ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অপরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের বলি শিক্ষকসমাজ

সৈয়দ জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৩, ২ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১৫:২০, ২ জুলাই ২০২২
অপরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের বলি শিক্ষকসমাজ

হিংস্রতা ক্রমেই গ্রাস করছে চারপাশের মানবিক প্রতিষ্ঠান। এমনকি বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ও এই হিংস্রতার নীল দংশন থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যারা কিছুটা হলেও চিন্তিত ও অভিজ্ঞ তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই ভুল পথে হাঁটছে। এই ভুল পথে আমরা যত সদম্ভে এগিয়ে যাচ্ছি, তত আমাদের মানবিকতা নিম্নগামী হচ্ছে। মানুষ হয়ে উঠছে লোভী, অপরাধী ও দুর্নীতিপ্রবণ। রাষ্ট্র বোধহয় নিজেই চায় না শিক্ষার সমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। জনগণ হোক প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত। তাহলে আমাদের সমাজে আজ যেসব অধঃপতন দেখা যাচ্ছে এগুলো হয়তো কিছুটা হলেও রোধ করা যেত।

বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজ দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্পেষিত। এদের নিষ্পেষণের অনেক কারণ আছে। শিক্ষকদের স্বভাবসুলভ ভদ্রতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জাতীয় নোংরা রাজনীতিই শিক্ষক নিপীড়ণের মূল কারণ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণ শিক্ষা নিয়ে ততটা ভাবেন না, যতটা ভাবেন শিক্ষক নিপীড়নের কৌশল নিয়ে, আমলাদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ঐক্য না থাকার কারণে ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে শিক্ষকসমাজ। মেরুদণ্ড ভেঙে এরা ক্রমে নতজানু হয়ে যাচ্ছে নানাবিধ হতাশায়। হতাশা নিয়ে পৃথিবীতে কোনো কাজই সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায় না। শিক্ষকগণ জাতি নির্মাণের বিরাট কাজে নিয়োজিত। একবুক হতাশা নিয়ে জাতি গঠনের গালভরা কথা উপহাস ছাড়া আর কি হতে পারে? 

উন্নয়নশীল বাংলাদেশে শিক্ষকের সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদা নেই, নেই নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। অদৃশ্য রশিতে শিক্ষকের হাত-পা বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাচীর ঘেরা উঠোনে। এখানে তাকে নেতা শাসায়, আমলা-অফিসার শাসায়, ছাত্র-অভিভাবক আর ম্যানেজিং কমিটির শাসান তো আছেই। এত সব শাসনের মধ্যে থেকে শিক্ষকগণ ভুলেই যান, তাদের আসলে করণীয় কী? মানুষ যখন দ্বিধায় পড়ে, তখন কোনো কাজই সে ঠিকমতো করতে পারে না। শিক্ষকগণ দ্বিধার সাগরে ডুবে আছেন, তাদের পক্ষে এই দ্বিধার সমুদ্র থেকে আশার সৈকতে পৌঁছানো এখন অনেকটাই অসম্ভব।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশে নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছেন শিক্ষকসমাজ। রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর নির্মম শিকার ছিলেন তারা। সে সময় ধর্মীয় মৌলবাদিতার নৃশংসতায় বধ্যভূমিগুলো ভরে উঠেছিল শিক্ষকদের লাশে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আমরা সেই একই চিত্র দেখছি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। কথায় কথায় শিক্ষক হত্যা, শিক্ষকের কান ধরা, জুতার মালা পরিধান করা, এমনকি জেলখানায় বিনা বিচারে আটক রাখা- যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। যেসব অপরাধে একেকজন শিক্ষককে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, সেসব অপরাধের আটানব্বই ভাগই ভিত্তিহীন অথবা সাজানো। নিরীহ শিক্ষকগণের ক্ষমতা নেই, এসব ভিত্তিহীন কিংবা সাজানো অভিযোগের শিকল কেটে মুক্ত হওয়া। কেননা এসব অভিযোগগুলো যারা উত্থাপন করেন, তারা সকলেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান। যারা ক্ষমতার বলয়ে অহর্নিশ জ্যোতিষ্করূপে ঘুরে বেড়ান, তাদের খামখেয়ালি অগ্নি-উত্তাপে শিক্ষকসমাজ জ্বলে পুড়ে ছাই হবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

