নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি: এই আগুন নিভবে কবে?
সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট ছাপিয়ে রাজনীতির টেবিল- সবখানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা। দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারার ব্যর্থতায় সমালোচনামুখর সবাই। এটাই স্বাভাবিক।
সাধারণ মানুষ এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, তেল সিন্ডিকেট চক্রের হাতে সরকার জিন্মি হয়ে পড়েছে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে তেলের মূল্য। সাধারণ মানুষের এই ধারণা অমূলক নয়। বাণিজ্য মন্ত্রী স্বয়ং এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি তেলের বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতায় হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের ‘বিশ্বাসের সুযোগ’ নিয়েছেন; বেশি লাভের আশায় পণ্য ধরে রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছেন। আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম এটাই আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে।’
মন্ত্রী মহোদয় কতোটুকু বিরক্ত হলে একথা বলতে পারেন, বা ব্যবসায়ীরা কতোটুকু বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তার মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরিয়ে আসতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এতে অন্তত এটুকু বুঝতে পারা গেছে যে, তেল ব্যবসায়ীদের প্রতি আর আস্থার সুযোগ নেই। এখন কথা হলো, অন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি কি আমাদের আস্থা রাখার সুযোগ আছে?
পরিস্থিতি বলছে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কোম্পানীগুলোকে তেল আমদানির সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ সবার জন্য অবারিত করতে হবে আমদানির সুযোগ। অন্তত শত প্রতিষ্ঠান যেন এই সুযোগটুকু পায়! সেইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে চিহ্নিত তেল সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এই দৃশ্যটুকু দেশবাসী অন্তত দেখতে চায়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো- শুধু কি তেলের গায়েই আগুন? বাজারে গিয়ে যেখানেই হাত দেওয়া হচ্ছে- দাম বেশি! তরমুজের মূল্য নিয়েও সাধারণ মানুষকে বিব্রত হতে হয়েছে। যদিও এখন তরমুজ ব্যবসায়ীরা ক্রেতা না পেয়ে নিজেরাই বিব্রত। অনেকেই বেশি লাভের আশায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এটি একটি উদাহরণমাত্র। চাল, ডাল, আটা- যেগুলো না খেলেই নয়; সবজি, মাছ-মাংস সবকিছুর দাম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এ যেন মূল্যবৃদ্ধির এক উৎসব শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। এই উৎসবে ক্রেতাদেরই শুধু আনন্দ নেই। ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।
বাজর থেকে পাঁচ লিটার সয়াবিন যদি ৯৮৫টাকায় কিনতে হয় তাহলে সাধারণ মানুষ অন্যান্য পণ্য কিভাবে কিনবেন? শুধু তেল খেলে তো পেট চলবে না। সাবান, ডিটারজেন্ট, পেন্সিল ব্যাটারী, নুডলস, টুথপেস্ট, কেক, শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে কোন পণ্যের সাম্প্রতিক সময়ে দাম কমেছে? এমন নজির নেই। প্রধান খাদ্য চালের দামই তো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দেশের পেঁয়াজে যখন বাজার ভর্তি তখনও এই পণ্যটি নিয়ে বারবার ব্যবসায়ীরা খেলছেন। রসুনের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মসলার বাজারও চড়া। বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। নতুন চাল ধরে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। পুরনো চাল যেমন বাড়তি, তেমনি নতুন চালও বেশি দামে কিনতে হবে এমন আভাস মিলেছে। সব মিলিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সব শ্রেণীর মানুষের বিরাট রকমের ছন্দপদন ঘটেছে। সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে মানুষের।
সয়াবিন তেল নিয়ে টানা দু’বছর রীতিমতো তেলেসমাতি কারবার চলছে। এক বছরে প্রতি লিটারে দাম বেড়েছে ৬৩টাকার মতো। মানছি পণ্যটি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রপ্তানি বন্ধ করেছে। আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেল রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে তেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা বেড়ে যাবে? এটা কি স্বাভাবিক? যৌক্তিক? যদি অন্যসব পণ্যের দাম সহনীয় থাকতো তাহলে হয়তো আপদকালে তেলের এই উচ্চমূল্য মেনে নেওয়া যেত। সাধারণ মানুষ এখন কোনদিক সামাল দেবে? তাছাড়া এমন তো নয় যে, এ দেশে একটি পণ্যের দাম বিপদকালে বেড়ে গেলেও পরে তা কমে যায়।
আমদানিনির্ভর নয় এমন পণ্যের দামও বাড়ছে লাফিয়ে! এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও বাজারে তেল সোনার হরিণ হয়ে গেল কেন? কারা করলো, তাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ তাদের কঠোর শাস্তি চায়। প্রশাসন অবশ্য অনেক গোডাউনে হানা দিয়ে তেল উদ্ধার করছে। সেগুলো আগের মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থাও করছে। কিন্তু যাদের গোডাউনে মজুদ তেল পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কঠোরভাবে নেওয়া হচ্ছে কি? শুধু খুচরা ব্যবসায়ীদের গোডাউনে নয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা পরিবেশক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাচ্ছে- এমন দৃশ্যও দেখতে চায় সাধারণ মানুষ।
সয়াবিন তেল নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে এতে সন্দেহ নেই। নানা অজুহাতে বিশ্ববাজারে তেল কারবারি সিন্ডিকেট চক্র দাম বাড়িয়ে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। এর সঙ্গে যুক্ত আমাদের দেশের তেল আমদানিকারকরাও। মানুষের পক্ষে অবস্থান নিতে হলে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। কার্যত কাউকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। তাহলে রাষ্ট্রের চেয়ে কি ব্যক্তি, গোষ্টী বা প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়ে গেলো? সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো, গত দুই মাসে চারবার তেলের দাম সমন্বয় করেও বাজার স্থিতিশীল করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ভবিষ্যতে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং সুষ্ঠুভাবে বাজার মনিটরিং করাসহ ব্যবসায়ীরা কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে-সারা বছরের চাহিদার অন্তত ২০ ভাগ টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করা, জিটুজি পদ্ধতিতে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া থেকে তেল আমদানি করা, খুচরা, পাইকারি, ডিলাররা কতদিন ও কী পরিমাণে তেল মজুদ রাখতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া এবং সবার জন্য আমদানি উন্মুক্ত করা উল্লেখযোগ্য। এফবিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে তেল সমস্যা সমাধানে এসব প্রস্তাব সরকার নিশ্চয়ই বিবেচনা করবে। ইতোমধ্যে ডলারে তেল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে। অপরিশোধিত তেল আসছে। এরপরও বাজারে অস্থিরতা লেগেই আছে- এর স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত।
শেষ কথা হলো নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ইস্যুতে সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে আপস নয়, মানুষের স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হলে তাই করতে হবে। সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা করে। জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে সবাইকে। অন্যথায় নিত্যপণ্যের গায়ের আগুন নেভানো সম্ভব হবে না। মানুষের মনে চাপা ক্ষোভের এই আগুন অনেক কিছুই পুড়িয়ে দিতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
/তারা/
আরো পড়ুন