ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রবীন্দ্রনাথ পড়তে যেতেন

কামরুল আহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৫, ২ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৭:০৯, ২ অক্টোবর ২০২১
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রবীন্দ্রনাথ পড়তে যেতেন

মানবসভ্যতার বিবর্তনীয় সূত্র ধরে অনুমান করা যায় দূর প্রাচীনকালে নারী-পুরুষ উভয়ের চুল লম্বা ছিল। সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্রেফ কেটে ফেলার যন্ত্রপাতি অপ্রতুলতার কারণে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় আজ থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ চুল কাটতে শিখেছে। তখন নিশ্চয়ই ধারালো পাথরের প্রান্ত দিয়ে চুল কাটতে হতো। পরবর্তীকালে ছুরি-তলোয়ার দিয়ে চুল কাটার ইতিহাসও পাওয়া যায়। কাঁচির আবিষ্কার খুব বড়জোর চার হাজার বছর আগে। পেশাদারী নরসুন্দরের আবির্ভাব তারও অনেক পরের ঘটনা। চুল কাটার কাজ মানুষ পারিবারিক বা ব্যক্তিগতভাবেই করতেন।

নারী-পুরুষের আলাদা চুল রাখার ইতিহাসও খুব বেশি পুরনো নয়। রোমান সভ্যতার শুরু থেকেই নারীরা প্রথাগতভাবে চুল লম্বা রাখতে শুরু করে এবং পুরুষ চুল খাটো করে কাটতে শুরু করে। এর কারণ পুরুষদের যুদ্ধে যেতে হয়, হাঁটে-মাঠে কাজ করতে হয়। লম্বা চুল সামলাতে অনেক ঝামেলা। যুদ্ধক্ষেত্রে লম্বা চুল সহজেই প্রতিপক্ষের মুষ্টিতে ধরা দিতে সহায়ক। ধারণা করা যায় আদিমকালে শিকারী পুরুষ হয়তো চুল খাটো করেই কাটতেন, দৌড়ানোর সুবিধার জন্য এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে সহজে মাথা বাঁচানোর জন্য। নারী ঘরের বাইরে চুল খোপা বেঁধে রাখতেন কাজের সুবিধার্থে। চুল সাজানোর বিষয়টা সৌন্দর্য বোধ থেকেই। বিশেষত বৈবাহিক অবস্থা বিবেচনা করে। বিয়ে-পরবর্তী সময়ে অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পার্থক্য নির্ধারণ করতেও অনেক সমাজে নারীর চুল লম্বা রাখার ইতিহাস বর্তমান। আজও অনেক দেশে অবিবাহিত কিশোরী-তরুণী চুল খাটো রেখে নিজের কৌমার্য অক্ষুণ্ন রাখার ঘোষণা দেয়।

বর্তমান সময়ে মাথার চুল সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটা প্রধান মাধ্যম। আধুনিক সময়ে বহু প্রকার চুল কাটার স্টাইল আমরা দেখেছি। পনিটেইল, লেয়ার, ব্যাংস, ভলিউম লেয়ার, স্টেপ, বব কাট, এ-লাইন বব কাট, বাজ কাট, শোল্ডার লেন্থ বব কাট, চিল লেন্থ বব কাট, শ্যাগি বব স্টাইলের শেষ নেই। তবে বিংশ  শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ভারতীয় নারীরা লম্বা চুল রাখতেন, মাঝখানে সিঁথি করতেন, বড়জোর একবেণী, দু’বেণী করতেন, তাতেই তাদের সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠতো। একপাশে সিঁথি করার চলও খুব বেশি দেখা যায়নি। অনূঢ়া বালিকারা তা করতো। 

