ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু কি বিপ্লবী ছিলেন

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১  
বঙ্গবন্ধু কি বিপ্লবী ছিলেন

বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল- বঙ্গবন্ধু কি বিপ্লবী?

পশ্চিমবঙ্গে তখন বামপন্থীধারার উৎকর্ষকাল। নকশালরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। সিপিএম চেষ্টা করছে ভোটের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জোরদার করতে। এমন অবস্থায় পূর্ব বাংলায় বাঙালিদের বিশাল বিজয় পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। বাংলাদেশে তবে কি বিপ্লব ঘটে গেল? মুজিব কি তবে বিপ্লবী?
অথচ আওয়ামী লীগকে তারা বুর্জোয়া সংগঠন বলে এসেছে এতোকাল। তাদের নেতৃত্বেই একটি সশস্ত্র সংগ্রাম হয়ে গেল। বাঙালি একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড পেল। বামপন্থীদের একাংশ একে সাম্রাজ্যবাদীদের খেলার অংশ বলে উপস্থাপন করতে লাগল। এ প্রবণতা এ পারের বামপন্থীদের মধ্যেও দেখা যায়। কিন্তু সাধারণের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল, বামপন্থীরাও বৃহৎ শক্তির প্রতিভূস্বরূপ রাজনীতির মাঠে খেলছে।

সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তি নিয়ে যদি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া যেত, তাহলে বামপন্থীদের এতোকাল অপেক্ষা করা লাগত না। ১৯২০ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান সীমান্তে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। কমিউনিস্টদের একের পর এক থিউরি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে। কিন্তু কই, তারা তো সফলকাম হলো না? বরং পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৫ হাজার কমিউনিস্টকে সরকারের কাছে বন্ড দিয়ে কলকাতা চলে আসতে হলো। তিন বছরের মাথায় রণদিভে পলিসি ভুল প্রমাণিত হলো।

এমনই এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত লিখলেন: ‘বামপন্থীরা বা বিপ্লববাদীরা তাঁকে কখনো বিপ্লবী বলে স্বীকার করবেন না। অথচ বাংলাদেশে যদি কোন বিপ্লব হয়ে থাকে, তার নেতা যদি বিপ্লবী না হয়, তবে বুঝি বিপ্লবটাকেই অস্বীকার করতে হয়, বলতে হয়- সব ঝুটা হ্যায়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাত্ত্বিক বিপ্লবীদের মতবিরোধ বুঝতে হলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের দলের নেতাদের বিরোধিতার মুখে লাহোরে বিরোধীদলের সভায় ছয়দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এই ছয়দফা প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সামরিক জান্তা ভালোভাবে নেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী ভাবধারার বামপন্থীরাও ‘বাঙালি উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে রচিত’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করে। এদের নেতৃত্বে ছিল ন্যাপ (ভাসানী)। তারা যেসব পয়েন্টে ছয়দফা প্রত্যাখ্যান করেছিল তা হলো-
এক. ছয়দফা প্রস্তাব বুর্জোয়া গণতন্ত্রবাদের বাঙালি সংস্করণ। বাঙালি উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণি ছাড়া এই প্রস্তাবের পিছনে শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি শ্রেণির কোনো সমর্থন নেই, থাকতেও পারে না।
দুই. ছয়দফা প্রস্তাব আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত ও সমর্থনপুষ্ট।
তিন. ছয়দফা প্রস্তাব শ্রেণি চেতনা, শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগঠন বিরোধী। কাজেই সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রবিরোধী।
চার. ছয়দফা প্রস্তাব প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থে প্রণীত।

