ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

গ্যাস সংকটে বাংলাদেশ: উত্তরণের উপায় 

সালেক সুফী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ১৫ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৭:৫৮, ১৫ জানুয়ারি ২০২২
গ্যাস সংকটে বাংলাদেশ: উত্তরণের উপায় 

দেশের বিভিন্ন মিডিয়াসূত্রে জানা যাচ্ছে দেশজুড়ে গ্যাস সরবরাহ সংকট রয়েছে। গ্যাস ঘাটতির কারণে এমনিতেই ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১০০০ মেগাওয়াট গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার না করে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। তদুপরি মহেশখালী সমুদ্র উপকূলে স্থাপিত সামিট গ্রুপের এএফএসরু কারিগরি ত্রুটির কারণে কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকায় গ্যাস রেশনিং চলছিল। এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন পরিচালনাধীন বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্যাস সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। 

আরো কয়েকটি গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস সঙ্কট, সিএনজিতেও গ্যাসের নিম্ন চাপ, বাসা বাড়িতে অনেক জায়গায় চুলা জ্বলছে না- বলা হচ্ছে বর্তমান সঙ্কট দূর হতে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে। এমন মুহূর্তে আবার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গ্যাসের আরেক দফা মূল্য বৃদ্ধির কথা ভাবছে পেট্রোবাংলা।  

বাংলাদেশে এখন শীত কাল, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমের এই সময় নিবিড় জলসেচ শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সবাই জানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো অনেকটাই জ্বালানি গ্যাস নির্ভর। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনাহীনতা, অদূরদর্শিতার কারণে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন এখন ক্রম অবনতিশীল। ২৭৫০ এমএমসিএফডি উৎপাদন ক্ষমতা কমে এখন ২৫০০ এমএমসিএফডি। বিজ্ঞজনেরা বলেন চলতি ধারায় ২৩০০ শেষ নাগাদ দেশীয় উৎপাদন কমে ২২০০ এমএমসিএফডি হয়ে যেতে পারে। 

দেশের গ্যাস ঘাটতি সামাল দেয়ার জন্য মাতারবাড়িতে দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রেগ্যাসিফিকেশন ইউনিট স্থাপিত আছে। ক্ষমতা ১০০০ এমএমসিএফডি হলেও সর্বোচ্চ ৮৫০ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে একটি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে ৪৫০ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি পরিচালিত গ্যাস সঞ্চালন ব্যাবস্থায় ২৯৫০ এমএমএফসিএফডি পাওয়া যাচ্ছিল। চাহিদা শীতের কারণে কিছুটা কমলেও ৩৫০০ এমএমসিএফডি। এমতাবস্থায় বিবিয়ানা থেকে ১০০ এমএমসিএফডি কম আসায় সরবরাহ আরো কমে গাছে। গ্যাস সংকট তাই তীব্র। 

হয়তো অচিরে সামিট গ্রুপের এফেসারও চালু হবে, শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র পুরো মাত্রায় (১৩০০ এমএমসিএফডি ) উৎপাদন শুরু করবে। কিন্তু এরপরও ৬০০-৭০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি সহসা মেটানো দূরের কথা আগামী ২-৩ বছরে আরো বাড়তে থাকবে। অথচ এলএনজি আমদানি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার কারণে সরকারের পক্ষে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না।  

খাত বিশেষজ্ঞরা কিন্তু গত দেড় দশক ধরে নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নের তাগিদ দিয়ে আসছেন। আমলাতন্ত্র নির্ভর জ্বালানি মন্ত্রণালয় না পেরেছে নিজেদের আবিষ্কৃত কয়লা সম্পদ তুলতে, না পেরেছে জলে-স্থলে অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাস উৎপাদন প্রয়োজনীয় হরে বাড়াতে। উপরন্তু সকারের কিছু উপদেষ্টার ভ্রান্ত উপদেশে আমদানিকৃত প্রাথমিক জ্বালানীর পেছনে ছুটে সেখানেও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

বিশ্ব বাজারে প্রাথমিক জ্বালানির মূল্য সঙ্কট চলছে। নানা ব্যবস্থা গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও তেল, গ্যাস, এলএনজি মূল্য এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে। বাংলাদেশ ১০ মার্কিন ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ মূল্যে এলএনজি কিন্তু তা এখন কিনতে হচ্ছে ২৮-৩০ মার্কিন ডলার মূল্যে। সরকারি সূত্র মতে চলতি অর্থ বছরে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সার উৎপাদন খাতে ৭০,০০০ কোটি টাকা সাবসিডি প্রয়োজন। অথচ চলতি বাজেটে এই সব খাতে বরাদ্দের চেয়ে প্রয়োজন ২০,০০০-২৫০০০ কোটি টাকা। যে পরিমান জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ। অনেকের মতে সেই ২০০০ থেকে অনুভূত জ্বালানি সঙ্কট আমলে নিয়ে পেশাদারী দক্ষতায় নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি এড়ানো যেত। 

সরকার দেরিতে হলেও আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে স্থল ভাগ থেকেই ৮-১০ টিসিএফ নতুন গ্যাস উৎপাদনের লক্ষে উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত বাপেক্স নির্ভর এই উদ্যোগ কতটা সার্থক হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে সন্দেহ আছে। এফেসারেও নির্ভরযোগ্য না হলেও আরো একটি নতুন টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মাতারবাড়িতে ল্যান্ড বেজড টার্মিনাল স্থাপন নিয়ে আশাবাদ থাকলেও ২০২৭-২৮ সালের আগে চালু হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পায়রায় গভীর সমুদ্রে এলএনজি অবকাঠামো স্থাপন করে সাবসি পাইপ লাইনের মাধ্যমে আমদানি এবং ভারত থেকে আমদানীর দুটি প্রস্তাব অর্থ কারিগরীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না বলা যায়। ক্ষণে ক্ষণে মত পাল্টানো জ্বালানি মন্ত্রণালয় ১০০০-১২০০ এমএমসিএফডির বেশি এলএনজি আমদানি নির্ভর হতে চাচ্ছে না। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো কন্টিনজেন্সী পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়। 

এমন যখন পরিস্থিতি সেই সময় আরেক দফা গ্যাস, বিদ্যুৎয়ের মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করবে।  সরকার এমনিতেই নানা কারণে দেশে বিদেশে চাপের মুখে আছে। এই মুহূর্তে গ্যাস, বিদ্যুৎয়ের মূল্য বৃদ্ধি চক্রাকারে জীবনযাত্রার সব স্তরেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটাবে। বাংলাদেশের শিল্প খাত বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্প খাত প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ বর্তমান হারে জ্বালানি সেক্টর আমদানি নির্ভর হতে থাকলে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া উপায় থাকবে না। প্রয়োজনে সাবসিডি বাড়িয়ে, অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাত থেকে বরাদ্দ কমিয়ে গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি অন্তত ২০২২ সালে না করার সুপারিশ করবো। একই সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন আরো নিবিড় আর জোরদার করতে হবে। গ্যাস ভ্যালু চেন সকল স্তরে দক্ষতা বহুগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। 

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়