ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

এলএনজি’র দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সঙ্কট

সালেক সুফী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১  
এলএনজি’র দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সঙ্কট

বিশ্ব বাজারে গ্যাস এলএনজির (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আংশিক এলএনজি নির্ভর বাংলাদেশও জ্বালানি সংকটে পড়েছে। ইতিমধ্যে সিএনজি স্টেশনগুলোতে  সান্ধ্যকালীন সময়ে ৪ ঘন্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে। শিল্প কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসই থেকে ৩ পিএসই হয়ে যাচ্ছে। তথ্য জানাচ্ছে বস্ত্র খাতের উৎপাদন ক্ষমতার ৭০% ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বিশ্ব বাজারে এলএনজির দ্রুত মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এখন তাহলে কী করবে বাংলাদেশ? 

বিশ্ব জ্বালানি বাজারে গ্যাস এবং এলএনজি মূল্য হু হু করে বাড়ছে। এরই মাঝে উত্তর গোলার্ধে শুরু হচ্ছে শীত কাল। উপরন্ত অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম দুটি এলএনজি উৎপাদন কেন্দ্র পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় শেভ্রন মালিকানাধীন গর্জন এলএনজি প্লান্টে কারিগরি ত্রুটি এবং কুইন্সল্যান্ডের গোল্ডস্টোনের তিনটি এলএনজি প্লান্ট ফিড গ্যাসের অভাবে উৎপাদন সীমাবদ্ধতার কারণে রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও রপ্তানি কমিয়ে এনেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়াও ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্য অচিরেই ১০০ মার্কিন ডলার ছুঁয়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বাংলাদেশে এখন গ্যাস সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে।  গ্রীস্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা এমনিতেই বেড়ে যায়।  তদুপরি করোনা সময়ের অবসানে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইলে সামগ্রীর চাহিদা বিপুল পরিমান বৃদ্ধি পাবার কারণে গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইলে কারখানায় কাজ চলছে দিনরাত প্রায় চব্বিশ ঘন্টা। গ্যাস ভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল­ান্টগুলোয় গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গাছে। বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে   সান্ধ্যকালীন পিক আওয়ারে চাহিদা ১৫০০ এমএমসিএফডি ( মিলিয়ন কিউবিক ফিট পার ডে) ছাড়িয়ে যাচ্ছে।  অথচ বর্তমান অবস্থায় ১১৫০ -১২০০ এমএমসিএফডির বেশি সরবরাহ সম্ভব না হওয়ায় প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। 

বাংলাদেশের গ্যাস ক্ষেত্র সমূহ থেকে দ্রুত নিম্নগামী উৎপাদন হচ্ছে ২৪৫০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে আমদানি হচ্ছে ৫৫০ এমএমসিএফডি।  জিটিসিএল নিয়ন্ত্রণাধীন গ্যাস গ্রীডে সর্বোচ্চ সরবরাহও ৩০০০ এমএফসিএফডি। চাহিদা প্রায় ৪৫০০ এমএমসিএফডি। বিশ্ববাজার থেকে উচ্চমূল্যের কারণে সরকার গতমাসেই ডিসেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে আরো ৩ কার্গো এলএনজি দ্রুত কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই চালানের প্রথম কার্গোটি হয়তো ১৯ মার্কিন ডলার মূল্যে ক্রয় করা সম্ভব হবে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো অচিরেই এর মূল্য ৩৫-৪০ মার্কিন ডলার হয়ে যেতে পারে।

স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনলেও মোট সরবরাহ গিয়ে পৌছাতে পারে ৩২০০ এমএমসিএফডি। ঘাটতি কিন্তু ৭০০-৮০০  এমএমসিএফডি থেকেই যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব ক্রমশ জ্বালানি নিরাপত্তাকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। দেশের গ্যাস উৎপাদনের ক্রমহ্রাসমান ধারা বিগত কয়েক বছর যাবৎ দৃশ্যমান। অথচ জলে স্থলে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা বিভাগ কার্যকর ও দুরদর্শি পরিকল্পনা দিতে এবং বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের একমাত্র বাপেক্স নির্ভর স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান পরিকল্পনা যে যথাযত হয়নি তা এখন প্রমাণিত।

২০২১ জানুয়ারী মাসে আইএএএফসি প্রতিবেদনে ২০২১ এবং ২০২২ বিশ্ব গ্যাস বাজারে মূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়ে আভাস দেয়া হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধি ১০০ মার্কিন ডলার ছুঁয়ে যেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে ক্রমাগত এলএনজি নির্ভর হতে থাকা বাংলাদেশ মহা সংকটে পড়তে পারে। গ্যাস নির্ভর নির্মানাধীন মেঘনাঘাটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। দেশের সকল গ্যাস গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাবে না। 

সম্ভাব্য এই সঙ্কট এড়াতে আমার বিবেচনায় কিছু প্রাকÑপরিকল্পনা এখনই নেওয়া উচিত। তেল নির্ভর অধিকাংশ বিদ্যুৎ প্ল­ান্টগুলো চালু রাখতে হবে। দ্রুত নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আনতে হবে। জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের নির্মাণাধীন গোপালগঞ্জ ঢাকা হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। 

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

ঢাকা/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়