ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বন্ধুত্বের ৫০ বছর: নতুন মাইলফলকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

তাপস হালদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০২, ২ ডিসেম্বর ২০২১  
বন্ধুত্বের ৫০ বছর: নতুন মাইলফলকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। একই দিনে কিছু সময় আগে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। যেটি ছিল দিল্লির ‘কূটনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক’। ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ, কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন আদায়সহ প্রবাসী সরকারকে যাবতীয় সহায়তা প্রদান করে দেশটি।

৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতি দানের পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে দ্রুত পাকিস্তান পরাজিত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ কারণে দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ পালন করছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর। বছরটি বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ৫০তম বছর। গত মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ৬ ডিসেম্বরকে ‘মৈত্রী দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এ বছরই প্রথম বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে আরো ১৮টি দেশে মৈত্রী দিবস পালন করবে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত মৈত্রী দিবসের বিশেষ আলোচনা সভায় ভিডিও বার্তায় বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি বক্তৃতামালা’ নামে বার্ষিক স্মৃতি বক্তব্যের আয়োজন করা হয়েছে। এখন থেকে প্রতি বছরই ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি বক্তৃতামালা’অনুষ্ঠান পালন করা হবে। এ বছর মূল বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ও বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স।

একই দিনে নয়াদিল্লির ঐতিহ্যবাহী ‘কামানি প্রেক্ষাগৃহ’ মিলনায়তনে নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অনুরূপভাবে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র' মিলনায়তনে একই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। উভয় অনুষ্ঠানে স্ব-স্ব দেশের বরেণ্য শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত সরকার রাজধানী নয়াদিল্লির ‘ঐতিহাসিক ইন্ডিয়া গেট’-এ তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৪-১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি। মহান মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধের কিছু ঘটনা এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের সেই দৃশ্যগুলোর জীবন্ত অভিনয় দেখানো হবে আলোক রশ্মির মায়াজালে। ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাগণ উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান আলোকিত করবেন।

এ বছর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। বিজয় দিবসের সমাপনী অনুষ্ঠান অলঙ্কৃত করবেন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। শোনা যাচ্ছে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করা হবে। তাহলে নিঃসন্দেহে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার এক অনন্য নজির সৃষ্টি হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ‘মৈত্রী চুক্তি'র মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের গোড়াপত্তন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় বাণিজ্য চুক্তি ও ’৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকসহ সকল সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবার আস্থা ও প্রত্যাশার আবহ তৈরি হয়। চুক্তি হয় ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি চুক্তি। আবার মাঝে নয় বছরের ছন্দপতন। ২০০৯ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে ভারতে শ্রী নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ৬৮ বছরের পুরোনা ছিটমহল বিনিময়, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলো একে একে সমাধান হতে শুরু করে।

ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিকে গতিশীল করতে দুই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আনা হয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ঢাকা-কলকাতা ও খুলনা-কলকাতা যাত্রী রেলসেবা এবং নীলফামারীর চিলহাটি থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ী ও ঢাকা-শিলিগুড়ি পণ্য পরিবহনের জন্য রেল সেবা ও ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-আগরতলা, ঢাকা-শিলিগুড়ি-দার্জিলিং বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া গত মার্চ মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন ফেনী নদীর ওপর সাবরুম সেতু। যা খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে ত্রিপুরা। ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার সেতু সংযোগের মধ্য দিয়ে শুধু নতুন ব্যবসায়িক দ্বার উন্মোচন হয়নি, দুই দেশের মানুষের মধ্যেও হয়েছে সেতুবন্ধন।

শুধু সড়ক বা রেলপথই নয়, নৌ-পথেও যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। ‘প্রোটকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড' (পিআইডব্লিইটিটি) চুক্তির আওতায় গোমতী নদীর সোনামুড়ি-দাউদকান্দি রুট এবং পদ্মায় ধুলিয়া-গোদাগারি থেকে আরিচা পর্যন্ত নৌ-পথে যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চালু হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহন কার্যক্রম।

২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি সই হয়। এর ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীই যুগ্মভাবে অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। ভারত বাংলাদেশকে সামরিক খাতে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে বলে চুক্তিতে বলা হয়। ভারত সরকারের এটাই কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হলো করোনার ভ্যাকসিন। বাংলাদেশকে সবার প্রথমে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে ভারত। এবং যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে তখন তরল অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় দুটি দেশেই। এমন পরিস্থিতেও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। ১৮০ মেট্রিক টন অক্সিজেন  নিয়ে ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস' প্রবেশ করে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি নিয়ে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ঐতিহাসিক ‘ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই এটি বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’ মাঝে মাঝে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী শক্তি দুই দেশের সম্পর্ক বিনষ্ট করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হবে না। কারণ বাংলাদেশ ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ  সম্পর্কের ভিত্তি হলো আস্থা ও বিশ্বাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তে লেখা এ সম্পর্ক। এখানে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নেই। দুই দেশের জনগণের মধ্যে এ সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। এ সম্পর্ক কেবলমাত্র দুইটি রাষ্ট্রের সম্পর্কই নয়, এ সম্পর্ক দুইটি দেশের জনগণেরও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী দুই দেশের মৈত্রী সম্পর্ককে ইতিহাসের এক নতুন মাইলফলকে নিয়ে গেছেন। এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হোক সেই প্রত্যাশা করি।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়