দৃশ্যত গোটা সমাজ আজ বিপথগামী। এই বিপথগামিতা থেকে সমাজকে রক্ষা করার দায় যেন কেবল শিক্ষকদের একার। আমাদের নির্বোধ সমাজের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন মানুষের সুশিক্ষা নিশ্চিত করবেন শিক্ষক। এই দায় একা কেবল শিক্ষকসমাজের। অথচ তারা ভেবে দেখেন না শিক্ষকদের উপর যে বিরাট দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে দায় যথাযথভাবে পালনের জন্য তার সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে কিনা। কীভাবে সামান্য বেতনের একজন শিক্ষকের দিন চলে, রোগে-শোকে কীভাবে সে দিন কাটায়, জ্ঞানচর্চার জন্য যে পরিবেশ তাকে নিশ্চিত করা  দরকার, সে পরিবেশ তাকে দেওয়া হয়েছে কিনা- এসব বিষয় নিয়ে কাউকেই কথা বলতে শোনা যায় না। 

থানার ওসি সাহেব, ইউএনও সাহেব কিংবা অন্য যে কোনো কর্মকর্তার চেয়ে একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় পদাধিকার বলে মর্যাদাবান- এটা এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করতে চায় না। একজন ইউএনও বা ওসি’র সঙ্গে যে সম্ভ্রম নিয়ে মানুষ কথা বলে,  একজন অধ্যক্ষের সঙ্গে তার সিকিভাগের একভাগ সম্ভ্রমও কেউ প্রদর্শন করে না। কেন করে না তারও কিছু কারণ আছে। সাধারণ মানুষ দীর্ঘকাল ধরেই মনের মধ্যে লালন করে আসছে শিক্ষকরা হলো না-খাওয়া ভদ্রলোক, এরা ক্ষমাশীল, দয়ার সাগর, যে কোনো অপরাধ করেও এদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায়। এরা প্রতিশোধ নেন না। রাষ্ট্র এদের পাশে নেই। আমি চৌদ্দ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। চৌদ্দ বছরে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তার বেশিরভাগই বেদনাদায়ক। আনন্দের বা সুখের স্মৃতি যে নেই সে কথা বলব না, তবে একশ কষ্টের কথার পাশে একটি সুখের কথা কোনো মানুষকেই হতাশার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে না।

