ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ যতটুকু শান্তিদেব ঘোষের ঠিক ততটুকুই হিরো আলমের 

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২০, ২৯ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১৩:২২, ২৯ জুলাই ২০২২
রবীন্দ্রনাথ যতটুকু শান্তিদেব ঘোষের ঠিক ততটুকুই হিরো আলমের 

বিশ্বসাহিত্যে কয়েকজন মুকুটহীন সম্রাট আছেন যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের অন্তর আলোকিত করে চলেছেন। সান্ত্বনা হয়ে পাশে থাকছেন। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মানবতার বাণী ফেরি করছেন। হতাশার সর্বনাশ থেকে মুক্তির মন্ত্র শোনাচ্ছেন। দরদী মায়ের মতো সবার হয়ে কথা বলছেন।

এই কাতারে অনায়াসে ফরিদউদ্দিন আত্তার, শামস-এ-তাবরিজি, জালালউদ্দিন রুমি, বাহাদ্দিন জাকারিয়া থেকে শাহ্ আব্দুল লতিফ বিহতি, ফকির লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম প্রত্যেকেই নিজের সৃষ্টিশৈলীর মাধ্যমে বিশ্ব মানুষের মনে প্রশস্ত এক মাঠ তৈরি করেছেন। যেখানে বরেণ্য খেলোয়াড় তাঁরা। সর্বদাই চার ছক্কার জিকির তোলেন। আবার সিঙ্গেল রানের মাধ্যমে দম নেন। অথচ প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষ বোলারকে অস্থির রেখে ছন্দে ছন্দে ব্যাটিং করেই চলছেন। বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছেন পরবর্তী ব্যাটাররা। তবু আউটের সম্ভাবনা যেন জিরো। 

এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং যুবক বয়সে আনন্দের খোরাক জোগায়, তাই বলে পরিণত কিংবা বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া ব্যক্তিকেও আন্দোলিত করবে! এটাই রুমি, লালন, রবীন্দ্র, নজরুলের সাহিত্য কিংবা গানের শক্তির জায়গা। তাদের গান সর্বকালের সববয়সী, সব শ্রেণির মানুষের জন্য বিনোদন। তরুণ বয়সে এক রকম আবেদন, যুবক বয়সে অন্যরকম নিবেদন, পরিণত বয়সে প্রেমের উপলব্ধি, বার্ধক্যে এসে একই গানে দারুণ রকমের মরমের সুর অন্তরে বাজে। যেখানে বিলীন না হয়ে বিকল্প উপায় থাকে না। একই গান অথচ ভিন্ন বয়সে ভিন্ন ভিন্ন আবেদন হয়ে ধরা দেয়। তাদের প্রেমের সাধনায় যে রহস্যময় ঘোর তৈরি হয়েছে এভাবে আরো বহু শতাব্দী চলে যাওয়ার পরও তা হবে আরো আধুনিক। মানুষ হবে আরো বেশি মোহাচ্ছন্ন।

গানে সুর, তাল, লয়, ধ্বনি, ছন্দ ও উচ্চারণ ঠিক থাকলে শ্রুতিমধুর হয়। সেইসঙ্গে হয় সহজবোধ্য। যা মনে ও মগজে আলোড়ন তোলে। সবকিছু ঠিক রাখতে গেলে প্রয়োজন সাধনা। আমরা জানি, সংগীত কেবল সাধনার মাধ্যমেই শুদ্ধ হয়। মুশকিলটা হলো, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ গানের তালিম নিতে পারেন না, সেখানে সাধনা দূর পৃথিবীর কল্পনামাত্র। তাই বলে, এরা কণ্ঠ ছেড়ে গাইবে না? ঠোঁটে ঠোঁট মেলাবে না! গাড়োয়ান নিজের মতো টান দেবে না- ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই…’ বলে! হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা ও বিল-ডোবা অধ্যুষিতজনেরা সুর কিংবা বেসুরে গাইবে সারিগান এটাই বাংলার প্রচলিত রেওয়াজ। 

এরা শহরের গানের শিক্ষকের ক্লাসিক ধারাকে উপেক্ষা করে নিজের মতো গেয়ে শান্তি, আরাম ও আনন্দ পান। আনন্দের জন্য সম্ভ্রান্তরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়, পর্বত জয় করে, চাঁদের বুকে পা রাখে। প্রয়োজন একে অন্যকে খুনের মতো জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধা করে না। অথচ সাধারণ মানুষ নিজের মতো সুর করে গান ধরলে সমাজের অভিজাতরা মামলার ভয় দেখাবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্থা করবে! সমালোচনার আগে ভাবতে হবে- প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিনোদনের ব্যবস্থা কতটুকু আছে? আবার কতটুকু ধ্বংস করা হয়েছে? এখন মঞ্চে নাটক নেই, যাত্রা নেই, পালা গান নেই, চলচ্চিত্রটাও ধসে পড়েছে। এমন সুযোগে এন্ড্রয়েড মোবাইলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান ওপার-এপারের ভাইরাসে ভাইরাল হওয়া রোদ্দুর রায় কিংবা হিরো আলম।

