ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যাঁদের অভাবে দেশটা শূন্য হয়ে গেছে

মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:০৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
যাঁদের অভাবে দেশটা শূন্য হয়ে গেছে

যখন ছোট ছিলাম, তখন ১৪ ডিসেম্বর পত্রিকার পাতায় দেখতাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি, নিচে ছোট ছোট করে তাঁদের নাম লেখা। সে ছিল চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির কথা। সে সময় পুরো সংবাদ পড়তাম না, সেখানে কী লেখা থাকতো তা-ও জানতাম না। আস্তে আস্তে বড়ো হতে হতে সেই সংবাদটুকু পড়া শুরু করেছিলাম। খুব বড়ো কিছু থাকতো না, বা বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু থাকতো না। অন্তত একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সবার সম্পর্কে আলাদা করে কোনো কিছু পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। বাংলা সাহিত্যে পড়বার সুবাদে মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। ‘কবর’ আর ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ সে সময় কতোবার পড়েছি! বুঝবার চেষ্টা করেছি; নিস্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধকে দেখবার চেষ্টা করেছি। সেই সময়টাকেই ধরবার চেষ্টা করেছি। লেখকদের জীবনবোধ কতোটুকুই আর বুঝেছি তখন- খুব বেশি নয়।

পরবর্তী সময়ে লেখালেখি করতে গিয়ে বিস্তৃত হলো সব বুদ্ধিজীবীদের কর্ম আর জীবন নিয়ে লেখাপড়া। একে একে জানলাম শিক্ষক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, সাংবাদিক, গায়ক, প্রকৌশলী, খেলোয়াড়- সবার কথা। স্তব্ধ হয়ে গেছি তাঁদের জীবনবোধ, জীবনচর্চা আর কর্মতৎপরতা জেনে।

প্রথমেই লাড়ু ভাইয়ের কথায় আসি। এস এম মান্নান, যিনি ‘লাড়ু ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন; পূর্ব পাকিস্তানের খেলাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, বাঙালি খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনি কী পরিশ্রম যে করতেন! এগুলো জেনে বিস্মিত হয়েছি। এক সময় খেলার খবর ছোট করে একটু ছাপা হতো। তিনি চেষ্টা করে পত্রিকায় খেলার জন্য আলাদা ‘পাতা’ প্রকাশ করেছিলেন। দৈনিক অবজারভারে খেলার পাতার সম্পাদক ছিলেন তিনি। খবর সংগ্রহের জন্য নিজে খেলার মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর লেখা পড়বার জন্য দেশের মানুষ অপেক্ষা করে থাকতো। খেলায়োড়দের প্রতি বৈষম্যের কথা লিখতেন তিনি। এক সময় তিনি ফুটবল খেলতেন, তাই খেলোয়াড়দের মনোবেদনা অনুভব করতে পারতেন। সেই বেদনা জাতিগত বেদনা হয়ে ফুটে উঠতো তাঁর লেখায়। তখন টিনের চালের ‘ঢাকা স্টেডিয়াম’ ছাড়া আর কোনো কিছু ছিল না খেলোয়াড়দের জন্য। বাংলার খেলোয়াড়দের অধিকার আদায়ের জন্য লাড়ু ভাই ছিলেন সোচ্চার। এ কারণে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না থেকেও পাকিস্তানিদের শত্রু  হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ১৮ তারিখ লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজারে। লাড়ু ভাইকে আমি অনুভব করবার চেষ্টা করেছি। তিনি খেলার মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইতেন। তাঁর গণ্ডিতেই তিনি ছিলেন যোদ্ধা। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ছিলেন দুর্নিবার। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা নয়, খেলোয়াড়ের অধিকার। ভালো খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতীয় দলে বাঙালি খেলোয়াড় থাকা মানেই বাঙালি জাতির সম্মান। এবং সে সম্মান ছিল আমাদের প্রাপ্য। প্রাপ্য অধিকার আদায় করবার জন্য তিনি কলমযোদ্ধা। কলমযোদ্ধা এবং শিক্ষক মুনীর চৌধুরী বাংলা বর্ণমালা বাঁচাবার তাগিদে এবং বাংলা ভাষাকে সহজে ছাপানোর জন্য আবিষ্কার করেছিলেন বাংলা টাইপ রাইটার। পাকিস্তানিরা যখন চেয়েছিল রোমান হরফে বাংলা ভাষা লিখতে বাঙালিদের বাধ্য করবে এবং চিরতরে বাংলা ভাষা ধ্বংস করবে, তখন ‘বাংলা টাইপ রাইটার’ বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। এই টাইপ রাইটার তৈরিতে আরও একজন মুনীর চৌধুরীর সাথে ছিলেন, তিনি সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ আখতার। বাংলা বর্ণমালা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ মানুষের মধ্যে জাগরণ তুলেছিল। আবার সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেক সাংবাদিক, যাদের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতেন জাতীয়তাবোধ। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে দিতেন মেলাঘরের। আরেকজন শহীদ বুদ্ধিজীবী আ ন ম গোলাম মোস্তফা। তিনি যুদ্ধের সময় চৌধুরী মঈনুদ্দীনের সামনে পূর্বদেশ অফিসে পালন করেছিলেন পহেলা বৈশাখ। সুযোগ বুঝে পত্রিকায় প্রকাশ করতেন বাঙালিদের বিজয়ের কথা। ভয় পেতেন না বাঙালিয়ানা জীবনাচরণে। তাদের জীবনাচরণই যেন ছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। 

