ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দোহাই লাগে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ান  

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৩ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:৫০, ৩ নভেম্বর ২০২১
দোহাই লাগে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ান  

টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মূল পর্বে এসে ব্যর্থ হয়েছে। সমর্থকরাও ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন ক্রিকেটারদের ওপর, ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট কর্তাদের ওপর। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি বলেই তারা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাস্তবতার রাস্তায় না হেঁটে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া সত্যিকারার্থে বেমানান।

বিসিবি একাদশ, মিরপুর একাদশ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে তাক লাগানো যদিও খুব কঠিন, তারপরও বলব- মালদ্বীপ গিয়ে সাফ গেমসে কেনো ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল টিম? বাফুফের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি তো দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সৈনিক। আমাদের ফুটবলের অতীত ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। সমৃদ্ধ সেই অধ্যায় বাফুফে কেনো ধরে রাখতে পারে না? এসব প্রশ্ন সমর্থকদের মনে আসা উচিত। 

ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা লেখক সমাজের মধ্যেও ভালোভাবে আছে। কেউ কেউ নাক সিটকে বলছেন-  ক্রিকেটের পেছনে টাকা ঢেলে অর্থ নষ্ট। আদতে তারা জানেন না- নষ্ট হয় নাকি উপার্জন হয়! সেইসব লেখকদের প্রতি আমার ছোটো প্রশ্ন- বাংলাদেশের ক’জন কবি বা লেখক স্বপ্ন দেখেন, লেখালেখি করে পৃথিবীখ্যাত পুরস্কার নোবেল অথবা বুকার অর্জন করবেন? এই অর্জনে তারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন? তবে, একটা কথা নিশ্চিত বলা যায়- সাহিত্যে এ দেশ নোবেল পাওয়ার আগে, ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জিতবে।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যে কোনো কর্মকাণ্ডে  ক‘জন আছেন- বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে অন্যরকম একটি মর্যাদা দিয়েছেন? সেই নামগুলো কড় গুণে বলতে হয়। অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির যুগে যেখানে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমে এসেছে সেখানেও আমরা পিছিয়ে। এর কারণ একটাই- আমরা মানসিকভাবে পিছিয়ে আছে। এতটাই পিছিয়ে, তলানির সর্বশেষ স্তরেও খুঁজে পাওয়া যায় না আমাদের অবস্থান।

অনেকে আওয়াজ তোলেন- পৃথিবীতে বাঙালির একটা সুসংহত অবস্থান রয়েছে। সেই অবস্থান খুঁজতে গিয়ে দেখি ক্রিকেটে ছাড়া কোথাও কোনো অবস্থান দৃশ্যত নেই। অনেকে বলতে পারেন, ব্যক্তিগত কিছু মাইলফলক আছে। সামষ্টিক সাফল্য কোথায়? সামষ্টিক সাফল্যের অর্থ হলো একতা, ঐক্যবদ্ধতা। অর্থনৈতিকভাবে বলি কিংবা সাংস্কৃতিকভাবে- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর বিপক্ষে আমাদের তেমন কোনো অর্জন নেই একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া। যেহেতু নেই, তাই ক্রিকেটকে আরো এগিয়ে নিতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে, ক্রিকেটে এখন এগিয়ে আসছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার দেশগুলো। কেউ কেউ হয়তো অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের। ফলে এখনই সুযোগ ক্রিকেট নিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য শুরু করার। এর আগে বাড়াতে হবে পণ্যের বাজারমূল্য। বাজারমূল্য বাড়ানোর আগে বাড়াতে হবে গুণগত মান। তাই আমাদের ক্রিকেটকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে দাঁড় করানোর বিকল্প নেই। 

লিটন দাস টানা ১১ ম্যাচে খারাপ করেছে এই বিশ্লেষণ করার আগে বাংলাদেশের টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট পরিসংখ্যানের দিকে একবার চোখ রাখতে পারি- ২০০৬ সালে প্রথম টি-টুয়েন্টি খেলে বাংলাদেশ ৷ ১১২টি ম্যাচ খেলে টাইগার বাহিনীর পরাজয় ৭১ ম্যাচে হলেও জয় এসেছে ৪১টিতে। সবচেয়ে বেশি ১১টি ম্যাচ জিতেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে চারটি করে ম্যাচ জিতলেও ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে যথাক্রমে ১১ ও ১২ ম্যাচ খেলে দশটিতেই হেরেছে। টেস্টের অবস্থা যাচ্ছেতাই। সেই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ না রাখলেই দিনটি ভালো কাটবে।