পুরুষদের চুল কাটার ধরন ছিল একমাত্র কদম ছাঁট। আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের পুরুষদের বাজারে বুড়ো নরসুন্দরের দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে চুল কাটার অভিজ্ঞতা যার আছে তিনিই জানেন কদমছাঁট কী। এটাকে অনেকে বাটি ছাঁটও বলে। কানের দুপাশ দিয়ে চুল কেটে মাথাটাকে স্রেফ কদমফুল বানিয়ে দেয়া। এর পাশাপাশি আর্মি ছাঁটও এক সময় জনপ্রিয় হয়। হয়তো আইয়ুব খানের আমল থেকেই। স্বৈরশাসন আর্মি ছাঁটের পেছনে প্রভাব বিস্তার করে থাকবে। উত্তম কুমারের চুলের কাটিং দেখেও আমাদের বাবা-দাদাদের আমলে অনেকে ও-রকম চুল কেটে থাকবেন ষাটের দশকে। সেসব আমরা জানি না। এ দেশে ছেলেদের আলাদা চুলের কাটিং প্রথম জনপ্রিয় হয় সম্ভবত মিঠুন চক্রবর্তীর চুল দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে। সামনে পেছনে একটু লম্বা রাখা। তারপর নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় হয় রাহুল কাটিং। সামনে লম্বা, একগুচ্ছ চুল একটু কপালের ওপর ফেলে রাখা, পেছনে খাটো। খুব সুন্দর ছিল রাহুল কাটিং। এখন ছেলেরাও অনেক রকমে চুল কাটে। আজকাল দেখি কানের উপরে অনেকে একদম চেঁছে ফেলে। মাথার তালুতে এক থোকা লম্বা চুল রেখে সেগুলো আবার ঝুঁটি বাঁধে। নব্বই দশকের পরে যখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন এলো এবং বিশ্বকাপ ফুটবল অনেক জনপ্রিয় হলো তখন ছেলেরা নানা দেশের খেলোয়াড়দের নানারকম চুলের স্টাইল দেখে চুল কাটতো। সেসব অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হতো না। বিশ্বকাপ ফুটবল চলা পর্যন্তই। 

চুল শুধু সৌন্দর্য নয়, স্টাইল নয়, ব্যক্তিত্ব নয়, এটা পারিবারিক ঐতিহ্য প্রকাশেরও মাধ্যম। অনেক রক্ষণশীল পরিবার হঠাৎ করে ছেলেমেয়েদের খুব আধুনিক চুল রাখার স্টাইল পছন্দ করেন না। চুল শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপরই নয়, এটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাগত একটা ব্যাপারও। অনেকটা ইউনিফর্মের মতোই। আর্মি-পুলিশ-বিডিআরদের চুল কাটার আলাদা মাপ আছে। মসজিদের ইমাম আর স্কুল শিক্ষকের চুল কাটার ধরন এক রকম নয়। বিভিন্ন ধর্মেও চুল রাখার আলাদা তরিকা আছে। ইসলাম ধর্মে পুরুষদের চুল রাখার সুন্নতও আছে। তাই চুল বিষয়টা এতো সহজ নয়, জটিল!

অনেক বড় বড় শিল্পী-কবি-দার্শনিক-মনীষী লম্বা চুল রেখেছেন হয়তো সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য নয়, বরং সময় বাঁচানোর জন্য। চুল কাটতে গিয়ে নাপিতের সামনে চুপচাপ বসে থাকাও তো সহজ ব্যাপার নয়। আবার লম্বা চুল রেখে বিরাট শিল্পীর ভাব ধরা যায়, তাই অনেক তরুণ এতে প্রভাবিত হন।  

রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়স থেকেই লম্বা চুল রাখতেন। বড় বৌদী তাঁর চুল খুব পছন্দ করতেন এবং অনেক সময় চুল মেয়েদের মতো বেঁধে দিতেন। ভাবছি বড় চুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যদি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন তাহলে কী ঘটতো! কথাটা ভাবতে হচ্ছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি চুল কাটা নিয়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। সেখানে লম্বা চুল রাখায় ১৬ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন এক অধ্যাপিকা। মজার ব্যাপার তার চুল ছেলেদের মতো খাটো করে কাটা। খবরটি ফেইসবুকে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। অনেকে মজা করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে এখানে পড়তে আসতেন না। 

