ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শাবিপ্রবি’র ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন   

নজরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ২৮ জানুয়ারি ২০২২  
শাবিপ্রবি’র ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন   

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। যে কারণে এই বিদ্যাপীঠের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।

সম্প্রতি আমি বাংলাদেশে ছিলাম। সিলেট থেকে বিমান সরাসরি আমাকে হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়েছে। নিজ শহর থেকে সরাসরি লন্ডনে ফ্লাইট অনেক গৌরবের। যাই হোক, দেশে থাকতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি নিয়ে খুব বেশি জানার সুযোগ হয়নি। যদিও দেশজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল। যতটুকু জানতে পেরেছি লন্ডনে আসার পরে। ফলে এ ব্যাপারে আমার মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে এবং কিছু প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে যা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত হিসেবে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

প্রথমত একজন প্রভোস্টের পদত্যাগ নিয়ে আন্দোলন কেন ভিসি’র পদত্যাগের দিকে ধাবিত হলো? দুই. উপাচার্য মহোদয় যখন বলেছেন, অভিযুক্ত প্রভোস্ট করোনাক্রান্ত, আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও, তোমাদের সমস্যার সমাধান আমি করবো। তারা কেন সময় দিলো না? কী এমন তাড়া ছিল তাদের? তৃতীয়ত, তারা কেন পরিবেশ অশান্ত করে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে চরম অসদাচরণ করলো? হলের একজন প্রভোস্টকে অপসারণের দাবিতে তারা ১৬ তারিখ ভিসিকে আইসিটি ভবনে প্রায় ২ ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রাখলো। কেন তাঁর উপর এক সপ্তাহ ভরসা রাখতে পারলো না?

চার. যিনি বিগত চার বছর সফলভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন, কার বা কাদের ইন্ধনে তারা এই চার বছরের সুফল ছুঁড়ে ফেলে দিলো? নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তাও করলো না! শাবিতে এখন সেশনজট নেই, তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবদিক থেকে এগিয়ে। এটা মুখের কথা না, প্রমাণিত। তারা নিজেদের স্বার্থ কেন দেখলো না? কী তাড়া ছিল তাদের? পাঁচ. ছাত্রদের অনশন ভাঙানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২৫জন শিক্ষকের মধ্যে তিন ভাগের দুইভাগ প্রথম সমবেতভাবে, পরে যার যার অবস্থান থেকে তাদের কাছে গেছে। তদন্ত হবে এই প্রত্যয় তারা নানাভাবে ব্যক্ত করেছে। কিন্তু একজনের কথাও তারা শুনলো না। শেষে জাফর ইকবাল স্যার এসে তাদের অনশন ভাঙালো। তার অর্থ কি এই না যে, এই ৫২৫ জনের শিক্ষকের মধ্যে একজনের উপর তারা আস্থা রাখতে পারেনি? তাঁরা কি কেউ এদের ভালোবাসে না? তাঁরা কি ছাত্রদের ক্লাস রুমে পাঠদান করাননি?

ছয়. মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যখন তাদের বললেন, তিনি তাদের মাতৃতুল্য, তিনি বিষয়টি দেখবেন। তাদের বললেন, দেখা করতে যাবার জন্য, তারা রাজী হলেন, তারপর ১ ঘণ্টা পরে না করে দিলেন। তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করার মতো চরম ধৃষ্টতা তারা কেন দেখালো? সাত. অনশন ভাঙানোর জন্য সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বারবার তাদের কাছে ছুটে গেলেন, আলোচনায় বসার জন্য অনুরোধ করলেন, তারা কর্ণপাত করলো না কেন?

