ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতায় ইসলামের মর্যাদা ও মূল্যবোধ   

সোহেল সানি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ১৬ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৯, ১৬ অক্টোবর ২০২১
বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতায় ইসলামের মর্যাদা ও মূল্যবোধ   

মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান পাসের মুহূর্তে গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চারটি মূলনীতির ব্যাখ্যা দেন। সংবিধান কার্যকর হয় ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের মিলিত রক্তস্রোতের বিনিময়ে। যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্জিত ফসল। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ সংগ্রামে জাতি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুদেরই উত্থান ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে উচ্ছেদ করা হয় সংবিধান থেকে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ রহিত করার ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো রাজনীতির অধিকার ফিরে পায়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: 

‘‘বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, খ্রীষ্টান তার ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধ তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর হওয়া চলবে না এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। রাজনীতির অঙ্গনে ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই। জনগণের জন্য যা চাই তা সুস্পষ্ট ভাষায়, সরাসরি ঘোষণা করি। এ কারণে কখনো ইসলামবিরোধী, কখনো রাষ্ট্রদ্রোহী, কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আবার কখনো বিদেশী চরের আখ্যা পেতে হয়েছে।’’

জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালী জাতি- এ নিয়ে হলো বাঙালী জাতীয়তাবাদ।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান রাতারাতি জাতীয়তাবাদ বাঙালির স্থলে ‘বাংলাদেশী’ হয়ে যায়। সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় আনা হয় পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‘সমাজতন্ত্র হবে দ্বিতীয় স্তম্ভ। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বন্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আর ধন সম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলার কৃষক, মজদুর, শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী এ দেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে। সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সেদেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালোবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই না। দরকার হলে আবার ভোটে যাবো।’’

বঙ্গবন্ধু খাঁটি জাতীয়তাবাদী ছিলেন বলেই অপর এক ভাষণে বলেন, ‘‘আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট বৃটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে আমি যতক্ষণ বেঁচে থাকি ততক্ষণ আমার দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। একদল লোক বলছে মুজিবুর রহমান লন্ডন চলে যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে ফেলে বেহেস্তে গেলেও শান্তি পাবে না।’’

আশার কথা হচ্ছে দেরিতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও ব্যাখ্যায় সকল ধর্মকে সম অধিকার দেয়া হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফিরে এসেছে। বাংলাদেশী শব্দটি নাগরিক পরিচয়ে ব্যবহারের নির্দেশনা রেখেই সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ বাঙালি পুনঃস্থাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে মূলনীতিগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। সংবিধানে ইনডেমনিটি ঢুকিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে বৈধতাদানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়েছিল। সেই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল বিশ্বের কাছে। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।  

বঙ্গবন্ধু দৈহিকভাবে নেই। কিন্তু আছে তাঁর প্রতিটি কথার উচ্চারণ ও ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। আর তা দেশের যে কোনো সংকটে পথের দিশা দেখায়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। 

প্রসঙ্গত দেশে হেফাজতের তাণ্ডব আমরা দেখেছি। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দমনে সাধুবাদ পেতেই পারে। আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করেও দেখেছি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সন্ত্রাস। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেও ধর্মান্ধ গোষ্ঠিরা যে দেশে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করার নীলনকশা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছে তা দেশবাসীর কাছে ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তড়িঘড়ি পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা রাখলেও ঘটনার সূত্রপাত স্থল কুমিল্লা ফুঁসে ওঠার নেপথ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই কোনো কোনো সদস্যের তাৎক্ষণিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা দেখেছি স্থানীয় পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তার এক হাতে পুজা মণ্ডপ থেকে উদ্ধার করা পবিত্র কুরআন শরীফ, আর অন্য হাতে মোবাইল ফোনে কথা বলার  দৃশ্য। স্থানীয় ধর্মান্ধ লোকজন সেই দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করে প্রচার করে। যা রীতিমত ভাইরাল হয়ে যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, ওসি ঘটনাস্থলে কেনো কুরআন শরীফখানা হাতে রেখে অনবরত মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। হতে পারে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু কেনো তিনি ঘটনাস্থলে এমন দৃশ্যের অবতারণা করলেন? অসাধু লোকেরা এ থেকে ফায়দা লুটতে পারে- এ কথা কেনো ওসি সাহেবের মনে এলো না? ওই দৃশ্য যারা ফেইসবুক ইউটিউবের মাধ্যমে লাইভে প্রচার করেছে তারা প্রত্যেকেই সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক ভাষা ব্যবহার করেছে। পূজা মণ্ডপে পবিত্র কুরআন শরীফখানা প্রথমে কোন ব্যক্তির নজরে পড়লো সেটা একটা প্রশ্ন। সেই ব্যক্তি কি মুসলিম, নাকি হিন্দু ধর্মালম্বী কোনো জাতীয়তাবাদী? আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে- ওসি সাহেব কুরআন শরীফখানা জনগণের মধ্যে প্রদর্শন না করে তা সুরক্ষণ করলেন না কেনো? বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।

যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছুঁড়েছিল, যারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর ঠেকাতে সংঘাত সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছিল তারা মূলত ইসলামের নামে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত করার স্বপ্নে বিভোর। এদের মূল উৎপাটন করা যে সম্ভব হয়নি, তা কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনায় প্রমাণ মেলে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে এদের শেকড় আরও বিস্তৃত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেও স্বাধীনতাবিরোধী অনুপ্রবেশকারী রয়েছে- এমন কথা যখন দলের শীর্ষ নেতারা বলেন তখন স্বাধীনতাবিরোধীদের শেকড় কতটা বিস্তৃত তা আঁচ করা যায়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়