ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মেটাভার্স : প্রযুক্তির নতুন জগতে আইনি চ্যালেঞ্জ

সাঈদ আহসান খালিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৭, ১ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৪:৫৯, ১ নভেম্বর ২০২১
মেটাভার্স : প্রযুক্তির নতুন জগতে আইনি চ্যালেঞ্জ

ছবি: সংগৃহীত

মার্ক জাকারবার্গ সম্প্রতি ‘মেটা’ প্রযুক্তিতে উত্তরণের কথা বলতেই শব্দটির সঙ্গে আমাদের অনেকের প্রথম পরিচয় ঘটলেও ‘মেটাভার্স’-এর ধারণা মোটেই নতুন নয়। ১৯৯২ সালে নীল স্টীফেনসন তাঁর ‘স্নো-ক্রাশ’ নামে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন যেটি দিয়ে তিনি এমন এক কাল্পনিক জগতের ধারণা প্রদান করেন যেখানে বিভিন্ন মানুষ থ্রি-ডি ভার্চুয়াল জগতে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করছে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন টেক-জায়ান্ট কোম্পানি এই মেটাভার্স প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে আসছে। মার্ক জাকারবার্গের বক্তব্যের মাধ্যমে এটি এখন স্পষ্ট যে, সেই কল্পকাহিনী এখন বাস্তব হতে চলেছে। আমরা শীঘ্রই প্রযুক্তির নতুন জগতে পদার্পণ করতে যাচ্ছি; ইউনিভার্সের পরিবর্তে এই জগত হবে মেটাভার্সের।

মেটাভার্স-কে বলা হচ্ছে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ; যেখানে ইন্টারনেটকে এমন জীবন্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা হবে যা আমাদের বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার ধারণারও বাইরে! মেটাভার্স হবে নতুন এক জগত যেখানে মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব ও ভার্চুয়াল অস্তিত্বকে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হবে যে, চোখে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভি আর) হেডসেট ও চশমা পরে মানুষ প্রবেশ করবে এক নতুন ডিজিটাল জগতে। সেখানে প্রতিটি মানুষের একটি করে অবতার (Avatar) সৃষ্টি হবে; যেটি দিয়ে সেই জগতে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর মতোই আড্ডা দেবে, কথা বলবে, ঘুরে বেড়াবে, অফিসের কাজ করবে, শপিং করবে, লাইভ কনসার্টে যোগ দেবে, খেলাধুলা করবে। অর্থাৎ মানুষ সবই করবে, তাঁর শরীর থাকবে ঘরে বা বাইরে কিন্তু দেখার ও অনুভবের জগত হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন-ভার্চুয়াল।

মেটাভার্সে ইন্টারনেট জগতকে বাস্তব জগতের মতোই মনে হবে। সহজ উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, এখন আমরা অনলাইনে পণ্য দেখে শপিং করি, ক্যাশ অন ডেলিভারি বা ক্রেডিট কার্ডে দাম মেটাই। মেটাভার্সে চোখে ভি আর ডিভাইস যুক্ত করে আপনি ডিজিটাল শপিং ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করবেন যেখানে পছন্দের পোশাকটির একটি ডিজিটাল সংস্করণ আপনার অ্যাভাটারের গায়ে পরিয়ে মনমতো হলে এবার পোশাকটি কিনে ফেললেন। অ্যাভাটার হবে আপনারই ডিজিটাল শরীর। তাই মনে হবে যেন সত্যিই পোশাকটি আপনিই গায়ে দিয়েছেন! কাগজের মুদ্রা বা ক্রেডিট কার্ডের জায়গা দখল করবে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি।

শুধু শপিং নয়, মেটাভার্সের জগতে এভাবে সবকিছুই হবে ভার্চুয়ালি। থ্রি-ডি গেইম কিংবা থ্রি-ডি মুভির মাধ্যমে থ্রি-ডি ভার্চুয়াল জগতের কিছুটা ধারণা আমরা পাই কিন্তু সামনের পৃথিবীতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সবকিছুই হবে থ্রি-ডি এবং যে প্ল্যাটফর্মে এটি সংঘটিত হবে সেটিই মেটাভার্স। 

মেটাভার্স প্রযুক্তি শুধু একা ফেসবুকের উদ্ভাবন নয়, অনেক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি বিভিন্ন প্রকারের মেটাভার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগুল- কে নেই এই দৌড়ে! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence- AI) এবং মেশিন লার্নিং হবে এই প্রযুক্তির চালিকাশক্তি। মেটাভার্সের দুনিয়ায় জড়িয়ে যাবে মানুষের ব্যক্তিজীবন, পেশাজীবন, সমাজজীবন, শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প, বিনোদনসহ প্রায় সব কিছুই। কিন্তু, মানবজীবন তো আর থ্রি-ডি ভিডিও গেইম নয়। তাই এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইনগত বিষয়গুলো কেমন হবে সেটিও বর্তমানে ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে। 

