কারা আসছেন নাসিরনগর আ. লীগের নেতৃত্বে
‘নাসিরনগর’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপজেলা। নানা কারণে পরিচিত। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর স্থানীয় শতাধিক হিন্দু বাড়িঘর এবং একাধিক মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনায় নামটি ছড়িয়েছে দেশের বাইরেও।
ষড়যন্ত্রমূলক রসরাজ দাস নামে এক জেলের ফেইসবুক আইডির মাধ্যমে পবিত্র ক্বাবা শরিফকে অবমাননা করে দেওয়া এক পোস্টের জেরে ওই ভয়াবহ হামলা হয়। এরপর থেকে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতনের কথা উঠলে রামুর পর নাসিরনগরের নাম নেন অনেকে। কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সরকার, একই দলের স্থানীয় (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ সংসদীয় আসন) প্রভাবশালী এমপি থাকার পরও সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় ছিল সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ নাসিরনগরে।
সেই নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আগামীকাল মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর)। স্থানীয় আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা অতিথি থাকবেন।
২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল। প্রায় ৮ বছর পর এই সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থী তালিকা দীর্ঘ। স্বাভাবিক কারণেই দেশবাসীসহ বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা রাজনীতি সচেতন বাঙালির চোখ এখন নাসিরনগরে; জিজ্ঞাসা কারা আসছে নাসিরনগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। নতুন নেতৃত্ব নাসিরনগরকে সঠিক পথে পরিচালিত করায় কতটা অবদান রাখতে সক্ষম হবে- সেই হিসাবও মেলাতে শুরু করেছে কেউ কেউ।
বেশিরভাগ সংসদ নির্বাচনে নাসিরনগরে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। এমনকি ২০০১ সালেও নাসিরনগর আসনটি ধরে রাখেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছায়েদুল হক, যখন চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের চরম বিপর্যয় হয়েছিল। সে হিসেবে নাসিরনগর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এজন্য নাসিরনগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, ছায়েদুল হকের আমলেই (তখন তিনি মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) নাসিরনগরে সেই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে প্রশংসনীয় নাসিরনগরে এমন একটি হামলার ঘটনা সবাইকে অবাক করেছিল। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরই ছায়েদুল হকের মৃত্যু হয়। উপ-নির্বাচনে দলটির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাছাই তরুণ নেতা বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ (বিএম) ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এ সময়ে প্রয়াত ছায়েদুল হকের হাতেগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কিছু নেতাকর্মীকে রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রীয় হতে দেখা গেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলোর খবরে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগেরই দু’পক্ষের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফল ওই হামলার কারণ ছিল। তৎকালীন মন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ঠান্ডা দ্বন্দ্বের ফলে এমন একটি ঘটনার পটভূমি তৈরি হয়েছিল বলেও গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে।
আমরা তখন দেখেছি তৎকালীন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হককে বিজয়নগর উপজেলায় সরকারি অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে অপমানের চেষ্টা করেছিল একটি মহল। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে দলীয় এক অনুষ্ঠানে সদরেরই এমপি মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে নাসিরনগরের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন ছায়েদুল হক। সেই এমপি একাদশ সংসদেও সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নাসিরনগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করবেন।
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘিরে ইতোমধ্যে উপজেলাজুড়ে সাজসাজ রব। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থীর ছড়াছড়ি। গুরুত্বপূর্ণ দুই পদে প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও নীরব বর্তমান সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান রাফি উদ্দিন। সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেন সংগ্রামও নিজেকে সভাপতি পদে প্রার্থী ঘোষণা করেননি। ফলে এ নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল সবার মধ্যে। প্রতিপক্ষের ধারণা, শেষ পর্যন্ত এমপি নিজেই সভাপতি হওয়ার চেষ্টা করবেন।
এদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্র এই লেখককে জানিয়েছে, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীদের অনেকে শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যানার-ফেস্টুন, তোরণ বানানোর প্রতিযোগিতাও চোখে পড়ার মতো। উত্তাপের আঁচ কিছুটা হলেও ছড়িয়েছে উপজেলার বাইরেও। এর কারণ দুটি। এক. প্রার্থীরা মূলত এমপি সংগ্রাম গ্রুপ ও এমপিবিরোধী গ্রুপে বিভক্ত। নাসিরনগর আসনের বর্তমান এমপি ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের অনুসারীদের বাইরের একজন সভাপতি প্রার্থীর স্বামী কৃষক লীগ নেতা মো. নাজির মিয়ার মূল বাড়ি পাশের উপজেলা বিজয়নগরে। এমপি অনুসারীদের অভিযোগ, রোমা আক্তার নামের এই সভাপতি প্রার্থীর হয়ে সম্মেলনের মাঠে শক্তি প্রদর্শন করতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিজয়নগর উপজেলার কয়েকশ লোককে। তবে রোমা আক্তারের স্বামীর পরিচয়ে রাজনীতি করা জরুরি নয়, তার বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম নূর একসময় নাসিরনগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
দুই. ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে রয়েছেন। তিনি নাসিরনগরে নিজের রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কমিটি গঠনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারেন বলে কারও কারও ধারণা। ছায়েদুল হক যুগের ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কথা স্মরণ করেই তারা এমনটা ধারণা করছেন। সম্মেলন ঘিরে পদ প্রত্যাশী কেউ কেউ নাসিরনগরের এমপির ছবি ছাড়া পোস্টার করায় এ ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে।
যদিও অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, মোকতাদির চৌধুরী চাইলেই নাসিরনগরে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না। কারণ নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় তার নামে গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবর বেরিয়েছিল। সবশেষ ২০২১ সালের মার্চে বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলা তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে তার কিছু মন্তব্য কেন্দ্রে তার অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সম্মেলনে অংশ নেওয়া কেন্দ্রীয় নেতারা তার মতামতকে কতটা গুরুত্ব দেবেন সেটা প্রশ্ন। তাছাড়া সম্মেলনে বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নাসিরনগর সম্মেলনের সাংগঠনিক টিমের প্রধান জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, যিনি এমপি মোকতাদির চৌধুরীর বিরোধী বলে পরিচিত। তিনি মোকতাদির চৌধুরীর ‘ইচ্ছা’ পূরণে বাগড়া দেবেন- এটাই স্বাভাবিক।
মূল যে হিসাব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের বর্তমান এমপি বি এম ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। তিনি দশম সংসদের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। এরপর থেকেই তিনি নিজের অনুসারীদের শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। উপজেলা সম্মেলনের আগে ১৩টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সম্মেলন আয়োজনে ভূমিকা রেখেছেন। ইউনিয়ন সম্মেলনগুলোয় তিনি নিজে উপস্থিত থেকেছেন। স্বাভাবিক কারণেই সেখানে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের বড় অংশ জয়ী হয়ে এসেছে। বয়সে তরুণ একটি অংশ উপজেলা সম্মেলনে নিজেদের ভোট অথবা মতামত দেবেন, যারা এমপি সংগ্রামকে নিয়ে এগুনোর স্বপ্ন দেখেন। ইতোমধ্যে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের কাউন্সিলও সফলভবে সম্পন্ন হয়েছে নাসিরনগরে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন নাসিরগরের বর্তমান এমপি। একই পদে এমপি অনুসারী একাধিক নেতার প্রার্থী হওয়ার কারণও এটাই। তিনি দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমের ফলাফল ঘরে তুলবেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে। শেষ পর্যন্ত নিজে সভাপতি প্রার্থী হন বা না-হন তার অনুসারীরাই কমিটিতে প্রাধান্য পাবে। এমনকি প্রার্থীতা ঘোষণা না করা কোনো কোনো যোগ্য ও দলের জন্য কাজ করে যাওয়া ব্যক্তি কমিটিতে স্থান পেতে পারেন।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি, বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দি। এর বাইরে সম্মেলনের প্রধান বক্তা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার জেলার সভাপতি মোকতাদির চৌধুরী এমপির এবং সম্মেলনে সভাপতিত্ব করা বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রাফি উদ্দিন আহমেদ নাসিরনগর আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের মতের বাইরে মত দেবেন না বলেই অনেকের বিশ্বাস।
আমাদের প্রত্যাশা, সুষ্ঠুভাবে নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ হোক। কমিটিতে আসুক আধুনিক নাসিরনগর গড়তে নেতৃত্বদানের সক্ষম যোগ্য ও অসাম্প্রদায়ীক মানসিকতার লোকজন। নাসিরনগরের বদনাম ঘোঁচাতে আওয়ামী লীগকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন