মিস্টার পারফেক্ট চৌধুরী
সে এক বিস্মৃত কালের কথা।
আমরা তখন ‘প্রথম আলো’র নিচে আল আমিনের চায়ের দোকানে জগত উদ্ধার করি। মার্কেজ থেকে মঞ্জুরুল ইসলাম, মার্ক্স থেকে সলিমুল্লাহ খান, টেন্ডুলকার থেকে আশরাফুল; সবকিছু নিয়েই আমরা তখন মতামত দিয়ে জমাট আড্ডা দেই। আমাদের আড্ডার সদস্যরা ছিলেন বিচিত্র। কেউ সাংবাদিক, কেউ কবি, কেউ গদ্যকার, কেউ চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মী এবং অবশ্যই কেউ কেউ কিছু করতে চান না।
ওখানে সারি সারি দোকানের সবগুলোতেই এমন নানা গ্রুপের আড্ডা জমে থাকে। সবাই যার যার দোকান নিয়ে ব্যস্ত; অন্য আড্ডার দিকে খুব একটা ফিরে তাকানো হয় না। একদিন হঠাৎ চেনা একটা কণ্ঠ পাশের দোকান থেকে ভেসে আসলো। ঘুরে দেখলাম তারকাদের আড্ডা। সাংবাদিক, নাট্যকর্মী শফিক আল মামুনের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন চঞ্চল চৌধুরী।
তখনও চঞ্চল চৌধুরী এমন মহীরূহ হয়ে ওঠেননি। মাত্র ‘মনপুরা’ করে একটু সাড়া ফেলেছেন। টিভিতে রসের সব নাটক করে ঘরে ঘরে চেনা নাম হয়ে উঠেছেন। চঞ্চল-মোশাররফ করিম তখনও এক পাল্লার ‘কমেডিয়ান’ বলে বিবেচিত হচ্ছেন। তখনও চঞ্চল ডানা মেলে ওঠেননি। তারপরও আমি তাকে দেখে চনমন করে উঠলাম। আমাদের আড্ডার কেউ তারকাপ্রেমী ছিলেন না। রবার্ট ডি নিরোও পাশের দোকানে এলে খুব একটা পাত্তা পেতেন না। কিন্তু আমি মফস্বল থেকে আসা একটু আহলাদিটাইপের মানুষ। নিজেকে সামলাতে না পেরে উঠে গিয়ে হাত মিলিয়ে এলাম তাঁর সাথে।
আজ এতোদিন পরে মনে হয়, ভুল হয়ে গেছে; প্রণাম করে আসা উচিত ছিল। সেদিন বুঝতে পারিনি চঞ্চল চৌধুরী কালক্রমে দেশের এমন কিংবদন্তী হয়ে উঠবেন। বুঝতে পারিনি যে, চঞ্চল চৌধুরী একসময় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বৈচিত্রময় এবং প্রায় পারফেক্ট এক অভিনেতা হয়ে উঠবেন। সুযোগ পেলে এখন একসময় প্রণামটা সেরে নেবো। চঞ্চল চৌধুরী যে নমস্য, তা নিয়ে এই ২০২২ সালে আর কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
আমাদের ছোট্ট ইতিহাসে আমরা অনেক নামি-দামী এবং গুণী অভিনেতা এই বাংলাদেশে পেয়েছি। তবে এ কথা বলা বোধহয় অন্যায় হবে না যে, হুমায়ুন ফরিদীর পর এই বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ ‘অভিনেতা’ চঞ্চল চৌধুরী। আমি ব্যাপারটা আরও একটু অন্যরকমভাবে দেখতে পছন্দ করি। বাংলা ও হিন্দিকে বিবেচনায় নিলে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ রূপান্তর ঘটানো দুজন শিল্পী হলেন অজয় দেবগন ও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। একসময় একেবারে এলেবেলে অভিনয় করা এই দুজন মানুষ নিজেদের বদলে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হয়ে উঠেছেন। সেই বিবেচনা করলেও চঞ্চলকে আমি এদের চেয়ে কম এগিয়ে রাখবো না। একেবারে বস্তপচা সব চরিত্র করে লোক হাসানো টাইপের অভিনেতা ছিলেন। সেখান থেকে দেশের সবচেয়ে ভার্সেটাইল অভিনেতায় পরিণত হয়েছেন; এই রূপান্তরকে গ্রেগর সামসার বিপরীত বলে সেরা রূপান্তর বলাই যেতে পারে।
