ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মানুষকে ঠকানোর এই যজ্ঞ ঠেকাতে হবে 

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ৫ এপ্রিল ২০২২  
মানুষকে ঠকানোর এই যজ্ঞ ঠেকাতে হবে 

স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। মূলত বর্তমান সরকারের রূপকল্প -২০২১ আমাদের দুভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। প্রথমত, আমাদের এগিয়ে চলার লিখিত রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের এ মর্মে প্রতীতি জন্মেছে যে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

রূপকল্প -২০২১ এর আলোকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাস্তবতায় আমরা এখন রূপকল্প- ২০৪১ এর যাত্রী। জাতিসংঘ প্রণীত দেশগুলোর বিভাজনে আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাব। সে ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজয়ের ৫০তম বর্ষে আমরা সে শপথ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা আমাদের আশবাদী করে। 

একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়া অনেক বিস্তৃত। এ পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। অর্থনীতির ব্যাপক রূপান্তর এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তি চরিত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। আমাদের সত্যবাদী হয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর ও সত্যনিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যের প্রতি অনেক বেশি সহিষ্ণু হতে হবে। বিষয়টি এ রকম যে, একটি সত্যনিষ্ঠ সমাজ গঠন ও ব্যক্তি জীবনে সহিষ্ণুতা অর্জনই আমাদের উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, উল্টো করে ভাবার সুযোগ নেই। উন্নত বাংলাদেশ হলে আমরা সবাই সত্যবাদী ও সহিষ্ণু হয়ে যাব বিষয়টি সেরকম নয়। 

নিজের জীবনে জাম্বুরা ক্রয়ের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। কারওয়ান বাজারে জাম্বুরা কিনতে গিয়েছি। এক হালি কেনার ইচ্ছা ছিল। বিক্রেতাকে তার জাম্বুরা নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হওয়ায় দুই হালি কিনে নিয়ে আসি। বাসায় আনার পর দেখলাম মাত্র দুটি জাম্বুরা কিছুটা খাওয়ার যোগ্য। বাকিগুলো ফেলে দিতে হয়েছে। আরেক দিনের ঘটনা। অফিস থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যায় কলাবাগান বাজার থেকে এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে সেই একইরকমভাবে প্রতারিত হয়ে ছয়টি জাম্বুরা কিনে আনি। একটিও খাওয়ার উপযোগী ছিল না। তারপর আরও একদিন কাঁঠালবাগান থেকে জাম্বুরা কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হই। গত গ্রীষ্মে কাঁঠাল কিনতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে ২৫০ টাকা দিয়ে কাঁঠাল কিনে এর একটি বিচিও খেতে পারিনি।

সব ধরনের কেনাকাটায় এরকম অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুধু জাম্বুরা, কাঁঠাল, পেঁপে কিংবা আনারস নয়, আমাদের দৈনন্দিন সব কেনাকাটায় প্রায়ই আমরা লোকসানের মুখামুখি হচ্ছি। বোধকরি, অনেকেরই আমার চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার রয়েছে। অথচ যখন উন্নত দেশ হবে তখন বিক্রেতাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাসের এ জায়গা পুরো বিপরীতরূপে পরিবর্তিত হতে হবে। আমাদের সত্য ও সুন্দর একটি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে। 

পরিচিত একজন আমার আক্ষেপ শুনে বললেন, জাম্বুরাওয়ালা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন গাছের জাম্বুরা সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন। সে ক্ষেত্রে খারাপ হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েই যায়। এ প্রসঙ্গে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিক্রেতার মিথ্যা বলার ধরন ও অতিরিক্ত চাপাচাপি করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। না জেনে ক্রেতাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া সরাসরি মিথাচারের সামিল। 

মজার বিষয় হচ্ছে, একজন জাম্বুরাওয়ালা ভুলে যান যে তিনি শুধু জাম্বুরা বা আরও দু’তিনটি ফল বিক্রি করেন। তার জীবনধারণের জন্য বাকি সবকিছু বাজার থেকে কিনতে হয়। মাছ, মাংস, কিংবা চাল কিনতে গিয়ে তাকে আরও অনেক ‘জাম্বুরাওয়ালাদের’ মিথ্যাচারের কবলে পড়তে হয়। এতসব জাম্বুরাওয়ালাদের ভিড়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। শুধু পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেই নয় বরং সেবা প্রদানকারীরাও একই আচরণ করছেন। ফলমুলে ফরমালিন মিশ্রণ হোক আর পচা-বাসি খাবার বিক্রি হোক- সবাই যে কোনো উপায়ে নিজের পকেট ভারী করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। বাস মালিকগণ শুধু নিজের হিসাবই করছেন; শিক্ষার্থীদের জন্য যেটুকু ভাড়া কম নেবার প্রয়োজন ছিল তা অনুভব করতে পারছেন না। বাড়ির মালিকগণ ভাড়া আদায়ে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছেন। মার্কেটিং কোম্পানিগুলো প্রতারণার নানান কৌশল প্রয়োগ করছে। হিডেন চার্জের কারণে অনেকক্ষেত্রেই না জেনেই গ্রাহকদের অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে। এ তালিকায় অনেক দীর্ঘ। হয়তো আমিও রয়েছি এ তালিকায়। কেউ বের হতে পারছেন না বলে সবাই মিলে সবাইকে ঠকিয়েই যাচ্ছি। 

