?

‘লকডাউন’ শব্দটি প্রকৃত অর্থ হারিয়ে বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে অদ্ভুত এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। লকডাউনের নির্দেশনা জারি হওয়ামাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় নানারকম কথাবার্তা। কারো সংশয়, কারো ভয়, কারো বিরক্তি, কারো-বা হাস্যপরিহাস। গত ১৪ এপ্রিল যখন কঠোর লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি হলো তখন আমি রাইজিংবিডিতে লিখেছিলাম: ‘সংশয়-শঙ্কার কঠোর লকডাউন’ শিরোনামে।

এর আগে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউনের নির্দেশনা জারি থাকলেও অনেকে মানছিল না। লকডাউনের মধ্যেই বইমেলা হলো। ১৪ এপ্রিল লকডাউনে ব্যাংক এবং শিল্পকারখানা খোলা ছিল। বন্ধ ছিল শুধু গণপরিবহন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও লোকজন অবাধে চলাচল করেছে। ‘জরুরি চলাচল পাস’ আরেক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। কোথায় গেল সেই মুভমেন্ট পাস সেই খেয়ালও আর কারো নেই! গত রোজার ঈদে আমরা দেখলাম একেবারে ‘ছেড়াবেড়া’ অবস্থা। বাস বন্ধ বলে লোকজন মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, এমন কি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে গাদাগাদি করে ঢাকা ছেড়েছেন। ফেরিগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। রোজার ঈদের পর থেকে করোনার সংক্রমণ সারাদেশে হু হু করে বাড়তে থাকে। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের সঙ্গে এবার যুক্ত হয় ভারতীয় ধরন।  

ভারতে যখন ভিন্ন রকমের করোনার নতুন একটি ধরন চিহ্নিত হলো তখন থেকেই আমরা আতঙ্কে ছিলাম এটি বাংলাদেশে ঢুকলে বিপদ। সীমান্ত অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু লাভ হলো না। মাত্র দেড় মাসে বাংলাদেশের ৪০টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। অবস্থা বুঝে বিভিন্ন জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পাশাপাশি ঢাকা বিছিন্ন রাখা হয়েছিল কয়েক দিন ধরে। এখন আগামী সোমবার থেকে আবার ৭ দিনের কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। 

শুরুতেই বলেছি ‘লকডাউন’ শব্দটি তার মাত্রা হারিয়েছে। এখন জোর বোঝাতে শব্দটির সঙ্গে বাড়তি বিশেষণ দরকার হচ্ছে, ‘কঠিন-কঠোর লকডাউন’। তাতেও কাজ হবে কিনা সন্দেহ! আগাম কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে হঠাৎ করেই আসছে লকডাউনের ঘোষণা। এদিকে ঘোষণা আসামাত্র ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়ে। ঢাকার বাইরের লোকজনও ঢাকা আসার তোড়জোড় শুরু করে। স্বল্প আয়ের লোকজন কী খেয়ে বাঁচবে এ নিয়ে শুরু হয় জল্পনাকল্পনা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি। বৈশ্বিক এই মহামারির প্রকোপ উন্নত দেশগুলোতে কমে এলেও স্বল্পোন্নত ঘনবসতির দেশগুলোতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। জাতীয় পরামর্শক কমিটি এ জন্য সম্পূর্ণ শাটডাউনের সুপারিশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তেই যে কোনো ধরনের ঘোষণার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। তৈরি থাকতে হবে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার।

গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এতটুকু বুঝেছি যে করোনার সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে আরো বেশ কয়েক বছর। টিকা আবিষ্কার হলেও সেই টিকার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে অন্য দেশের ওপর। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমাদের ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। শিক্ষাক্ষেত্রগুলো এখনো স্থবির। লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর গৃহবন্দি। অসংখ্য তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অনেক সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ বন্ধ। সরকারি হিসেবে এক-দেড় বছর হলেও একজন ব্যক্তির জীবনে এটা খুব মূল্যবান সময়। এর বিপক্ষ হয়তো অনেক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু কী করার আছে?

কী করার আছে? কথাটি আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কদিন পরপর এমন লকডাউন দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ফল হবে না। লকডাউন উঠিয়ে দিলেই আবার সংক্রমণ বাড়বে। আর লকডাউন যদি দিতেই হয় ১৪ দিন বা ২১ দিনের জন্য সব বন্ধ করে দিয়ে সংক্রমণের মাত্রা একেবারে শূন্যে নামিয়ে এনে তারপরই সব চালু করতে হবে। কারণ একজনও যদি সংক্রমিত থাকে তাহলে তার থেকে একশজনে পৌঁছে যাবে চোখের পলকেই। কিন্তু ১৪ দিনের জন্য সব বন্ধ রাখা প্রায় অসম্ভব। দিনে এনে দিনে খায় যারা তাদের কথা ভেবেই এটা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি সাহায্যেও এটা সম্ভব হচ্ছে না। সাহায্য সবার হাতে একই সময়ে পৌঁছুচ্ছে না। প্রথম দিকে স্বল্পআয়ের মানুষদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও সাহায্য করেছেন। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না। কারণ এখন সবাই জানেন পরিস্থিতির শিকার যে কোনে সময় যে কেউ হতে পারেন। তাছাড়া যারা সাহায্য করবেন তাদেরও যথেষ্ট আয় থাকতে হবে। এর উপরে আছে সরকারের পরিকল্পনার অভাব। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে পুরো বিষয়টা লেজেগোবরে হয়ে গেছে। 

