ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আফগানিস্তানে শেষ হাসি কি তালেবানের

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ১৬ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৫, ১৭ আগস্ট ২০২১
আফগানিস্তানে শেষ হাসি কি তালেবানের

তালেবানের পক্ষে কথা বলা মূলত আমেরিকার পক্ষে কথা বলা। তালেবানকে সমর্থন দেয়া মানে ইউরোপিয় ইউনিয়নকে সমর্থন দেয়া। যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করে ১৯৮৯ সালে নজিবুল্লাহ সরকার গঠন করে আফগানিস্তানে তখন তালেবান গঠনে পুরো সমর্থন ছিল আজকের আমেরিকার। ফলে ১৯৯২ সালে দুর্বল নজিবুল্লাহর পতন ঘটিয়ে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন মোল্লা মুহম্মদ ওমর। তিনি ছিলেন কৌশলী এবং একইসঙ্গে আধ্যাত্মিক নেতা। জনগণের পক্ষে কাজ করতে শুরু করলে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করেন ‘আমিরুল মোমেনিন’ হিসেবে।

২০০১ সালে মার্কিন সরকারের মনে পড়ল আফগানিস্তান হলো আমাদের (আর্নিং সোর্স) অর্থ আয়ের পথ। সুতরাং দখলে নিতে হবে। কারণ, আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজ সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে আনুমানিক ১৪০০-র অধিক বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিছু তথ্য অনুযায়ী সেটা সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ইত্যাদি আছে খনিজ পদার্থের তালিকায়। সেই সঙ্গে রয়েছে উচ্চ মানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্ন-পাথরের মজুদ। আরইই সামরিক শিল্পের জন্য খুব প্রয়োজনীয় পদার্থ। এটি ট্যাঙ্ক নেভিগেশন সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র গাইডেন্সিং সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উপাদান, স্যাটেলাইট এবং বিভিন্ন সামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আফগানিস্তানে যে পরিমাণ আরইই মজুদ রয়েছে তা বিশ্বে আরইই সরবরাহ বিষয়ক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে।

কিন্তু বেঁকে বসেন তালেবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমর। কিছুতেই মার্কিন তাঁবেদারি এখানে সহ্য করা হবে না স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি। শুরু হয় জর্জ ডব্লিউ বুশের যৌথ আক্রমণ। বিপর্যস্ত হয় মোল্লা ওমরের কাবুল কান্দাহার তথা আফগানিস্তান। তালেবানের কৌশল মুখ থুবড়ে পড়ে মার্কিন ভারি অস্ত্রের সামনে। দিন বদলায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বদলায়, কেবল বদলায় না আফগানবাসীর ভাগ্য। পালাক্রমে মার্কিন সাম্রাজের ক্ষমতায় আসেন বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সর্বশেষ জো বাইডেন।

জো বাইডেনের আমেরিকা ২০২১ সালে বুঝতে পারে, আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ ফুরিয়ে এসেছে। স্বার্থ যখন শেষ তখন পুরনো বন্ধুদের আবার আমন্ত্রণ জানাই। মাঝে স্বার্থ উদ্ধারে দুজন আফগানির সহযোগিতা পেয়েছিল আমেরিকা- একজন হামিদ কারজাই (২০০৪-২০১৪), অন্যজন আশরাফ ঘানি (২০১৪-২০২১)। এরা ছিল বাহাদুর বিড়াল! মার্কিনিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারলেও দেশ থেকে সরাতে পারে না তাদের,  পারে না নিশ্চিহ্ন করতে তালেবান নামক সংগঠনটিও। কারণ, তালেবানি আগুনের প্রজ্জ্বলনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উত্তাপ অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান। তাহলে আফগানিস্তানে প্রকৃত বিজয় হয়েছে কার?


আমেরিকা তালেবানের কাছ থেকে ২০ বছরের জন্য যে আফগানিস্তান নিয়েছিল; কিছুটা জোরপূর্বক, কাজ শেষে তারা সেই তালেবানের কাছেই আফগানিস্তান ফেরত দিয়ে গেছে। চর্মচক্ষু দিয়ে পৃথিবীর মানুষ দেখছে, মার্কিনিদের বিশাল পরাজয় ঘটেছে আফগানিস্তানে। বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা, সেখানে পরাজিত হয়েছে মূলত তালেবান ও আফগানিস্তান।

কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে, নারী ও যুবতীদের তালিকার প্রসঙ্গ টানছেন। বলছেন এই রাষ্ট্র ইসলামি ইজম দ্বারা পরিচালিত হবে। ব্যাপারটি বাস্তবতার বিপরীত। আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকা কীভাবে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে কৌশলে সেটি এখানে বিবেচ্য। শুরু থেকে তারা নিজেদের আড়ালে নিয়েছে, তুরস্কের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। অথচ আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক দা-কুমড়া। কিছুদিন পূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৯১৫ সালে অটোমান তুর্কি বাহিনীর হাতে লক্ষ লক্ষ আর্মেনিয়ানের নিহত হওয়াকে ‘গণহত্যা’ বলায় দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছিল। তুরস্ককে দেখতে না পারার অসংখ্য কারণের মধ্যে আরো কারণ, এরদোয়ানের মস্কোপ্রীতি, তেহরানপ্রীতি, বেইজিংপ্রীতি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাশানপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখতে না পারার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে ইলেক্টোরাল ভোটের কারচুপি। যেখানে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল মনে করছে অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক। ফলে সে সময় আমেরিকার ক্ষমতায় বসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হঠাৎ সেই তুরস্ককে কেনো দেয়া হবে আফগান যুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্রটির হেফাজতের দায়িত্ব!

শুধু তাই নয়, ভয় দেখিয়ে মাথা গরম করে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশীদের। বলছে, আসছে তালেবান/ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশকে বানাবে নতুন আফগানিস্তান। কিন্তু সবাই আমেরিকার ভয়ে বা স্লোগানে কান দেবে না। চীন দেখল, তাদের কান যথাস্থানে আছে। তারা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করল দুর্বল তালেবানকে। আগে আংশিক করলেও মে মাস থেকে পুরো সমর্থন দিয়ে আসছে তারা। এবার আমেরিকা আরেকটু নিরাপদ আড়ালে গিয়ে বলল, কাবুলে যতজন কূটনৈতিক আছে সবাই চলে এসো। তারা চলে গেল। আর তালেবান দখল করে নিলো আফগানের রাজধানী শহর কাবুল।

রাশিয়া কী বললো? কাবুল ছাড়বে না রাশান দূত। তালেবানদের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে কাশেম সোলাইমানীর অবদান কম নয়। কাশেম সোলাইমানীর দেশ ইরানকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে। সৌদি ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকারকে সমর্থন করলেও আন্তর্জাতিক সমস্যায় সম্পূর্ণ চুপ হয়ে আছে মোহাম্মদ সালমান গং। কাতার হলো তালেবানের হেড কোয়ার্টার। তারা প্রকাশ্যে কাজ করেই দায়িত্ব শেষ মনে করছে না। বরং অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিয়ে পাশে থাকছে পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রটি। ভারত গত বিশ বছর পাকিস্তানকে নিয়ে মাথা ঘামালেও, তাদের জন্য নতুন অস্বস্তির নাম তালেবান। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি কাবুলে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেও চুপ থাকছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।


আফগান অধিপতি আশরাফ ঘানি দেখতে পেলেন, পৃথিবীর কোথাও তার অংশের সূর্যটুকু নেই। অন্ধকারের ভেতরে ডাক দিলেন তালেবান নেতা আবদুল গনি বারবানিকে। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের ডেকে। দেশ ছাড়লেন প্রেসিডেন্ট ঘানি। এবার নেমে এলো যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিদের জীবনে কঠিন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হাডুডুডু খেলবে তুরস্ক। কারণ, আফগান সবসময় ভাবে, পৃথিবীর সবাই তাদের ক্ষতি করলেও তুরস্ক করবে না। এদিকে প্রস্তুত চীন। আফিমের দেশে ভারতের উত্থান তার সহ্য হবে কেন? তাই চীন পৃথিবীকে তোয়াক্কা না করেই ঢুকে পড়েছে কাবুলে। রাশিয়ার মোড়লীপনা তো থাকছেই।

শঙ্কার বিষয় হলো, আফগানের অবস্থা সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতোই হতে পারে! কারণ, সেখানে তুরস্ক, রাশিয়া, চীনপন্থীরা আছে এবং তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে সত্য। মিথ্যা হলে সেখানে হবে হুকুমতের সরকারের নব উত্থান। নিজেদের শক্তিশালী ভাববে পাকিস্তান। ভয়ে থাকবে ভারত-ইসরায়েল। যেখানে আমেরিকা, সেখানে একক প্রতিপক্ষ থাকত রাশিয়া। কিন্তু বিগত কয়েক বছর রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন।

মার্কিনিরা এই মুহূর্তে ভাবছে, এক গুলিতে সব শেষ। সময় এখন আরাম করার। এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা ছিল তাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ও মানবিক মূল্যবোধকে তিরস্কার করা। একইভাবে ২০২১ সালে এসে রাষ্ট্রকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে পলায়ন হলো চূড়ান্ত সামরিক ব্যর্থতার পরিচয়। যদিও অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিজয় হয়েছে আমেরিকার। দৃশ্যগত বিজয় পেয়েছে আফগানিস্তান। রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে হারানো সিংহাসন বিজয় করেছে তালেবান। যে কোনো যুদ্ধে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেমন পরাজয় থাকে, থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিজয়। আফগানিস্তানে সেই বিজয় হয়েছে কোন পক্ষের?

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়