প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীর জীবনচর্চা আলোচনা করলেই দেখা যায় নিজের গণ্ডিতে থেকেই বাঙালি জাতিসত্তা বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। বাইরে থেকে হয়তো বোঝা যেতো না কিছুই, কিন্তু ভেতরে চলতো অগ্নিদগ্ধ প্রত্যয়। সে রকম আরেকজনের কথা বলতে চাই- কবি মেহেরুন্নেসা। যিনি মা, ছোট দুই ভাই আর অসুস্থ বাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটতেন। ভালো কোনো চাকরি করতেন না, সংসার চালানোই হতে পারতো তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতির দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। ফিলিপস রেডিও কোম্পানিতে যখন তিনি চাকরি করতেন, তখন চাকরি বাঁচানোর জন্য মুখ বুজে কাজ করবেন- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি তা করেননি। ওই কোম্পানি থেকে ইংরেজি আর উর্দু পত্রিকা প্রকাশ হতো- এটা দেখে তাঁর মনে জাগতো বাংলা পত্রিকা প্রকাশের কথা। বাংলাদেশে কেন উর্দু-ইংরেজি পত্রিকা? এখানে বাংলায় পত্রিকা হবে; হতেই হবে। তিনি কোম্পানিতে সবার সাথে কথা বলা শুরু করেছিলেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিন্মশ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত। এবং অনেক বাধা সত্ত্বেও বাংলায় পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন ফিলিপস রেডিও কোম্পানি থেকে। মিছিলের সামনে তাঁকে দেখা যেতো, আবৃত্তির মঞ্চে তাঁকে দেখা যেতো, পত্রিকার পাতায় তাঁর কবিতা ছাপা হতো। প্রতিটি কাজ ছিল দেশের প্রতি নিবেদিত। মাতৃভূমিকে তিনি যেমন করে অনুভব করতেন, তেমন করেইি লিখতেন। তাঁর লেখা শেষ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন:
        বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
        চিরবিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।
        আনো দেখি সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি,
        চিরবিজয়ের অটল শপথ, এ জয় বাঙলা ভূমি।