অবশ্য চঞ্চলের ক্ষেত্রে মজাটা আরও একটু বিচিত্র। তার রূপান্তরটা হয়েছে কয়েক রকমের। তিনি এসেছেন মঞ্চ থেকে। আমি তার মঞ্চ নাটক কখনো দেখিনি। তবে যারা দেখেছেন, তারা বলেছেন, মঞ্চে দারুণ সব সিরিয়াস চরিত্র করেছেন একসময়। সেখান থেকে রোজকার নানারকম ভাড়ামি নাটক করতে হয়েছে। আর সুযোগ পেতেই নিজের সেরাটা বের করে এনে গুরুতর অভিনেতা হয়ে গেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা মনে করুন। কমলকুমার মজুমদারের শিষ্য ছিলেন। ‘কৃত্তিবাস’-এর মতো পত্রিকা করেছেন, কবিতা লিখেছেন। টিকে থাকার জন্য তিনিই আবার একসময় চটি টাইপের বই লিখেছেন। পায়ের তলে মাটি খুঁজে পাওয়ার পর নিজেকে আমুল বদলে ফেলেছেন। বাংলায় ঐতিহাসিক উপন্যাসকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। চঞ্চলকে আমার অভিনয়ের সুনীল বলে মনে হয় কখনো কখনো।
চঞ্চলের এই ভয়ানক হয়ে ওঠার শুরু আমার মনে হয় ‘মনের মানুষ’ থেকে। এর আগেই তিনি অনিমেষ আইচ, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সাথে বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু নিজেকে ভেঙে ফেলার যে ব্যাপারটা সেটা আমি অন্তত মনের মানুষ-এ প্রথম খেয়াল করলাম। মনে হলো, কালুয়া তো একেবারে অন্য এক চঞ্চল; যাকে এর আগে কখনো দেখিনি।
এরপর পদচারণাটা দেখুন। কখনো বিভৎস এক আয়না, কখনো চেয়ারম্যানপুত্র সোলাইমান, কখনো মিসির আলী, কখনো তকদীর, কখনো চান মাঝি এবং কখনো ইতিহাসের পাতা ছিঁড়ে উঠে আসা রহস্যময় এক বন্দী। কোনো চরিত্রে আগের কোনো চরিত্রের ছায়া খুঁজে পাবেন না। প্রতিটি চরিত্রে নতুন এবং মোড়ক ভাঙা এক ব্যাপার। টাইপড হয়ে যাওয়ার কোনো ভয়ই নেই যেনো।
একেবারে ভিড়ের মধ্যের একজন মানুষ। যিনি দৃষ্টি কাড়বেন না, কিন্তু সাধারণ থেকে অসাধারণ হবেন
এই সবশেষ দেখা একটা বিজ্ঞাপন থেকে আলোচনা শুরু করে। ‘নগদ’-এর একটা বিজ্ঞাপনে তিনি ‘শাড়ি ভাই’ হয়েছেন। কি তার দেহভাষা! কণ্ঠে, চোখে এবং দেহে তিনি যেনো একেবারে মোহনীয় এক প্রায় নারী। এমন শাড়ি ভাইদের তো আমরা দেখি। চঞ্চল নিজেকে একেবারে রাশভারি বন্দী থেকে সত্যিকারের শাড়ি ভাই বানিয়ে ফেললেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ বেঁচে থাকলে চঞ্চল তার দৃষ্টি কাড়তেন; বকা দিতেন কিনা, বলতে পারছি না!
তকদীরের কথা মনে করে দেখুন। এতো সাবলীলভাবে লাশের গাড়ি চালাচ্ছেন, মনে হচ্ছে ছোটবেলা থেকে এই গাড়িটা চালানোই তার কাজ। পুলিশের ভয়, লাশের রহস্য তাকে কীরকম অসহায় করে রেখেছে। একেবারে নিম্নবিত্ত একটা মানুষের মতো ভীতু একটা লোক যেনো। আবার মিসির আলীর কী আত্মবিশ্বাস!
