ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মানবিকতা প্রদর্শনীর বিষয় নয়

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৭, ১৩ জুন ২০২২  
মানবিকতা প্রদর্শনীর বিষয় নয়

এ দেশে এখন মানবিকতার প্রদশর্নী চলছে। ‘প্রদর্শনী’ বলছি এ কারণে যে, সবাই নিজে কত বড় উদার, মানবিক সেটি দেখাতেই ব্যস্ত। বড় বড় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটিকে দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতার তকমা লাগিয়ে নামমাত্র কিছু টাকা গছিয়ে দিয়ে ‘ক্ষতিপূরণের’ আওয়াজ তুলে বিরাট মানবিক হয়ে উঠছেন এক-একজন। এমনকী টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছেন মামলা করার অধিকারটুকুও।

নিমতলী, তাজরিন, রানা প্লাজা, রূপগঞ্জ এবং হালের চট্টগ্রামের ঘটনার মতো বাংলাদেশে গত এক দশকে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো সব ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে। মানুষের জীবনের মর্যাদা কিংবা জীবন রক্ষার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে সবাই কে কত মানবিক সেটা প্রমাণের চেষ্টা, এবং বলাবাহুল্য টাকা-পয়সা খরচ করেই। 

পাঠক, গত এক দশকে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন সাধারণ মানুষ। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে অনেকে নিজের জীবনও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। সব কিছু ফেলে ছুটে গেছেন অন্যকে বাঁচাতে। যার যা আছে সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রানা প্লাজায় মানুষ অন্যকে বাঁচাতে জীবন দিয়েছেন। সে স্মৃতি এখনও আমাদের হৃদয়ে উজ্জ্বল। এই মানুষ সাধারণ মানুষ। 

সর্বশেষ চট্টগ্রামের কথাই যদি ধরি তাহলে দেখতে পাবো সেখানেও প্রথম সাধারণ মানুষই আগুন নেভাতে ছুটে এসেছেন। তারা শুধু আগুন নেভাতেই নয়, পানি খাওয়াতে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে, রক্ত দিতে, ওষুধপত্র কিনে দিতেও ছুটে এসেছেন। সেখানকার আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে রিকশা চালকেরা রিকশা ভাড়া পর্যন্ত নেননি। অনেকেই পাঠিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স। ফেইসবুক লাইভ করে অনেকেই সহযোগিতা চেয়েছেন আশপাশের মানুষের কাছে। রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন পড়ে গেছে হাসপাতালগুলোতে। ফেইসবুকেও বিভিন্নজন নিজেদের রক্তের গ্রুপ জানিয়ে রেখেছেন এবং রক্ত দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কাছাকাছি জেলাগুলো থেকেও অনেকে ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে সহযোগিতার করার জন্য। প্রবাস থেকেও অনেকে পাঠিয়েছেন টাকা। কিন্তু এরা কেউই আমাদের কাছে হিরো নন। আমরা ধরেই নিয়েছি ওরা তো করবেই। মানুষ তো এগিয়ে আসবেই। তাদের আমরা চিনি না, তারা হয়তো অর্থবান নন, কিন্তু তারা হৃদয়বান, সবচেয়ে মানবিক। কিন্তু আমরা কখনও হয়তো তাদের কারো নামও জানতে চাইনি, স্বীকৃতি অনেক দূরের বিষয়।

এরই মধ্যে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুন নেভাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ফায়ার ব্রিগেডের দল। কিন্তু তারা আসল খবর জানতেননা। জানতেন না আগুন লেগে যাওয়া সেই ডিপোর ভিতর কী আছে। আগুন লাগার পরেও দীর্ঘক্ষণ এ খবর জানানো হয়নি কাউকে। পানি পেয়ে সেখানে থাকা রাসায়নিক দ্রব্য আরো কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সেই বিস্ফারণেই মারা গেছেন ফায়ার ব্রিগেডের নয়জন কর্মীসহ প্রায় পঞ্চাশ জন। এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরও দুশো মানুষ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আহতদের অনেকেরই চোখে মারাত্মক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো তাদের কথা আমরা ভুলে যাবো। 

আমরা জেনে গেছি, সত্যিকারের মানবিকতা নয় বরং মানবতা প্রদর্শন করা দেশে এখন সবেচেয়ে সস্তা। ত্রাণ দিতে গিয়ে ছবি তোলার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়। পুলিশ অন্তঃসত্ত্বা মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে হাসপাতালে নিয়ে মানবিকতার পুরস্কার পায়। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলেন না- এই সমাজে একজন মানসীক ভারসাম্যহীন নারীকে কে বা কারা র্ধষণ করেছে? অথচ সেই ধর্ষককে খুঁজে বের করা প্রথম কাজ এবং সেটিই পুলিশের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। 

চট্টগ্রাম ডিপোতে আগুনের কারণ হিসেবে প্রথমেই এই ডিপোর মালিকপক্ষ দাবি করেছেন- এটি নাশকতা। আর্থাৎ তাদের কোনো দোষ নেই। অন্য কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এই নাশকতা করেছেন। মালিক রাজনীতিক। এ কারণে তিনি ইঙ্গিত অন্যদিকে করেছেন। তার এই ইঙ্গিত হিসেব-নিকেশগুলো অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। ‘নাশকতা’- এই এক শব্দ ব্যবহার করে তিনি মামলা-বিচার সব দিক থেকেই রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এরপর তিনি পরবর্তী করণীয় ঠিক করে আরও মহৎ হবার অভীষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন। এখন তিনি দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের জন্য ‘নজিরবিহীন মানবিকতা’ দেখাচ্ছেন। এই ঘটনায় ফায়ার ব্রিগেডের নিহতদের ১৫ লাখ, অঙ্গহানী যাদের হয়েছে তাদের জন্য ১০ লাখ এবং আহতদের জন্য ৭ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডিপোর নিহত কর্মকর্তাদের জন্য ১০লাখ, আঙ্গহানীদের জন্য ৬ লাখ এবং আহতদের জন্য ৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

ঘোষণার পর অনেকেই বলছেন, এই প্রথম এ রকম ‘মানবিকতা’র উদাহরণ দেখা গেল! কারণ অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে না। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করবেন না। কারণ তারও এখন এতো বড় একটি ঘটনা দ্রুত ধামাচাপা দিতে ‘মানবিক’ তকমা প্রয়োজন। এই মানবিক তকমার নিচে চাপা পড়বে অনেকগুলো প্রশ্ন- তারা কেন সেই ডিপোতে রাসায়নিক অরক্ষিত অবস্থায় রাখলেন? সেটি কেনো শুরুতে গোপন করা হলো? ডিপোতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না কেন?  

এমন আরো প্রশ্ন রয়েছে যার জবাব জরুরি। জবাবগুলো ঠিক থাকলে তিনি জনগণের কাছে এমনিতেই  মানবিক হয়ে উঠতেন। টাকা দিয়ে ‘মানবিকতা’র তকমা তাকে কিনতে হতো না।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়