২০১৬ সালে ওমানের বিপক্ষে অপরাজিত ১০৩ রান করেছিলেন তামিম ইকবাল। যা এখন পর্যন্ত টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের একমাত্র শতক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানটিও এই ব্যাটসম্যান করেছেন ২০১২ সালে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে, অপরাজিত ৮৮ রান। মোট রানের দিক দিয়ে ৯৪ ইনিংসে এক হাজার ৭৭১ রান করে এই তালিকায় সবার উপরে আছেন মাহমুদউল্লাহ৷ যেখানে আফগান উইকেট কিপার কাম ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ শেহজাদ ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণে ৬৫ ম্যাচে করেছেন ১,৯৩৬ রান। মাহমুদউল্লাহর চেয়ে ৭ ইনিংস কম খেলা সাকিবের সংগ্রহ ১,৭৬৩। এরপর ধারাবাহিকভাবে আছেন তামিম (১,৭০১), মুশফিক (১,৩২১) ও সৌম্য সরকার (১,১০৯)। অর্থাৎ ২০০৬ সালে শুরু হওয়া টি-টুয়েন্টিতে কোনো খেলোয়াড়ই ২০২১ সালে এসেও ২ হাজার রান অতিক্রম করতে পারেননি। এই না-পারার পেছনে খেলোয়াড়দের মতোই ক্রিকেট বোর্ডকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।

বিসিবি সভাপতি কয়েকবার বলেছেন ৯০০ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা আছে। বিসিবির উচিত টাকা বিনিয়োগ করে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ানো। জেলায় জেলায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্টেডিয়াম বানানো। সেখানে ক্রিকেটাররা নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খেলবে। অবকাঠামোগত এমন উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক ইচ্ছা শক্তিও বাড়াতে হবে। ভাবতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। শুরুতেই বলেছি ক্রিকেট খেলতে অনেক দেশই উৎসাহী। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা তাদের কাছে কেন তুলে ধরবো না! বৃহৎভাবে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটার, বোলার, ফিল্ডার, উইকেটকিপার, এমনকি শত শত কোচ, আম্পায়ার, ধারাভাষ্যকার তৈরি করায় সমস্যা কোথায়? যেখানে বিসিবির কোষাগারে টাকা অলস পড়ে রয়েছে।

মনে রাখতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব, ওমান, আবুধাবি, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, ইরান, জর্ডান। এসব দেশের পক্ষ হয়ে খেলা অধিকাংশ খেলোয়াড় ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কান নাগরিক। তারা সেসব দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে শুধু তাই নয়, উপার্জনও করছে বৈদেশিক মুদ্রা। সেই সঙ্গে বাড়ছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি, পরিচিতি। অথচ এ সব দেশে বাংলাদেশিও রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। কিন্তু তারা সবাই প্রায় শ্রমিক। খেলার এই সুযোগ নিতে পারে না। বিসিবি যদি স্কিলড খেলোয়াড় এসব দেশে পাঠাতে সক্ষম হয়, সন্দেহাতীতভাবে বাড়বে আয়ের গ্রাফ। 

বসে নেই আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোও। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় শুরু হয়েছে বৈশ্বিক ক্রিকেট লীগ। যেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্রিস গেইল, ম্যাককালামরা। এখানেও বেশিরভাগ খেলোয়াড় ভারত, পাকিস্তানের। এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি আফ্রিকার মতো দেশগুলোও। সুতরাং ক্রিকেটকে শুদ্ধভাবে বৈশ্বিক করতে গেলে বিসিবিকেও শুদ্ধ পরিক্রমার ভেতর দিয়ে আসতে হবে। ঘরোয়া লীগগুলো করতে হবে দলীয় মুক্ত। স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে উঠতে হবে। নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করতে হবে ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স।

বিসিবি চাইলেই, বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে নিতে পারে। এ জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা; কথার আস্ফালন নয়। মোটা দাগে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান আমাদের বাড়াতেই হবে। তৈরি করতে হবে স্পোর্টিং উইকেট। পাইপলাইনে রাখতে হবে মেধাবীদের, তাদের চর্চার পথ তৈরি করে দিতে হবে। আমরা এখনও স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ক্রিকটে। আর ক্রিকেটারদের হাত ধরেই বাংলাদেশ জয় করবে বিশ্বকাপ।

কবি ও কথাসাহিত্যিক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়