এখন ৭ দিনের লকডাউনে কী হবে? রোগীর সংখ্যা হয়তো সাময়িক কিছু কমবে, লকডাউন উঠিয়ে দিলেই আবার বাড়বে- এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি। এই ৭ দিনের পর হয়তো সরকার আরো ৭ দিন লকডাউন দেবে, কিন্তু তখন কি লোকজন ঘরে রাখা সম্ভব হবে? মহল্লার মুদি দোকানগুলো খোলা থাকবে। বাজারের নাম করে লোকজন রাস্তায় ভিড় করবে। অবশ্য কী কী লকডাউনের আওতার বাইরে থাকবে এ নিয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। ব্যাংকগুলো কি খোলা থাকবে? পোশাক কারখানাগুলো? সব বন্ধ করে দিলেও সরকার পোশাক কারখানা বন্ধ করতে পারে না তাও তো আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। তাহলে নাকি পোশাক কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবেন না? কোনো একটি প্রতিষ্ঠান যখন কোনো কারণ দর্শানোর অজুহাতে খোলা রাখে তখন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও নৈতিক সমর্থন পেয়ে যায় খোলা রাখার। এভাবে পুরো পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়। 

প্রতিবারই আমরা শেষ সীমায় এসে পৌঁছাই, আর ভাবি এবার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যা ছিল তাই-ই আছে। আমরা যেন একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে দেশের সব মানুষই এখন হতাশ। করোনা আমাদের শারীরিকভাবে যতটা না প্রভাব ফেলছে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যে। সবাই সারাক্ষণ একটা উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। খেটে খাওয়া মানুষের একটা যুক্তি এর মধ্যেই খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ‘আমাগো তো করোনা হয় না, আমাগো বরং কাজ-কাম বন্ধ কইরা দিলেই না খাইয়া মরার যোগাড় হয়।’ এই যুক্তির ওপর কারো কারো এমনই বিশ্বাস যে লকডাউন তাদের কাছে একটা বিপত্তি। সুযোগ পেলেই তারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। লকডাউনের সময়ও তাই মহল্লাগুলোতে দেখা যায় ঈদের মতো ভিড়। 

সামনে আবার ঈদ আসছে। আর চার সপ্তাহ পরেই কোরবানি ঈদ। গরু-ছাগলের হাট কি বসবে এবার? যুক্তি আসবে অনেক গরিব সারাবছর গরু-ছাগল নিয়ে অপেক্ষা করেছেন, না বিক্রি করতে পারলে না খেয়ে মরবেন। তা ছাড়া সম্মিলনের আবেগ তো আছেই। দুসপ্তাহ লকডাউন দিয়ে আবার সব খুলে দিলে কী ফল হবে? অথচ গত রোজার ঈদেই সরকার এই সুযোগটা নিতে পারত। ঈদে সবাই বাড়ি গেছে, ঈদের পরপরই ১৪ দিনের জন্য সব বন্ধ করে দিলে সংক্রমণ অনেক নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। ঈদের একদিন পরেই সব খুলে দেওয়ার দরকার ছিল না। 

অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়ে গেছে করোনা নিয়ে সরকার আর জনগণ এখন মুখোমুখি। সরকার দেয় জনগণের দোষ, জনগণ দেয় সরকারের দোষ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজো বলেছেন, “স্বাস্থ্যবিধি না মেনে একগুঁয়েমী এবং অবাধ চলাচল পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। তাই এ অবস্থায় ঘরে ঘরে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।”

কিন্তু, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার মতো সচেতন শিক্ষা ও বাস্তব অবস্থা আমাদের বেশির ভাগ মানুষেরই নেই। বিশাল ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়ের স্বল্প শিক্ষিত একটি দেশের জন্য নানা দিক দিয়েই এটা অত্যন্ত কঠিন। কেউ কারো ওপর দোষ চাপিয়েও আমরা এ থেকে মুক্তি পাবো না। যে চক্রে আমরা পড়েছি তার থেকে মুক্তির জন্য সবাইকে সব কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে। খুব শীঘ্রই যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে না দেয়া যায় তাহলে ভয়াবহ ব্যাপার হবে। যেভাবেই হোক অতি দ্রুত আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে। তার জন্য যা করণীয় সরকার ও জনগণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি একই নৌকায়, নৌকা একদিকে কাৎ হলেও সবাই ডুববে।  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়