প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে পারেননি বলে রবীন্দ্রনাথ কোথাও পড়তে যাননি। বিলেতে পড়তে গিয়েও ফিরে এসেছেন। নিজের স্বাধীন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন শান্তি নিকেতন। প্রতিষ্ঠান মানেই নিয়মের বেড়াজাল। এই ঘটনা নিয়ে অনেক দিক থেকেই আলোচনা করা যায়। সমাজের শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠান জরুরি। এ সব ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোই রাষ্ট্রের বৃহৎ নিয়ম-শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখে। পরিবার থেকে তার পরিসর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি ক্ষেত্র পর্যন্ত। এক জায়গায় একটা নিয়ম ভেঙে গেলে সব জায়গাতেই নিয়মগুলো ভেঙে পড়বে। যৌথচেতনায় তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই নিয়মের কড়াকড়ি। 

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান শোষণেরও একটা যন্ত্র। পারিবারিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বা সামাজিক রীতি-নীতির বিরুদ্ধে ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়েই বিদ্রোহ শুরু হয়। এটা যে সবাই খুব সচেতনভাবে করে তাও নয়। তার বেড়ে ওঠা, শিক্ষাদীক্ষা, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই সে হয়তো পোশাকে, চুল রাখার স্টাইলে, আচরণে ভিন্ন হয়। এমনকি ব্যবহৃত সামান্য একটা ব্রেসলেটের মাধ্যমেও এই ভিন্নতা ধরা পড়ে। তবে প্রচলিত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে সাজপোশাকে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলাও খুব সহজ নয়। এও এক প্রকার বিদ্রোহ। এবং এ জন্য পরিচিত মহলে, পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানে অনেক হাসিতামাশা, কূট-কথারও শিকার হতে হয়। কিন্তু সেটি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের তরফ থেকে হয় তাহলে চিন্তার বৈকি। কেননা স্কুলজীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন এক নয়। সাধারণভাবেই পরবর্তী ধাপে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠে। জীবনযাপনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। তবে এই স্বাধীনতার মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। নয় আইন অমান্যের প্রবণতা। এবং চুল বড় রাখাও আমাদের প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ নয়। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজস্ব ড্রেস কোড নেই। বাধ্যবাধকতা নেই চুল বড় বা ছোট রাখার।      

তাছাড়া কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি বিবেচনা না করে যদি যৌথচেতনার মনস্তত্ত্ব বিচার করা হয় তাহলে তাতে অনেক কিছুই বের করা যাবে। যেখানে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক আদর্শ-দর্শন-মূল্যবোধ ধসে পড়ছে সেখানে কয়েক গোছা চুল নিয়ে কী আসে যায়! ওই অধ্যাপিকা যা করেছেন এটা এক প্রকার ক্ষমতার বিকৃত প্রকাশ। ক্ষমতার প্রকাশ এভাবে তিনি কেন করলেন সেও বিবেচ্য বিষয়। কোনো ছাত্রের চুলের মুঠি ধরে চুল কেটে দেওয়া শিক্ষকের কাজ নয়; এটা অপরাধ! তিনি আরো বড় অপরাধ করেছেন পত্রিকায় মিথ্যা বলে। ঘটনার পর তিনি গণমাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। এটা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু পরে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে যখন তাকে কাঁচি হাতে দেখা গেছে তখন তার পুরো ঘটনা অস্বীকার করা ঠিক হয়নি। এতে নৈতিকভাবে তার পরাজয় ঘটেছে।

সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে শিক্ষামন্ত্রীকে আশ্বাসের বাণী শোনাতে হয়েছে। সেই অধ্যাপিকাকে আপাতত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হবে না। কেননা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। একাধিক শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে। সুতরাং আমি মনে করি, তার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। হয়তো চিকিৎসা প্রয়োজন আমাদের পুরো সমাজেরই।  
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়