চাকুরির সুবাদে এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে পৃথিবীর অনেক দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে। সেখানে কখনোই মনে হয়নি বিক্রেতাগণ মিথ্যা বলে লোক ঠকাচ্ছেন। এমনকি গরিব ট্যাক্সি ড্রাইভারও যা ভাড়া তাই দাবি করছেন, বিপদ বিবেচনায়ও বাড়তি ভাড়া দাবি করছেন বলে কোথাও দেখিনি।

এই রমজান মাসের কথাই বলি, রমজানের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। রমজান মাস এলে এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। অথচ রমজান সহিষ্ণুতা শিখানোর মাস। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যেখানে তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে পণ্য বিক্রিতে ছাড় দেয় সেখানে রমজানে আমাদের দেশের চিত্র ঠিক বিপরীত। ব্যক্তিগত লোভের কাছে সবকিছুই তুচ্ছ। বছরজুড়ে যে ধর্মীয় ওয়াজ-নসিয়ত হয় তা আসলে আমাদের ব্যক্তি জীবনে খুব একটা কাজে আসে না।

আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। ভোক্তার সন্তুষ্টিকে কেউ তোয়াক্কা করছেন না; যদিও আলাদা আলাদাভাবে সবাই নিজে ভোক্তা। ব্যক্তি পর্যায়ের ভোগ একটি দেশের মোট জিডিপির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। ব্যক্তি পর্যায়ের ভোগ কমে গেলে দেশের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যায়। কারণ ভোগের মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট এর মাধ্যমেই অর্থনীতি এগিয়ে যায়। তবুও ভোক্তার সন্তুষ্টি বিবেচনায় নেয়ার কোনো প্রয়াস নেই। বিভিন্ন রঙিন বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণই বিক্রেতার একমাত্র লক্ষ্য; ক্রেতার সন্তুষ্টি বিবেচ্য নয়। 

মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠনে আমাদের এখনই প্রচেষ্টা নিতে হবে। প্রাণী হিসেবে জন্ম নেয়া একজন ‘মানুষ ছানার’ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য অনেক সাধনার প্রয়োজন। প্রাণীকুলের অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে মনুষ্য-শাবককে জন্মের পর অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত আগলে রাখতে হয়। তাকে খাইয়ে দিতে হয়, কথা শিখাতে হয়, হাতে ধরে হাঁটা শিখাতে হয়। প্রাণী জগতের অন্যান্য সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে যা অনুপস্থিত। তাই এরকম ভাবার কোনো কারণ নাই যে, কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ‘মনুষ্য-শাবক’ সত্যবাদী ও সহিষ্ণু হয়ে গড়ে উঠবে। তার জন্ম থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গড়ে ওঠায় যে সব প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত তাদের সবগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। যদিও দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার কাল তবু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই মানুষের শিখার প্রক্রিয়ায় থাকা উচিত। শিখার এ প্রক্রিয়ায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিবেচনায় নিতে হয় সেগুলো হলো পরিবার, ধর্মীয় উপাসনালয়, বিভিন্ন স্থরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি। 

কষ্টের বিষয় হলেও অনেকাংশে সত্যি যে পরিবার ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। চলার পথে কেউ যদি আপনাকে সম্মান করে কিংবা আপনার জন্য ত্যাগ স্বীকার করে তবে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন তিনি কোনো ভালো পরিবার থেকে আসা সন্তান। তবে উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগের প্রথম লক্ষ্য হবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া একটি সুস্থ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজ গঠন অসম্ভব। সে আলোকেই পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে এবং পাঠদানের সাথে সম্পর্কিত সবাইকে অনন্য উচ্চতায় আসীন হতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য যা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে শিক্ষা বিস্তারের চেয়ে শিক্ষার্থীদের সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত করার শিক্ষাই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। 

মনে রাখা প্রয়োজন, জ্ঞান পাপীদের চেয়ে সত্যনিষ্ঠ একটি মূর্খ সমাজের অবদানও যে কোনো বিবেচনায় এগিয়ে থাকবে। জাম্বুরাওয়ালাদের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়তে হলে সমাধান একটাই- আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সকল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা জানি, বাংলাদেশ এখন জনমিতিক মুনাফা ভোগ করছে যা পরিকল্পিত কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি ৭০ বছর পরপর আসে। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এছাড়া, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ। তাই তারুণ্যে বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। 

স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে সমাজের সকল স্তর হতে মিথ্যাচার পরিহার করে সত্য সমাজ গড়তে তরুণ-তরুণীদেরদের সম্পৃক্ত করতে হবে যারা আগামী বাংলাদেশের কাণ্ডারি হবে। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে না পারলে জাম্বুরাওয়ালারা পাকিস্তানি দোসরদের মতো আমাদের পতাকা খামচে ধরবে। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলতে পারলে জাতির পিতার আমৃত্যু যে ত্যাগ ও স্বপ্ন এর প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে না। সম্মিলিতভাবে মানুষকে ঠকানোর যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তা থেকে পরিত্রাণ না পেলে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে। জাতির পিতার আদর্শ লালিত যে স্বপ্নের সোনার বাংলা সেখানে তথাকথিত জাম্বুরাওয়ালাদের কোনো স্থান নেই।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক
 


 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়