ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার জয় বাংলা ও আইনের জয় বাংলা

স্বদেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪১, ৯ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৬:৫৫, ৯ মার্চ ২০২২
আমার জয় বাংলা ও আইনের জয় বাংলা

১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে জুলাই আগস্ট মাসের দিকে কনজাংটিভাইটিস রোগ হয় শিবিরগুলোতে। শতকরা একশভাগ না হোক, নিরানব্বই ভাগ এই রোগে ভোগে। সাধারণত লোকে কনজাংটিভাইটিস খুবই কম বলে। সবাই বলে ‘চোখ ওঠা’ রোগ। কিন্তু রোগ ছড়িয়ে পড়তেই এর নাম হয়ে গেলো ‘জয়বাংলা’ রোগ। 

ভারতীয় যাদের ‘চোখ ওঠা’ রোগ হতে লাগলো তারাও বলতো ‘জয়বাংলা’ হয়েছে। শুধু এই রোগের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের শিল্পীরা বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতেন, যাত্রা করতেন। সবই দেশাত্মবোধক। আমরা শুনতাম জয়বাংলার শিল্পীদের গান হবে। আজকের যাত্রাপালা জয়বাংলা’র। 

আসলে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ ও জয়বাংলা স্লোগান তখন সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দেয়া হয়েছে। নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনী জয় হিন্দ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ভারত, ভারতের মানুষও জয় হিন্দ কখনো এক হয়নি। অন্যদিকে ১৯৪৬/৪৭ সালে ‘হাত মে বিড়ি, মু মে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আর ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষও পাকিস্তান জিন্দাবাদ কখনও এক হয়নি। আমার ক্ষুদ্র ইতিহাস পাঠে আমি এখনও খুঁজে পাইনি একটি দেশের রণধ্বনি ওই দেশের মানুষ ও দেশের সমার্থক হয়েছে।  ঘটেছে কেবল জয়বাংলার ক্ষেত্রে। 

শরণার্থী শিবিরে সেদিন আমাদের গায়ের জামা ময়লা ছিল, পরণের প্যান্ট ছেঁড়া ছিল, মাথার চুল পরিচর্যাহীনতায় দারিদ্র্যকে প্রকট করতো, থাকতে হতো তাবুর ভেতর খড়ের ওপর শুয়ে। তারপরেও সেদিন আমরা কেন যেন খুব বুক ফুলিয়ে বেড়াতাম জয়বাংলার লোক বলে। পয়সার অভাবে সিনেমা হলে ঢুকতে পারতাম না। কিনতে পারতাম না পাঁচ নয়া পয়সার চিনে বাদাম। তারপরেও শুস্ক মুখে কোনো হতাশার ছাপ পড়তো না। কারণ, আমরা জয়বাংলার লোক। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা চলার পরে ২৭ মার্চ কার্ফু তুলে নিলে স্রোতের মতো মানুষ ঢাকার বাইরে যাত্রা শুরু করে। তাদের থেকে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে ভারতের পথে রওনা হয়। অনেকে দেশের ভেতর নানান জায়াগায় ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গড়ে তোলে। ওই ২৭ তারিখে যারা ঢাকা ছেড়েছিলেন, তাদের ভেতর যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের কাছে খোঁজ নিলে জানা যাবে, ওইদিন তাদের কারো হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু বুকের ভেতর একটা বজ্র ছিল। সেই বজ্র ‘জয়বাংলা’। বুকের ভেতর এই একটি মাত্র অস্ত্র নিয়ে সেদিন মানুষ দেশকে মুক্ত করতে বের হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালদের তাড়া খেয়ে, বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার ফলে যে লাখ লাখ লোক সেদিন সর্বস্বহারা হয়ে ভারতের পথে রওনা দিয়েছিল, তাদেরও কিন্তু সেদিন একটি ভরসা, একটিই আশ্রয় ছিল- তা জয়বাংলা। 

চলার পথে কোথাও যদি জয়বাংলা শব্দ সেই সব শরণার্থীর কাফেলা শুনতে পেয়েছে, তখনই তাদের শরীর শিউরে উঠেছে। তারাও পিপাসার্ত, ক্ষুধার্ত মুখ ও শরীর নিয়ে বলেছে ‘জয়বাংলা’। আর ওই যারা জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছিল তারা এগিয়ে নিয়ে এসেছে তাদের জন্যে পানি, চিড়ে, গুড় নিয়ে। তাই সেদিন ওই তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালানো মানুষদের ভরসা ছিল মাত্র দুটি শব্দ- জয় বাংলা। যা শুনলে তাদের চোখে আলো জ্বলে উঠতো। 

যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে গল্প শোনাতো, কীভাবে তারা যুদ্ধে জিতল। প্রায় শতভাগ গল্পের ভেতর একটা বিষয় মিলে যেতো, তাদের থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সংখ্যায় বেশি ছিল কিন্তু ওরা জয়বাংলা স্লোগান শুনেই ভীত হয়ে যেত তারা। আর রাজাকার, আল-বদরদের নিয়ে কত গল্প যে শুনেছি- তারা শুধু জয়বাংলা স্লোগান শুনেই অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যেতো। 

