করোনায় ঝরে পড়া ছাত্রীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার উপায় কী
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হবে আগামী ২৩ নভেম্বর। পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেওয়ার আনন্দ আলাদা, যে আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা গত দু’বছর বঞ্চিত ছিল। সিলেবাস ছোট হোক কিংবা বড়, তারা পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছে এর মূল্য আলাদা।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিখন-শেখানো কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সমস্যা হচ্ছে শিখন-শেখানো নিয়ে আমরা যতটা না ব্যস্ত তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত মূল্যায়ন নিয়ে। এটি অবশ্য হওয়ারই কথা। কারণ একজন শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়ের কতটা জেনেছে তার সনদ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, চাকরি পেতে সনদ হলো প্রমাণ। তাই আমরা এই বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছি। যে কোনো প্রকারেই হোক ওই সনদে ভালো গ্রেডিং সবাই পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইদানিংকালে সনদ তার মূল্য অনেকটাই হারাতে বসেছে। কারণ কেউ একজন যদি বলে- আমি এসএসসি ও এইচএসএসসি দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছি। তারপরও তাকে কিন্তু উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিতে হয়, ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে হলে তাকে বাজিয়ে দেখা হয়। এত কথা যে জন্য বলছি তার উদ্দেশ্য আছে।
আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লেভেলের ( প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যে বিষয়গুলো দেখলাম তাতে মূল্যায়ন নিয়ে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের বাংলা বই, ইংরেজি বই পড়তে দিয়েছি। একটি ক্লাসে এক-দুজন ছাড়া কেউই তাদের শ্রেণির বাংলা কিংবা ইংরেজি বই ভালোভাবে পড়তে পারেনি। অনেকে যুক্তাক্ষর পড়তেই পারছে না। তাদের জিজ্ঞেস করেছি- বাংলাদেশের সুন্দরবন রাজশাহীতে না ঢাকায়? কেউ বলেছে ঢাকায়, কেউ বলেছে রাজশাহীতে। যখন জিজ্ঞেস করলাম- ঢাকায় কোথায়, সাভার না গুলিস্তান? অনেকেই বলেছে সাভার।
তার মানে সঠিকভাবে কেউই জানে না। তাদের পাঠ্যবই থেকে জিজ্ঞেস করেছি- আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি- ইংরেজি কী? ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা বলতে পেরেছে। এরপর যখন জিজ্ঞেস করেছি- আমার ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে- তখন আর কেউ পারছে না। এর অর্থ হলো তারা পঠিত কোনো বিষয় নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে না। অর্থাৎ বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের মেধা নেই- এজন্য পারছে না বিষয়টি তা নয়। শিক্ষকরা সেখাবে শেখাচ্ছেন না। শিক্ষকরা কেন সেভাবে শেখাচ্ছেন না? কারণ সেভাবে পরীক্ষায় আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কী ধরনের মূল্যায়ন হচ্ছে?
আমি যখন তাদের শিখিয়ে দিলাম- মাই ব্রাদার রিডস ইন ক্লাস সিক্স, কয়েকবার প্রাকটিস করার পরে তারা পেরেছে। সাধারণ গণিতের ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করলাম। তোমার কাছে ১২৫০ টাকা আছে। এই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে একটি বই কিনেছ ২০০ টাকা দিয়ে, একটি ক্যালকুলেটর কিনেছ ২৫০ টাকা দিয়ে, একটি খাতা কিনেছ ৩০ টাকা দিয়ে। এখন তোমার কাছে কত টাকা থাকবে? কেউ বলেছে থাকবে, কেউ বলেছে থাকবে না। জিজ্ঞেস করলাম এটি বের করতে কি আমাদের গুণ করতে হবে না ভাগ করতে হবে? কেউ বলেছে গুণ করতে হবে, কেউ বলেছে ভাগ করতে হবে। বিয়োগের কথা প্রথম কেউই বলেনি। বললাম, খাতায় হিসেব করে দেখ। দেখলাম প্রতি ক্লাসে হয়তো একজন কোনো রকম বের করেছে কিন্তু বিয়োগ নিয়মানুযায়ী করা হয়নি। সবাই ১২৫০ এর নিচে লিখেছে ২০০টাকা, ২৫০ টাকা, ৩০ টাকা। এটি বের করার যে নিয়ম সেটিও তারা আয়ত্ব করতে পারেনি।