আহা! মেহেরুন্নেসা!! জীবনাচরণেও তিনি ছিলেন স্বাধীনতাপ্রত্যাশী মানুষ। ছোট দুই ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে। আবার নিজের বাড়ির ছাদে তুলেছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। মেয়েদের এমন দুঃসাহসী কাজ দেখে চুপ করে থাকেনি পাকিস্তানের দালালরা। তাই ২৭ মার্চে কাদের মোল্লা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা বাড়িতে ঢুকে পরিবারের সবাইকে জবাই করে রেখে যায়। মেহেরুন্নেসার মাথা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেয়। মাথা থেকে রক্ত পড়ে টপটপ করে। সেই রক্ত দিয়ে কাদের মোল্লা গোসল করে। মেহেরুন্নেসার কথা পড়ে, জেনে আমি শিউরে উঠেছিলাম। শিউরে উঠেছিলাম সেলিনা পারভীনের কর্মকাণ্ডের কথা জেনেও। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম তাঁর মৃত্যুর সময়ের কথা জেনে। সন্তানের জন্য তিনি আর্তনাদ করেছিলেন। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী, যিনি রাও ফরমান আলীর কাছে গিয়ে নিজের ‘শিলালিপি’ পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি মৃত্যুর সময় সন্তান সুমনের জন্য আর্তনাদ করেছিলেন। মাতৃসত্তার অনন্য দৃষ্টান্ত এখানে পাওয়া যায়। তবুও তিনি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। সন্তানকে একা ফেলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কী করেননি তিনি? পত্রিকা বিক্রির সব টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন। খাবার আর কাপড় যোগাড় করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। কয়েকটি মেয়েকে সাথে নিয়েছিলেন এই কাজগুলো করার জন্য। ছেলের হাত ধরে একাই চলে যেতেন ওষুধের দোকানে। বিভিন্ন দোকান থেকে অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাতেন। কাজগুলো তিনি করতেন একা। কোনো সংগঠনের সঙ্গে নয়। বুঝতে পারি দেশের দায় নিজেকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়; কোনো দিকে বা কারো দিকে না তাকিয়ে। হোক তা বিচ্ছিন্নভাবে। এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একসঙ্গে একটি বড়ো ঘটনায় রূপ নেবে। এমন কতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মিলে এসেছে স্বাধীনতা!

অবাক হয়ে চিন্তা করি ডা. আজহারুল হকের কথা। বিহারীদের অভয়ারণ্য মোহাম্মদপুর আর মিরপুরে তিনি রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের চিকিৎসা করতে যেতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. রাব্বিসহ আরও অনেক ডাক্তার গোপনে যেতেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে। যাওয়ার সময় গাড়ির বনেট ভর্তি করে নিয়ে যেতেন ওষুধ। কতো কষ্ট করে এই ওষুধগুলো যোগাড় করতেন তারা! কী করে ভুলি আলতাফ মাহমুদকে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে তাঁর গান। পাকিস্তানিরা এবং পাকিস্তানপন্থীরা যখন গান নিষিদ্ধ করে দিতো, তিনি তখন কৌশলে জনসভায় গান শোনাতেন। যুদ্ধের সময় তাঁর বাড়িতে বসে পরিকল্পনা হয়েছিল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে হামলা করার। তিনিই গেরিলাদের এঁকে দিয়েছিলেন নকশা। রাতের আঁধারে স্টুডিওতে গিয়ে গানের পুল তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে (যদিও তা পৌঁছায়নি। পথেই ধরা পড়েছিল আর্মিদের হাতে)।

সারা দেশে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল পরিকল্পিতভাবে, তাঁদের প্রত্যেকের কর্মই ছিল এমন। তাঁরা প্রত্যেকে বাঙালি জাতিসত্তার জন্য নিবেদিত ছিলেন। এদের মাধ্যমেই জাতির মনন তৈরি হতো। তাই এরা ছিলেন জাতির মনন তৈরির কারিগর। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল এই কারিগরদের মেরে ফেলে জাতিগঠনে বাধা দিতে, জাতিকে মেধাশূন্য করতে। পাকিস্তানিদের চাওয়া সত্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ তাঁদের শূন্যতা।

ছোটবেলায় বুদ্ধিজীবী বলতে বুঝতাম একসঙ্গে ছাপানো ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি। আর আজ সেই ছবির মানুষগুলো আমার কাছে জীবন্ত। তাঁদের বোধ অনুভব করে আমি গর্বিত হই। তাদের অভাব অনুভব করে আমি কষ্ট পাই, শূন্যতা অনুভব করি।  

১২ ডিসেম্বর ২০২১, লালমাটিয়া
লেখক: নাট্যকার, সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়