এ তো গেলো চীনপন্থীদের কথা। রাশিয়াপন্থীরা কীভাবে নিয়েছিল ছয়দফাকে? এরা অবশ্য এক কথায় এ প্রস্তাব খারিজ করে দেয়নি। তবে তারাও দেখল এখানে কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তাই তারা ছয়দফার সঙ্গে আরো পাঁচদফা জুড়ে দিয়ে এগারো দফা উত্থাপন করল। 
এদিকে আইয়ুব খান সরকার ছয়দফার আন্দোলনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে রুখবার চেষ্টা শুরু করলো। ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হলো প্রতিরোধ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি হয়ে উঠল এক নম্বর ইস্যু। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লাগল। এমন অবস্থায় চীনও আইয়ুবের উপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছিল না। এর প্রভাব পড়ল আমাদের বামপন্থীদের উপর। যে মওলানা ভাসানীকে আইয়ুব খানের প্রিয়ভাজন হিসেবে সবাই জানত, আইয়ুববিরোধী জোট ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি বা ডাকে দুজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অংশ নেননি- জুলফিকার আলি ভুট্টো আর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সেই ভাসানীই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞা থেকে বুঝেছিলেন, জনতার আবেগের সঙ্গে একাত্ম না হলে কালের স্রোতে হারিয়ে যাবেন। বামপন্থীরা তাদের হিসেবের ভুল ধরতে পারল। ছফদফা হয়ে উঠল বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা জাতির মুক্তির সনদ।

আইয়ুব খানের পতন হলো। তার আস্থাভাজন জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে তিনি ক্ষমতা দিয়ে গেলেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এই নির্বাচন ঘিরে বামপন্থীদের মধ্যে শুরু হলো মতদ্বৈত। অনেকেই সামরিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে নির্বাচন বয়কটের কথা বললেন। কেউ কেউ বললেন পুজিঁপতি আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে প্রভাবিত করে তাতে জনগণের প্রকৃত মতামত পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবের কারণে তারা তাদের ভালোমন্দ বুঝে উঠতে পারে না। তারা পুঁজিপতিদের ফাঁদে পা দেয়। সে ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিপ্লবই মুক্তির একমাত্র উপায়। 
যাহোক, বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ আস্থা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষে উপর। তিনি নির্বাচনের পথে অগ্রসর হন।

মওলানা ভাসানী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নাটক শুরু করে পাকিস্তান সামরিক সরকার। তখন বঙ্গবন্ধুর জনযুদ্ধ আহ্বানের নৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। এমনকি ৭ মার্চ লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে যদি তিনি যুদ্ধের আহ্বান দিতেন, তখনই একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হতো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমিত লোকবল দিয়ে তা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হটকারি কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি বিশ্বের কাছে আক্রমণকারী হিসেবে পরিচিত হতে চাননি। তিনি রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন।

২৫ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনী ক্র্যাক ডাউন করবে, সেটা ঢাকার অনেক মানুষই জানত। বঙ্গবন্ধুর কাছেও সে খবর গিয়েছিল। তিনি চাইলে বিশ্বের বড়ো বড়ো বিপ্লবীদের মতো গা ঢাকা দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা করতে পারতেন। কিন্তু তার মনে দুটো শঙ্কা ছিল। এক. বাঙালির ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ নিতে পারে পাকিস্তান সরকার। দুই. এর আগেও বঙ্গবন্ধুকে ‘ছল করে’ হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাকে যে গোয়েন্দারা নিবিড় নজরে রাখেনি সে কথা কে বলতে পারে? হয়ত পালাবার চেষ্টা করলে হত্যা করে সহযোদ্ধাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেবে। বাঙালির আন্দোলনকে দ্বিধান্বিত করে ফেলবে। তাই তিনি তার গৃহেই অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে বিশ্ববিবেকের কাছে নিন্দার পাত্র হয়ে উঠেছিল।

সময় বুঝতে পারা, সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিরল প্রতিভা আমরা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেখতে পাই। অনেক সার্থক বিপ্লবীর মধ্যেও তা দেখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিপ্লব কোনো বৃহৎ শক্তির সমর্থনে সফল হওয়ার পর সেই শক্তির আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাই মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে পা রেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রশ্ন করেন, কখন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে? তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ভারত তার সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে এক নৈতিক পথপরিক্রমণের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিলেন। তাই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যা করেও কেউ পাকিস্তানের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া কিংবা কনফেডারেশন সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়ার সাহস করেনি। 
এখানেই বঙ্গবন্ধু সার্থক। অনেক বিপ্লবী তাঁর কাছে ম্লান। 

সূত্র 
১. মুজিববাদ, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, শ্রাবণ প্রকাশনী
২. গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব, অমিতাভ গুপ্ত, অনুপম প্রকাশনী
৩. বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়, জয়দীপ দে, কবি প্রকাশনী

 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়