ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা: পথ যেন হয় নিরাপদ স্বস্তির

রাজন ভট্টাচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ৭ জুলাই ২০২২  
নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা: পথ যেন হয় নিরাপদ স্বস্তির

দিনাজপুর সদর উপজেলায় তেলবাহী লরির চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী মা ও মেয়ের মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত ছেলেও মারা গেছে, চিকিৎসাধীন রয়েছেন বাবা। গত বুধবার ভোরে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ঘটে। 

খবরটি পড়েই বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। ঈদ যাত্রার শুরুতেই দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করেছে। জানি না সামনের দিনগুলোতে সড়কে আরো কি অপেক্ষা করছে! আরো কত প্রাণ যাবে এভাবে? কারণ হলো ঈদের আগে-পরে অন্তত ১০দিন রাস্তায় বাড়তি যানবাহনের চাপ থাকে। ঢাকাসহ বড় বড় শহর থেকে স্রোতের মতো মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি যাবেন, উৎসব শেষে আবার কর্মস্থলে ফিরবেন। তাই সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।  

যে কারো মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বাংলাদেশ ছাড়া কি বিশ্বের আর কোনো দেশে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যু নেই। উন্নত দেশগুলো কি সড়ক দুর্ঘটনা মুক্ত? এক কথায় এসব প্রশ্নের জবাব হলো- পৃথিবীর কোনো দেশই দুর্ঘটনামুক্ত নয়। এটা হতে পারে না। তবে নিয়ন্ত্রণে। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ জাপানেও এত দুর্ঘটনা হয় না, বাংলাদেশে যা হয়। উন্নত অনেক দেশে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। সব দেশেই সড়কে আইন কঠোর। নিয়ম মেনে সব ধরনের যানবাহন চলতে হয়। নিয়ম ভঙ্গের কারণে পয়েন্ট কাটতে কাটতে এক সময় চালকের লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল হয়। এর বাইরে অনান্য অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি তো আছেই।  

মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে যেসব দেশে বাইক চলাচল করে সেখানেও আইনের নজরদারি খুব বেশি। আমাদের দেশের মতো চালকের লাইসেন্স বা যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এমনকি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগিয়ে সড়কে ইচ্ছে মতো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলানোর সুযোগ নেই।  অর্থাৎ আইন মেনে যানবাহন চললে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। কষ্টের বিষয় হলো আমরা আইন মানছি না। সড়কে যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ কাগুজে বাঘ। এই সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো কোনো সময় তাদের ম্যানেজ করে ইচ্ছে মতো সবাই গাড়ি চালাচ্ছেন। তাই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। 

ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। সড়ক দুর্যোগ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এই চেষ্টায় ঘাটতি বা সদিচ্ছার মধ্যে কতোটুকু সফল হওয়া যাবে সেটাই বড় প্রশ্ন। তবুও এ বিষয়ে জোর দেয়ার সময় এখনই। 

গত রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছেন; আর এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে। ঈদ ঘিরে ১৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বেসরকারি এক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোজার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে, ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার। এই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলের। আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এই দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়।

এসব দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২%) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে। তাছাড়া কর্মক্ষম জনশক্তির মৃত্যু একটি দেশকে আগামী দিনে অনেক পিছিয়ে দেবে এটা কর্তৃপক্ষের মনে রাখা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঈদের আগে-পরে সাতদিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময় আন্তঃজেলায় অর্থাৎ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে পারবে না, এমনকি রাইড শেয়ারিংও করা যাবে না। পদ্মা সেতুতেও মোটরসাইকেল চলাচলের উপর সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যা এখনও বলবৎ আছে। ইতোমধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আন্দোলনে নেমেছে বাইকারদের বিভিন্ন গ্রুপ। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাইক চালকদের পদ্মা সেতুর মুখেও মানববন্ধন করতে দেখা গেছে। 

দুনিয়ার অন্য দেশে মোটরসাইকেল গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত হয় না। স্বল্প দূরত্বের বাহন হিসেবে এটি পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে মোটরসাইকেল চালকরা একে গণপরিবহন হিসেবে দেখেন! এর কারণ হলো চালকদের প্রশিক্ষণের সময় কখনও বিষয়টি বিআরটিএ প্রশিক্ষকরা খোলাসা করেন না। তাছাড়া উন্নত দেশে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের যাতায়াতের জন্য একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করে। সেই কর্তৃপক্ষ সড়ক-নৌ, রেল ও আকাশপথে কত যাত্রী হতে পারে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়। অর্থাৎ পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করে যাত্রীদের স্ব-স্ব গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারা করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ বলে কথা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশে এ ধরনের প্রস্তুতি দেখা যায় না। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে গণপরিবহন বাড়ানোর বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে তাগিদ একেবারেই কম, যেমন মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার বৃদ্ধিতে দেখা যায়!

এই পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে বাড়ি যাবে? ট্রেনের ৫০ঘণ্টা দাঁড়িয়েও কাউন্টার থেকে টিকিট মেলে না। অনলাইনের টিকিট কীভাবে কাটতে হয় অনেকে জানে না। বাসে ওঠা আরেক যুদ্ধ। সড়কে যানজট, দুর্ঘটনার আশঙ্কা। নৌ-পথেও যুদ্ধ কম নয়। আকাশপথে সবার চলাচলের সাধ্য নেই। তাই মোটরসাইকেল নিয়েই অনেকে গন্তব্যে গেছেন রোজার ঈদে। এবারের ঈদেও কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপের আগেই অনেকে বাইক নিয়েই বাড়ি গেছেন।  

যদিও সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এসব দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২৪ জন। এর মধ্যে ১৯৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২০৪ জন। যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। 

এই তথ্য বলে দিচ্ছে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কতটা বেড়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মোটরসাইকেলের পার্টস আমদানির ক্ষেত্রে ট্যাক্স কম নেওয়া হচ্ছে। যা গণপরিবহনের ক্ষেত্রে করা হচ্ছে না। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে গিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যায় না।

কথা হলো বাইক নিয়ন্ত্রণ করলেই তো দেশে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এমন ধারণার কারণ নেই। তবে কমবে। মনে রাখা প্রয়োজন অন্য যানবাহনগুলোও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কম দায়ি নয়। তাই সব যানের প্রতিই নজরদারির বাড়াতে হবে। সরকারের উচিত গণপরিবহন বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত , সহজ ও সাশ্রয়ী করা। পাশাপাশি সড়ক মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল চলাচল নিরুৎসাহিত করা। অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে সেজন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া। লক্করঝক্কর যানবাহন যেন বাইক চলাচল বন্ধের সুযোগ নিয়ে মহাসড়কে উঠতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। 

দুর্ঘটনা রোধে প্রতিটি সড়কে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করার বিকল্প নেই। জনবল বাড়িয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে। যানবাহনে শৃঙ্খলা আনতে সড়কে বসাতে হবে সিসি ক্যামেরা। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যানজট। ঈদের সময় পণ্যবাহী যেসব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কথা, সেগুলো যেন কোনোভাবেই রাস্তায় দেখা না যায়। রাস্তার রাজা হিসেবে পরিচিত নসিমন, ইজিবাইক, করিমন, ভটভটি, মাহিদ্রাসহ অনুমোদনহীন তিন চাকার সব ধরনের নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল পুরোপুরি ঠেকাতে হবে। এসব কম গতির যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ি। লাইসেন্সবিহীন চালক ও এসব পরিবহন চলতে দিয়ে কোনো অবস্থাতেই সড়ক নিরাপদ করা যাবে না। 

তাছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই চলবে না, মালিকদের বিরুদ্ধেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। সব মিলিয়ে এবারে ঈদ যাত্রায় কামনা পথ যেন হয় নিরাপদ, স্বস্তির। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়