হিরো আলমের মতো ইউটিউবাররা সাধারণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এদের হাতে অভিনয় বা গানের প্রাতিষ্ঠানিক সনদ নেই সত্য। তাই বলে, তারা রবীন্দ্র, নজরুল, লালন, করিম, হাছনদের গানে কণ্ঠ মেলাতে পারবে না! বরং এদের গান প্রান্তিক পর্যায়ে যত বেশি সুরে-বেসুরে পৌঁছবে ততই মানুষ জানতে পারবে শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের মানবতাবাদের বাণী। সেই দল থেকে কেউ না কেউ শিকড় ধরে ধরে সুর, তাল খুঁজে সত্য জানার চেষ্টা করবে। প্রায় নয়শ বছর আগে জন্ম নেওয়া মহাত্মা জালালউদ্দিন রুমির সাহিত্য টেকনাফ বা তেঁতুলিয়ার অল্প শিক্ষিতরা নিশ্চয়ই নিজের মতো পড়ে। রুমি কিংবা তার সরাসরি শিষ্যদের মতো ছন্দের তালে তালে নৃত্য করে পড়বে না। কেউ এ নিয়ে হুকুম জারি করলে রুমি সবার মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারবেন না। 

গান সাহিত্যেরই একটি অংশ। চাইলে সুরের সবগুলো ধারা মেনে যে কেউ কণ্ঠে তুলবে অথবা নিজের মতো করে বিনোদনের জন্য পড়বে। পৃথিবীজুড়ে অনেক শিল্পী আছেন যাদের বাণী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না। হয়তো কোনোদিন পৌঁছবেও না। বুঝতে হবে, সেই গান সকলের জন্য না। রবীন্দ্রনাথ শিশুদের জন্য, আবার বড়দের জন্য। তিনি লিখেছেন ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। সন্দেহাতীতভাবে রবীন্দ্রনাথ বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাঁর শারীরিকভাবে মৃত্যুর পরে সুবিশাল প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কারো কাছে অর্পণ করে যাননি। তিনি জানতেন, এতে তার সাহিত্য বিকাশের পরিবর্তে সংকুচিতই হবে বেশি। 

আমেরিকান, আফ্রিকান, কিংবা চাইনিজরা রবীন্দ্রচর্চা নিজেদের মতো করেই করবে, মানুষের সামনে তুলে ধরবে। লাইসেন্সধারী অভিজাত মাস্তানেরা আড্ডার গানকেও সেন্সর শুরু করবে? এমনটা হলে আরো আগেই রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বের ধস নামতো। মাইকেল জ্যাকসনের গান গাইতে হলে মঞ্চে উঠে নব্বই ডিগ্রি পা বাঁকা করে ব্লাক ক্যাপ মাথায় লাগিয়ে গাইতে হবে এমনটা নয়। হালের ক্রেজ শাকিরা, লেডি গাগা, ব্রিটনিদের গাইতে হলে মেয়ে হতে হবে তাও না, আবার টয়লেটে বসেও নিজের মতো করেই সুর দেওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা নেই। কারণ, সুর ও সংগীত কখনই কোনো সীমানা মানে না। একথা আমাদের বিশিষ্ট বিজ্ঞজনেরা ভুলে গেলে চলবে না, রবীন্দ্র-নজরুল তাদের সাহিত্যের মাস্তানি পাড়ার কোনো উঠতি পাতি নেতার হাতে তুলে দিয়ে যান নাই। বরং শক্ত করে নিজেদের হাতেই রেখেছেন। 

তাই রবীন্দ্রনাথ যতটুকু শান্তিদেব ঘোষের ঠিক ততটুকুই হিরো আলমের। সে চাইলে নিজের মতো উচ্চারণ করে গাইতে পারবে। পৃথিবী থেকে বহু আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে গেছে, শুদ্ধ ভাষা অভিযানের কারণে। অথচ আঞ্চলিকতা যে কোনো ভাষায় নতুন নতুন শব্দের সংযোগ ঘটিয়ে মূল ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। তাই ভাষার উপর কর্তৃত্ববাদ বন্ধ করা দরকার। এতে টিকে যাবে বহু প্রাচীণ ও পুরাতন ভাষা। একইভাবে রবীন্দ্রনাথকেও কোটায় বন্দি না রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখালে রবীন্দ্রনাথের আরো বেশি প্রচার ও প্রসার ঘটবে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আবেদন নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন শত শত বছর। 

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়