আট. উপাচার্য মহোদয় বারবার বলেছেন তিনি নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডেকেছেন। কারণ তাঁকে কোষাধ্যক্ষ মহোদয়সহ প্রশাসনের অনেককেই তারা তালাবদ্ধ করেছিল। এখানে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ, হার্ট, ডায়াবেটিস-এর রোগীও ছিলেন, তাদের মুক্ত করা সেই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল- তাই মূলত পুলিশ ডাকা। তিনি তদন্ত করার কথা বলছেন বারবার, তারা কেন মেনে নিচ্ছে না? নয়. তারা উপাচার্য পদত্যাগের ব্যাপারে হ্যাঁ অথবা না-এ অটল। এই পৃথিবীর কোনো আন্দোলন কি হ্যাঁ এবং না দিয়ে শেষ হয়েছে? এটা কী স্বৈরাচারী মানসিকতা না? দশ. তারা আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভিসির আগাম চল্লিশা উপলক্ষে বড় বড় ডেকচিতে রান্না করেছে, এই অর্থ তারা কোথায় পেল?

আমার এগারোকম প্রশ্ন- এক্স সাস্টিয়ানরা ২৮টা বিভাগের কোনো না-কোনো বিভাগের ছাত্র, তারা নিজ বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে, শিক্ষক সমিতি, এমনকী ডিনদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারতেন? সুষ্ঠুভাবে বিষয়টি সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারতেন, তা না করে সরাসরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলেন? কী এমন তাড়া ছিল তাদেরও? ৫২৫ শিক্ষকের  মধ্যে কী ভরসা করার মতো,  আলোচনার যোগ্য একজন শিক্ষকও তারা পান নি?

বারোতম বিষয়টি হলো- আন্দোলনের নামে ভিসির বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস, নেট লাইন কেটে দেয়া, খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ করতে না দেয়া- এই বর্বরতা কেন? তেরো, আইডি কার্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার কথা বলার পর আন্দোলনকারী ছাত্র এত কমে গেল কেন? তারা কোথায়? তবে কী আন্দোলনকারীদের চেয়ে বহিরাগতরাই বেশি ছিল? পনেরো. একটা মহল তাঁকে ‘গার্মেন্টস ব্যবসায়ী’ বলে কটাক্ষ করেছে। একজন শিক্ষক, একজন উপাচার্যর পরিবার যদি ব্যক্তিগতভাবে কোনো ব্যবসায় জড়িত থেকে, সততার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তবে একে ইতিবাচকভাবে না দেখে, নেতিবাচক হিসাবে কেন দেখা হচ্ছে? সতেরো. ৩২০ একরের বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত করলেন। চারপাশে দেয়াল দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পিসিআর টেস্টের জন্য ল্যাব তৈরি করলেন, যার মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেটবাসী সেবা পেলেন, এখনো পাচ্ছেন। করোনাকালীন ছাত্রদের অনলাইন ক্লাস পরীক্ষা চালু রাখলেন। দুস্থ ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা দিলেন। এখনও তা জারি রেখেছেন। ইত্যাদি অজস্র ইতিবাচক কাজ এখনও তিনি নীরবে করে যাচ্ছেন। এই বিষয়গুলো ছাত্ররা একটিবারের জন্য বিবেচনায় এনে আলোচনায় বসার মতো উদারতা কেন দেখাতে পারলো না? 

আঠারো. আমি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যের অধিবাসী। এদেশেও তো নানা ধরনের প্রতিবাদ হয়। ছাত্ররাও করে। তবে এতো কদর্য ভাষা এরা ব্যবহার করে না। প্রতিবাদের ভাষা এতো অশালীন কেন হবে? পরিশেষে যা বলতে চাই- এ বিদ্যাপীঠ আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের-বাইরের রাজনীতির মারপ্যাঁচকে পেছনে ফেলে এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদের। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিনীত  অনুরোধ রইলো, তিনি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই আন্দোলনের নেপথ্যের ইন্ধনকারী এবং পুরো ঘটনার সঠিক চিত্র সবার সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। এবং এর আশু সমাধান করবেন। 

লেখক: ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর নেশনাল হেলথ সার্ভিস, লন্ডন
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়