ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কিশোরগঞ্জ হাওরে পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে 

মো. আশরাফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১  
কিশোরগঞ্জ হাওরে পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে 

চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশির এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য হলো হাওর। ঋতুভেদে হাওরের রূপ ও সৌন্দর্য বদলায়। হাওরে শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলো ওড়া মেঠোপথ, রুপালি নদী থাকে। বর্ষায় হাওরের পানি ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলের মাঠ। হাওর তখন উত্তাল সাগরের রূপ ধারণ করে। বর্ষায় সাগর সদৃশ হাওরগুলোর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে তখন অনেকটাই দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, বাংলাদেশে হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ১৩৩, সিলেটে ৪৩, হবিগঞ্জে ৩৮, মৌলভীবাজারে ৪, কিশোরগঞ্জে ১২২, নেত্রকোনায় ৮০ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। বাংলাদেশে শনির হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর বিখ্যাত।

বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি হাওরাঞ্চল। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকেরা হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। ২০১৪ সালে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরাঞ্চল ঘুরে হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খী’র দেশ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে দলে দলে অতিথি পাখি হাওরাঞ্চলে উড়ে আসে। অতিথি পাখির কলরবে হাওরাঞ্চল তখন মুখরিত হয়ে ওঠে। হাওরে তখন রঙ-বেরঙের পালতোলা নৌকা ভেসে বেড়ায়। রাতে হাওরের পানিতে নৌকাগুলোর মাছ ধরার দৃশ্য হাওরের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান। হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সংগীত ভাণ্ডার। প্রাচীন আখড়া, মসজিদ-মন্দিরের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে হাওরের সুপ্রাচীন ও গৌরবময় অতীতের স্মৃতিচিহ্ন।

হাওর-বাওর আর অসংখ্য নদ-নদী নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা গঠিত। এক সময় মানুষ কিশোরগঞ্জে হাওরের নাম শুনলেই আঁতকে উঠতো। এখন হাজার হাজার মানুষ সেই হাওরে বেড়াতে যায়। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে চিরায়ত রূপের বাহারে নতুন যুক্ত হয়েছে নবনির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক। হাওরের বুক চিরে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন এই সড়কের কল্যাণে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের রূপ ও সৌন্দর্য অন্যান্য হাওরের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিশোরগঞ্জের হাওরে বছরে সাধারণত ছয় মাস পানি থাকে। বর্ষাকালে পুরো হাওর পানিতে কানায় কানায় ভরে ওঠে। হাওরকে তখন সাগরের মতো মনে হয়। গলা ডুবিয়ে থাকা হিজলের সারি সারি গাছ সবার নজর কাড়ে। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন কিংবা বরুণ গাছ দেখলে মন ভরে যায়।

কিশোরগঞ্জ হাওরের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধ থেকে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্ষায় কিশোরগঞ্জ হাওরের বেশ কয়েকটি স্থানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। তাদের মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়াঘাট, বালিখলা, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক, মিঠামইনের কামালপুরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়ি, নিকলী বেরিবাঁধ এবং তাড়াইলের হিজলজানি উল্লেখযোগ্য। জলে ভাসা কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে যোগোযোগের জন্য সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন নতুন সড়ক। বাংলাদেশের কোথাও হাওরের মাঝখানে এমন দীর্ঘতম সড়ক নেই। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে হাওরের এই অল-ওয়েদার রোড। এ সড়কটি নির্মাণের ফলে গোটা হাওরের দৃশ্যপটে এসেছে আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

এই সড়ক হাওরবাসীর জীবনমানে এনেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। পর্যটকদের সমাগমের ফলে এই অঞ্চলে দরিদ্র বেকার তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অনেক তরুণ মোটরবাইক, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চালিয়ে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে প্রতিদিন অর্থ উপার্জন করছেন। এক শ্রেণির পেশাদার মাঝি নৌকা, ট্রলার ও স্পিড বোটের মাধ্যমে পর্যটকদের পরিভ্রমণ করিয়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনের ব্যয় আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে।

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলগুলোতে পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আবাসন, খাওয়া-দাওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হাওর এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। হাওরে পর্যটন টাওয়ার স্থাপন করা যেতে পারে। হাওর অঞ্চলের পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা এখন সময়ের দাবি। হাওরে পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপন, খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ বিনোদনের সুব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি।

এজন্য বিস্তীর্ণ হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে অত্যাধুনিক হোটেল গড়ে তুলতে হবে। নৌ-বিহারের জন্য ছোট-বড় মাঝারি আকারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নৌযান চালু করতে হবে। হাওর এলাকায় পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি করলে হাওরবাসীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

কিশোরগঞ্জের হাওরে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পর্যটনের এ সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। কিশোরগঞ্জ হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে যদি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয় পাশাপাশি পর্যটকদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায় তাহলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো একদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে এই হাওরাঞ্চল।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়