বাংলাদেশে সম্ভবত ধর্ষণ ও শিক্ষক নিপীড়নের হার প্রায় সমান অথবা কিছুটা বেশিও হতে পারে। শিক্ষক-নিপীড়ন কোনো সাধারণ মানুষ করে না, শিক্ষকদের নিপীড়ন করে তারা যারা নানাভাবে ক্ষমতাবান। রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরাই শিক্ষক নিপীড়নের শীর্ষে রয়েছেন। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বার, নেতা-পাতিনেতা, এমপি- সকলেই শিক্ষক নিপীড়নে সিদ্ধহস্ত। যে শিক্ষক কিছুটা সবল ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান যে শিক্ষক ছাড়া আর কেউই আজকের বিপথগামী বাংলাদেশে নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জের এক সংসদ সদস্য শিক্ষককে কান ধরিয়ে এবং জেলে পুরে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। হৃদয় মণ্ডল নামের এক বিজ্ঞান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার দায়ে একটি প্রভাবশালী মহল জেল-জুলুম করেছে সেদিন। তার পরেই সাভারে বখাটে ছাত্রের হাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষক নিহত হন। নড়াইলে এক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জেলার শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে জুতার মালা পরতে বাধ্য হন। নড়াইল জেলার ওই শিক্ষক ম্যানেজিং কমিটির  অন্যায় প্রস্তাব মেনে নেননি বলেই তার গলায় ফুলের মালার পরিবর্তে ক্ষুব্ধ হয়ে জুতার মালা পরিয়েছেন ক্ষমতাবানেরা। এ দেশে যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সব পরেন, এ দেশের একেকজন ক্ষমতাবান একেকজন ছোটো-খাটো ঈশ্বর। সামান্য শিক্ষকগণ সেসব ঈশ্বরের ক্রোধদৃষ্টিতে পড়লে তার আর রক্ষা থাকে না, সম্মান তো যায়ই, সেই সঙ্গে জীবনটাও মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকরা নিরাপদ নন। শিক্ষা পেশা এখন আর কাউকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। যাদের কোনো উপায় থাকে না, কেবল তারাই আজ জীবিকার জন্য এসে আশ্রয় নিচ্ছেন তথাকথিত এই মহান পেশায়। শিক্ষকতা এ দেশের প্রেক্ষাপটে মহান পেশা নয়, অসম্মানের পেশা। মুচি, মেথর, হকারের যে দাম, শিক্ষকের দাম এ দেশে তাদের চেয়ে কখনোই বেশি নয়। পূর্বে কখনো ছিল বলেও ইতিহাসে পাইনি।

আজ বাংলাদেশের সর্বত্রই কারণে-অকারণে শিক্ষকগণ লাঞ্ছিত হচ্ছেন। একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অন্যদিকে মৌলবাদীদের হুঙ্কার। এই দ্বিমুখী সমস্যাই এখন শিক্ষকদের নাভিশ্বাস উঠিয়েছে। বিদ্যা বিতরণের চেয়ে এখন জীবন বাঁচানোই শিক্ষকদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা তা সময় নিয়ে দেশবাসীকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। 

একজন শিক্ষক নিজেই প্রতিষ্ঠান। যে যুগে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সে যুগেও শিক্ষক ছিলেন। একেকজন শিক্ষককে ঘিরে গড়ে উঠতো একেকটি শিক্ষা-অঞ্চল। আধুনিক যুগে শিক্ষককে প্রতিষ্ঠানে বন্দি করার পাশাপাশি তাকে চিন্তা-চেতনায়ও খর্ব করা হয়। একজন শিক্ষক কখনোই সমাজের বাইরের কোনো চরিত্র নন, তিনি সারাক্ষণ জ্ঞান-জগতে বিচরণ করেন বলে, তার জ্ঞানের পরিধি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না বলেই তাকে পীড়ন করতে হবে- এমন কথা কোথাও বলা নেই। রাষ্ট্র যদি শিক্ষককে দিয়ে অন্যায় করাতে চায় এবং শিক্ষক যদি তাতে সম্মত না হন, সে দোষ কি রাষ্ট্রের নাকি শিক্ষকের? ‘শিক্ষা এখন ব্রত নয় পেশা’- ব্রত আগে ছিল যখন কেউ স্বেচ্ছায় শিক্ষক হতো। এখন সরকারের অন্যান্য দপ্তরের মতো শিক্ষাও একটি দপ্তর। দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক থাকতে পারছেন না, তাকে নানাবিধ সংকটে পড়তে হচ্ছে। 

সরকার ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ছাড়া শিক্ষকদের মুক্তির আজ আর কোনো পথ নেই। শিক্ষকরা বড় জোর শিক্ষা পেশা বদলে অন্য পেশায় যেতে পারেন, অনেকে চলেও যাচ্ছেন, তাতে কি রাষ্ট্রের কল্যাণ হবে? মোটেও নয়। শিক্ষকসমাজের সম্মান এবং তাদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ শিক্ষার সঠিক মান নিশ্চিত করবে, দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে এটাই হোক প্রধান অঙ্গীকার।   

০২ জুলাই, ২০২২
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার

 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়