হ্যাঁ, এটা সত্য, এদেশের রাজাকার, আল-বদররা জয়বাংলাকে ভয় পেতো। কিন্তু তারা জয়বাংলা কণ্ঠে তুলে নেয়নি। কিন্তু তারপরেও জয়বাংলা আর দেশের মানুষ সমার্থক ছিল। এই জয়বাংলা থেকে সরে আসার সূচনা হয় দেশ স্বাধীনের পরপরই। যারা জয়বাংলার স্রষ্টাদের মধ্যে ছিলেন। যাদের কণ্ঠে গর্জে উঠেছিল জয়বাংলা- এমন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সেদিন জাসদে যোগ দিলো। তারা তাদের কণ্ঠ থেকে ফেলে দিলো জয়বাংলা। তারা সেদিন একবারও ভেবে দেখেনি, জয়বাংলা ফেলে দেওয়া মানে বাংলাদেশের মানুষ আর বাংলাদেশকে ফেলে দেওয়া। সেদিন তারা সে কাজই করেছিল। এমনকি জয়বাংলা বলে যে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী, মোজাফ্ফর ন্যাপের কর্মী মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তারাও ফিরে এসে কণ্ঠ থেকে ফেলে দিলো জয়বাংলা। ওই একই ঘটনা ঘটলো তারাও বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষকে ফেলে দিলো। যে কারণে আজ তাদের সঙ্গে বাংলাদেশও নেই, বাংলাদেশের মানুষও নেই। জাসদের পতাকা তলে জয়বাংলাহীন অনেক মানুষ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট অবধি ছিলো। কিন্তু যেই তারা তাদের পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ফিরে পেলো তারা তাদের জায়গায় ফিরে গেলো। জাসদ তাদের ভুল-ভ্রান্তিসহ গুটিকয়েক অসহায় অর্ধমৃত সৈনিক নিয়ে এসে আশ্রয় নিলো আওয়ামী লীগের পতাকা তলে। 

আর ওই পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পরে যারা রাস্তায় জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা দেয়াল লিখনে জয়বাংলা লিখেছে তাদেরকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক বুদ্ধিজীবি নামধারী মানুষ বলেছেন, এটি ভারতের জয় হিন্দের অনুকরণে তৈরি জয় বাংলা। তারা এভাবে বাঙালির প্রাণের বজ্রানলকে ভারতীয় বলে চিহ্নিত করেছে। আবার আরো চতুর বুদ্ধিজীবিরা বলেছে, জয়বাংলা তো সবাই বলতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় স্লোগান বানিয়েছে বলে সবাই বলতে পারে না। অদ্ভুত যুক্তি। আওয়ামী লীগের সেই দুর্দিনে, দুর্দিনের কর্মীরা (যাদের সঙ্গে বর্তমানের কর্মীদের মেলালে অপমান করা হবে) জয়বাংলা বলছে জীবনের দায় নিয়ে, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তাকে প্রশংসা না করে বলা হচ্ছে- ও দলীয় স্লোগান বানাচ্ছে বলেই তো জয়বাংলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে বুদ্ধিজীবি নষ্ট হলে তার থেকে বেশি গন্ধ আর অন্য কোনো কিছু থেকে বের হয় না। কারণ এ নষ্ট স্বাভাবিক নয়। একজন রাজনীতিক নষ্ট হতে পারেন। এটা সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বুদ্ধিজীবি নষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক- তাই গন্ধটা বেশি ছড়ায়। আর তাই ঘটেছে ১৯৭৫ এর পরে এই জয় বাংলার দেশে। 

এর পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ স্বল্প পরিসরে ক্ষমতায় এলে জয় বাংলা ওইভাবে আর ফিরে আসেনি। কিন্তু ২০০৯-এ ক্ষমতায় এলে ২০১২ তে গণজাগরণমঞ্চের মাধ্যমে জয় বাংলা স্বাভাবিকভাবে সেই ৭১-এর মতো বুকের বজ্রানল হয়ে তরুণদের মধ্যে ফিলে এলো। কিন্তু সে সফলতা জয়বাংলার পক্ষের লোকেরা ধরে রাখতে পারলো না। সফল রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়া শুধু ছিনিয়ে নিয়ে যায়নি জয় বাংলা, আমাদেরকেও নিশ্চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি গণজাগরণের বিপরীতে গড়ে তুলেছিলেন হেফাজত। আর সেই হেফাজতের তাড়নায় আমরাও মাথা নত করে জয় বাংলার গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেই। এমনকি শেষ অবধি মাথা নত করি হেফাজতের কাছে। জয় বাংলা আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করে। 

এর পরে বছর তিনেক আগে একদিন অ্যাডভোকেট ড. বশীর আহম্মেদ বললেন, তিনি জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন। প্রায় প্রতিদিন তিনি তাঁর মামলা নিয়ে বলতেন। কারণ এক সঙ্গে এক্সারসাইজ করতাম। তাই প্রতিদিন দেখা হতো। তারপরে একদিন তিনি হাইকোর্টে জিতলেন। জিতবেনই তো। কারণ, জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান, এতো, রক্ত দিয়ে, আব্রু দিয়ে, মৃত্যু দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। একে হাইকোর্ট ‘না’ বলবে কীভাবে! 

সেদিন অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেল টক শোতে ডেকেছিল। বলেছিলাম, হাইকোর্টের জয় বাংলা এসেছে। আমার জয় বাংলা এখনও ফেরেনি। সর্বশেষ ক্যাবিনেট আইন পাশ করে জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান করেছে। হাইকোর্টের আইন, কেবিনেটেরও আইন। জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান ভুল নেই কোনো। কিন্তু আমার সেই বাংলাদেশের সমার্থক, বাংলাদেশের মানুষের সমার্থক, সেই জয় বাংলার লোক পরিচয়ের জয় বাংলাকে আমি এখনও খুঁজছি। আর শুধু আশা করছি, আমার বাকি জীবনে যদি না খুঁজে পাই, আমার সন্তান যদি না খুঁজে পায়- কোনো এক প্রজম্ম খুঁজে পাবেই সেই জয় বাংলার লোকের জয় বাংলা।
জয় বাংলা।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক   

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়