ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তালেবানদের কাছে কাবুলের পরাজয় সময়ের ব্যাপার

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৩, ১৯ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৫:০৭, ১৯ জুলাই ২০২১
তালেবানদের কাছে কাবুলের পরাজয় সময়ের ব্যাপার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, চলতি বছর ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো- উদ্দেশ্যটি কী?

৯/১১-এ আল-কায়দা যে ভয়াবহ আক্রমণ করে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে মার্কিন অহঙ্কার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তার প্রতিশোধ নিতেই তারা সেখানে গিয়েছিল। তখন আল-কায়দা প্রধান ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে সামরিক সদস্য দিয়ে তালেবানদের উদ্বুদ্ধ করেছিল আল কায়দা। শুধু তারা একাই নয়, সকল মিত্রদের নিয়ে এই আন্দোলন তখন তারা জোরদার করে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ১৯৮০ সালে মস্কোতে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় এবং এই ক্রীড়ায় রাজনীতি প্রবেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সে সময় বাংলাদেশসহ বহুদেশ মস্কো অলিম্পিক বয়কট করে।

যাই হোক, সেগুলো আজ অতীত। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো ভিন্ন  দেশ আফগানিস্তানকে বশীভূত করতে পারেনি। ইংরেজরা যখন চরম ক্ষমতা নিয়ে এই উপমহাদেশে তখনও তারা আফগানিস্তান দখল করার জন্য একাধিকবার হামলা চালিয়ে চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়। এরপরই সেখানে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তালেবান শাসন। সে এক ভয়াবহ শাসন! তারা নারী শিক্ষা একেবারে বন্ধ করে দেয়। খেলাধুলা বন্ধ করে দেয়। সেখানে একটা গোরা এবং নিষ্ঠুর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আফগানিস্তানেই আল-কায়দার প্রধান কেন্দ্র ছিল। বিন লাদিন এখানকার তোরাবোরা পাহাড়ে প্রধান অফিস প্রতিষ্ঠিত করে বলে শোনা যায়। এরপর এলো ভয়াবহ ৯/১১। মহাশক্তি মার্কিনিদের দর্পচুর্ণ হয়ে গেল। সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন বুশ। তিনি সময় নষ্ট না করে ন্যাটো এবং অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন আফগানিস্তানের উপর। প্রচণ্ড লড়াই শেষে কাবুলে তালেবান সরকারের পতন হয়। তছনছ হয়ে যায় আল-কায়দার ঘাটি। কিন্তু বিন লাদেনকে ধরা সম্ভব হয়েনি তখন। এর এক যুগেরও পরে পাকিস্তানের সীমানার ভেতর বিন লাদেন মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হন। অতএব মার্কিনিদের মূল লক্ষ্য আল-কায়দা এবং বিন লাদেনকে নিঃশেষ করে দেয়া হয়।

বাইডেন এখন বলেছেন যে, তারা দেশ গঠন করে দেয়ার জন্য আফগানিস্তান যাননি। অথচ বিশ বছর তারা কাবুলে থাকলেন সহযোগীদের নিয়ে। সেখানে সরকার গঠন করা হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসনকাজ পরিচালনার জন্য। কিন্তু দুভার্গ্যজনক যে, আজ পর্যন্ত কোনো কাবুল সরকার দেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। আফগানিস্তানের বিশাল অংশ সব সময় তালেবানের দখলে ছিল।

আফগানিস্তানের রক্ত বিদেশীদের অবস্থান সহ্য করে না। যে কারণে  আমরা মাঝে মাঝে দেখেছি, আফগান সরকারি সেনারা মিত্র সৈন্যকে হত্যা করছে। আর একটি বড় কথা, তথাকথিত জনগণের সরকার আফগানদের নিকট কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তো ছিলই। সবচেয়ে বড় কথা দুর্নীতি। বাইডেন আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আফগানদের সমস্যা নিজেদের, তাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। অর্থাৎ কে সরকার হবে নিজেদের ঠিক করতে হবে। এ কথা থেকে বোঝা যায় আফগান সরকারের উপর তাদের ভরসা নেই। বাইডেন এখন তার ছেলেদের এভাবে ভিনদেশে প্রাণ দিতে রাজী নন। ফলে তিনি সৈন্য ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

ওদিকে আমেরিকান সৈন্য ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালেবানরা যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং অধিক পরিমাণ দখল নিতে শুরু করেছে। আফগান তাজিক সীমান্তের দুই তৃতীয়াংশ সীমানা তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে-একথা রাশিয়া স্বীকার করেছে। তালেবানরা যেমন সংঘবদ্ধ এবং দক্ষতা এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করে, তাতে আশঙ্কা হয়- খুব বেশিদিন সময় নেবে না তারা কাবুল দখল করতে। এখন দেখার বিষয় একটাই- তালেবান সরকার কি পূর্বের সরকারের ন্যায় হিংস্র, গোরা এবং ধর্মান্ধ হবে নাকি কিছুটা মডারেট হবে?

আফগানিস্তান এখন সার্কের সদস্য। সেদিক বিবেচনা করে কিছুটা সংশোধিত হবে কিনা সেটাই এখন দেখার সময়। এত কম সময়ের মধ্যে দেশটি খেলাধুলায় উন্নতি করেছে। খেলতে দেবে, নাকি বন্ধ করে দেবে- দেখতে হবে সেটাও। তালেবানরা ভয়াবহভাবে নারী অগ্রগতির বিরোধী। তাদের দর্শন হলো নারীকে পণ্য হিসেবে গৃহবন্দি করে রাখা। প্রয়োজন হলে বের করে এনে ব্যবহার করা। শত বাধার মধ্যেও আফগানিস্তানে নার-নীরারা কিছুটা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়েছে। কিন্তু ভয় হয়, নারীর ক্ষেত্রে তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গীর এতটুকু পরিবর্তন হয়েছে কি?

কাবুল তালেবানরা পাবে- এটা দেখতে বোধহয় বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা এই প্রত্যাশা করি যে তারা কিছুটা মডারেট এবং মানবিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কেননা ইতোমধ্যে প্রায় দুই যুগ পার হয়েছে। রাজনীতির পরিবর্তন হয়েছে। তালেবানরা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেনি, তারা আরবের দু’একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমে আলোচনা করেছে। রাশিয়া এবং ইরানের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। এতে তাদের দর্শনে কিছুটা পরিবর্তন আসার কথা।

তবে একটি কথা না বললেই নয়, ভবিষ্যতে যদি তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে; এটি বহুলাংশে নির্ভর করবে পাকিস্তানের উপর। যদিও আল-কায়দা তাড়ানোর ব্যাপারে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলরা তালেবানদের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিল এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। সোজা কথায় বলা যায় যে, তালেবানদের জন্মলগ্ন থেকে নার্সিং করে আসছে পাকিস্তানের জেনারেলরা। আশা করবো, তারা তালেবানদের মডারেট করতে সাহায্য করবে। 


লেখক: সহকারী সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুজিবনগর সরকার 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়