প্রথমত, এটি অনস্বীকার্য যে, আইন প্রযুক্তির তুলনায় পিছিয়ে থাকে। প্রযুক্তি আগে আসে, আইন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। যেহেতু মেটাভার্স এখনো কার্যকর হয়নি, মেটাভার্সের ফলে কীভাবে মানুষের জীবন পরিবর্তিত হবে তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বরং অনুমান নির্ভর। তাই আইনের প্রি-এম্পটিভ অ্যাকশনের সুযোগ নেই। তবে, মেটাভার্স দুনিয়ায় আইনগত চ্যালেঞ্জ কী কী হতে পারে তা নিশ্চয় কিছুটা অনুমান করাই যায়। 

দ্বিতীয়ত, যেহেতু মেটাভার্স তৈরিতে বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে তাই এসব কোম্পানির মধ্যকার প্রযুক্তি বিনিময়, সমন্বয় ও মেটাভার্সের মালিকানা নির্ধারণে আইনের ভূমিকা থাকবে। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি করা ডিভাইস ও ভার্চুয়াল স্পেসের লাইসেন্স ও ব্যবহার বিধি প্রণয়নে আইনগত কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে।

তৃতীয়ত, ফেসবুকের মালিকানায় থাকা মেটাভার্সের নিরাপদ ব্যবহার ও নৈতিক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়েছে হংকং ইউনিভার্সিটি এবং সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বাস্তবের দুনিয়ায় যে রকম অপরাধ হয়, মেটাভার্সের ভার্চুয়াল জগতেও তেমন অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। যেমন, ভার্চুয়াল প্রতারণা, ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইলিং, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও তথ্যের অপব্যবহার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন, ভার্চুয়াল সম্পদ লুণ্ঠন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস লঙ্ঘন প্রভৃতি। মেটাভার্স জগতে এসব বিষয়ের আইনগত পরিসীমা ও বিচার প্রক্রিয়া কীভাবে নির্ধারিত হবে?

চতুর্থত, বর্তমান দুনিয়ার আইন মানুষ-কেন্দ্রিক। কিন্তু মেটাভার্সের পৃথিবী হবে বহুমাত্রিক যেখানে মানুষ আর মুখ্য থাকবে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হবে সবকিছুর চালিকাশক্তি। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নতুন নতুন অনেক পণ্য ও সেবার জন্ম দেবে যা মানুষের দ্বারা হয়তো সম্ভব হতো না। প্রশ্ন হলো, সেসব পণ্যের পেটেন্ট মালিকানা, কপিরাইট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার কার হাতে থাকবে? মানুষ নাকি মেশিন? মেশিনকে উদ্ভাবক হিসেবে পেটেন্ট অধিকার প্রদান করা যেতে পারে কি? মেটাভার্স দুনিয়ায় এই আইনগত বিষয়গুলোর সুরাহা হবে বলে আশা করা যায়।

পঞ্চমত, মেটাভার্স জগতে বর্তমান বাণিজ্য আইন ও মুদ্রানীতি অকার্যকর হয়ে যাবে। ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ ও ক্রিপ্টোকারেন্সি সামনে চলে আসবে। এই ডিজিটাল মুদ্রা কারা ব্যবহার করবে? কিভাবে করবে? মালিকানা কীভাবে হবে? কে বেচবে? কে কিনবে? কে বাণিজ্য করতে পারবে? কে পারবে না? সবকিছুর জন্য নতুন আইন ও আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে।

তদুপরি, বর্তমান সময়ের চেয়ে মেটাভার্স জগত হবে অনেক বেশি বায়োমেট্রিক তথ্য নির্ভর। অর্থাৎ, মেটাভার্স কোম্পানিগুলো আমাদের আঙুলের ছাপ শুধু নয়, বরং আমাদের চোখের দৃষ্টি, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনা, এমনকি আমাদের প্রাত্যহিক যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। যেহেতু মানুষ জাগ্রত অবস্থা এমনকি নিদ্রিত অবস্থারও বেশিরভাগ সময় মেটাভার্স জগতে ব্যয় করবে, এর ফলে সেসব মানুষের ব্যক্তিগত সমস্ত তথ্যের মালিকানা কার হাতে থাকবে? ব্যক্তিগত তথ্য যদি চুরি হয় কিংবা অপব্যবহার হয়- তাহলে কে দায়ী হবে? কীভাবে দায়ী হবে? 

প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষকদের অনেকে মনে করছেন, মেটাভার্সের মাধ্যমে ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো বর্তমানের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত তথ্য আরও সহজে হাতিয়ে নেবে, মানুষ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি ডিজিটাল সারভেইলেন্স-এর শিকার হবে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে এরা আর্থিকভাবে আরো লাভবান হবে এবং তথ্যের অপব্যবহার ঠেকানো কঠিনতর হয়ে উঠবে। মেটাভার্স হবে ডাটা ব্যবসায়ীদের জন্য সোনার খনি।

মেটাভার্স-কে কী প্রতিরোধ করা যাবে? 
সম্ভবত না, এবং সেটির প্রয়োজনও নেই। কিন্তু উপযুক্ত আইনি কাঠামোই পারে মেটাভার্সের নিয়ন্ত্রকদের হাতে লাগাম পরাতে, মেটার পৃথিবীতে মানুষের পার্সনাল ডেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়