অনেকে মিসির আলী খুব পছন্দ করেননি। ‘দেবী’ আমিও খুব পছন্দ করেছি, তা নয়। কিন্তু আমার কাছে এই রূপে মিসির আলীকে আবিষ্কার করে খুব আন্দ পেয়েছিলাম। আমি এবং আমাদের অনেকেই মিসির আলীকে আবুল হায়াতের রূপেই ভাবতে পছন্দ করতাম। কিন্তু একটু ভুড়ি আছে, একটু রসিক এবং এলোমেলো মিসির আলীও তো দারুণ ব্যাপার! গলায় একটা নোকিয়া মোবাইল ঝোলানো চঞ্চলকে দেখে মনে হলো, এই তো আসল মিসির আলী।
সর্বশেষ চঞ্চল চমকে দিলেন কারাগারে। এ যেনো নানা পাটেকরের ‘খামোশি’। নানা পাটেকরের ডায়লগ শুনতে লোকে হলে যায়। সেখানে নানা অভিনয় করলেন বোবার চরিত্রে। সে সিনেমাও ফ্লপ হলো। আর এখানেই নানাকে টপকে গেলেন চঞ্চল। চঞ্চলের ডায়লগ তো আকর্ষণীয় এক ব্যাপার। সেই চঞ্চল যখন নীরব থাকেন, তিনি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠেন। চোখে কথা বলেন, হাতে কথা বলেন, আঙুলে কথা বলেন। পুরোটা সময় চুপ করে থেকেও হাজার হাজার কথা বলে চললেন চঞ্চল।
এই যে কালুয়া থেকে কারাগারে তার যে জার্নি, এখানে বারবার চঞ্চল ওই বৈচিত্রটাকে সামনে এনেছেন। কখনো একটু কুঁজো হয়ে গেছেন, কখনো দৃঢ় হয়েছেন, কখনো সাধারণ হয়েছেন, কখনো চোখকে অস্ত্র করেছেন। নিশ্চয়ই পরিচালকদের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু পরিচালকের চাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে এভাবে বারবার বদলে ফেলতে পারেন ক‘জন মানুষ?
চঞ্চলের ক্ষেত্রে আমার ছোট্ট একটা অনুযোগ হলো, তিনি ঠিক সাধারণ নন। একটু বুঝিয়ে বলি। চঞ্চল হচ্ছেন নানা পাটেকর, হুমায়ুন ফরিদী গোত্রের। পর্দায় তিনি থাকলে আর কাউকে আপনার বড় বলে মনে হবে না। চোখ তার দিকেই যাবে। এখানে আমি নাসিরউদ্দিন শাহকে এগিয়ে রাখি। তিনি রেশনের লাইনে দাঁড়ালে তাকে লাইনের আর দশটা লোকের মতোই মনে হবে। চঞ্চলের এখন অবধি যতগুলো চরিত্র দেখেছি, তার বেশিরভাগেই তাকে কখনো অমন সাধারণ হয়ে ওঠার মতো মনে হয়নি। হতে পারে কাহিনির প্রয়োজনেই তিনি এখনও নিতান্ত সাধারণ চরিত্রে হাজির হননি। আমি অবশ্যই চঞ্চলকে ওরকম একটা চরিত্রে দেখার অপেক্ষায় থাকবো। একেবারে ভিড়ের মধ্যের একজন মানুষ। যিনি দৃষ্টি কাড়বেন না, কিন্তু সাধারণ থেকে অসাধারণ হবেন।
যা বললাম, নিজগুনে পাঠক নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন। আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই, অনেক চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা নেই, খোদ চঞ্চলেরই সব কাজ দেখিনি; ফলে এতো বড় বড় কথা বলা আমার সাজে না। তারপরও নিতান্ত ভক্ত হিসেবে একটু অর্চনা করা গেলো। সব ঠিক থাকলে চঞ্চল বাংলাদেশের ইতিহাস হবেন। ইতোমধ্যে তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এমন মানুষকে নিয়ে দুটো কথা বলে সেই ইতিহাসের বুকে একটা বালুকণা রেখে যেতে চাইলাম। চঞ্চলদাকে একদিন সাহস করে নিশ্চয়ই প্রণাম করে ফেলবো কোনো চায়ের দোকানে।
আচ্ছা, চঞ্চল চৌধুরী কি এখন আর টং দোকানে বসেন? বসলেই সে দোকান তো আর টং দোকান থাকবে না; পাঁচ তারকা হয়ে যাবে। চঞ্চল চৌধুরী স্পর্শ করলে কয়লা আজকাল সোনা হয় আর তো টং দোকান। তিনি এখন সত্যিই পরশপাথর।
/তারা/
আরো পড়ুন