লাভ-ক্ষতির কথা জিজ্ঞেস করেছি- কখন লাভ হয়, কখন ক্ষতি হয়? বের করার উপায় কী? কেউ বলতে পারে নি। অর্থাৎ বেসিক ধারণা তাদের দেওয়া হচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণি ও দশম শ্রেণিতে জিজ্ঞেস করেছি আমাদের ক্লাসে ৫৮ জন শিক্ষার্থী আছে- ইংরেজিতে কীভাবে বলা যায়। একটি শিক্ষার্থীও পারেনি। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যাবে ৯৮- ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে পাস করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কি মূল্যায়ন হচ্ছে? মূল্যায়ন বিষয়টি গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যার বেসিক ধারণা আছে সেও নম্বর পাচ্ছে, যার কোনো ধারণা নেই সেও নম্বর পাচ্ছে। এই নম্বর তো তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কথা বলছে না।
২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণিশেষে জেএসসি পরীক্ষা নেই। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছে। নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছে কেন? পরীক্ষা না হলে, পরীক্ষার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না, পড়তে চায় না, অভিভাবকগণও পড়াশোনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। তারা চান বাচ্চারা চাপে থাকুক। পরীক্ষা না হলে, পড়ার চাপ না থাকলে বেসরকারি পুস্তক প্রকাশকগণ তাদের বই বিক্রি করতে পারেন না। শিক্ষকগণও খুব একটা আগ্রহ পান না। পরীক্ষায় যে কয়টি চ্যাপ্টার, যে কয়টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো শিক্ষার্থীদের কেঁচে গন্ডুষ করানো হয়, বারবার প্রাকটিস করানো হয়। পরীক্ষা না হলে এগুলো করানো হয় না। এটিও বাস্তব চিত্র। তাই সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো টিকিয়ে রেখেছিল। তার মানে, পরীক্ষা নেওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু পঠিত বিষয় নিজে ব্যবহার করতে জানছে না কিংবা পারছে না, পরীক্ষা না হলে কোনো কিছু পড়তে চায় না এর সমাধান আসলে কী?
এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এতে ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মোট ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৬ জনের হদিস নেই। ১১টি বোর্ডের তথ্য যুক্ত হলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮১৪ জন। রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে ভিড়ে গেছে কিংবা বিয়ে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রী- এই খবর উদ্বেগজনক। এসব ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
বাল্য বিয়ে নিয়ে, বাল্য বিয়ের কুফল নিয়ে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে এত আলোচনা পর্যালোচনার পরেও পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর মূল কারণ দারিদ্র্য হলেও মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দরিদ্র ও অসহায় পিতামাতা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে, বখাটেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য, রাজনৈতিকভাবে প্রশয় পাওয়া উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের হাত থেকে, ইভটিজিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাল্যবিয়ের কুফলের কথা জেনেও অনুপযুক্ত পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পণ করছেন। এ নিয়ে কোনো সামাজিক সংগঠন কিংবা কোনো বেসরকারি সংস্থা এলাকাভিত্তিক কিছু গবেষণা করে, তার ফল প্রকাশ ও কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করে কিন্তু তাতে তো উঠতি বয়সী ছেলেদের বখাটেপনা কমে না। ভুক্তভোগী পিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না। বরং দুর্ঘটনা ঘটলে মেয়ের ওপরেই দোষ চাপানো হয়। রাজনীতির যে দুষ্ট রাহু সমগ্র সমাজ গ্রাস করে ফেলেছে এ থেকে উত্তরণের উপায় তো খুব সহজ নয়। তবে শিক্ষকদের হাল ছেড়ে দিলে হবে না। এসব শিক্ষার্থীকে বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাদেরকে প্রণোদনার অংশ হিসেবে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এটা পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত তাকে অবিবাহিত থাকতে হবে। কিন্তু যে লাখ ছাত্রী পরীক্ষায় বসছে না, তাদের মধ্যে যে কজনের বিয়ে হয়েছে আর তাদেরকে যদি স্কুলে দেখতে চাই তাহলে অবিবাহিত থাকার শর্ত তুলে দিতে হবে। নইলে তারা আগ্রহী হবে না।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন