ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মধুর আমার মায়ের হাসি

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২  
মধুর আমার মায়ের হাসি

আমার কন্যা সবে চার বছর ছুঁইছুঁই করছে।

তার দাদার সঙ্গে সে প্রায়শ টেলিভিশনে ফুটবল, ক্রিকেটে দেখতে বসে পড়ে। একদিন হঠাৎ আমাকে বললো, ‘বাবা, মেয়েরা খেলতে পারে না?’
একটু থতোমতো খেয়ে গেলাম। তাই তো! টেলিভিশন, সংবাদ মাধ্যমজুড়ে তো সবসময় ছেলেদের খেলা। মেয়েদের খেলার জায়গাটা কই? তারপরও হেসে বললাম, ‘মা, মেয়েরাও খেলে। তারাও ভালো খেলে। তুমিও বড় হয়ে খেলবে।’
মেয়ে আবার মুখটা শক্ত করে উপদেশ দিলো, ‘তুমি মেয়েদের নিয়ে লিখবে। আর ভালো খেললে মা বলে ডাকবে।’

আজ আপনাদের আমি ‘মা’ বলে ডাকি, হে আমার শিরোপাজয়ী জননীরা। 

আমাদের মেয়ে খেলোয়াড়দের গল্পটা আমাদের মায়েদের মতোই। সেই পেটে একটু খাবার না-থাকা, মাথার ওপর একটু ছাউনি না-থাকা এবং সমাজ থেকে, পরিবার থেকে হরেক রকম গঞ্জনা সয়ে পথ চলতে থাকা। তবে আমার মায়েরা, ঘরের কন্যারা যা পারেনি, তাই পেরেছে এই ঋতুপর্ণা, সানজিদারা। 

মেয়েদের জন্য আমাদের এই সমাজ তো বদ্ধ একটা কারাগারের মতো। আমি বাংলাদেশের কথা বলছি না। এই পৃথিবীটাই মেয়েদের বাসযোগ্য করে তুলতে পারিনি আমরা। পদে পদে জবাবদিহি, নিষেধ আর সংস্কার তাদের আটকে রাখে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেটা এতোটাই ভয়ঙ্কর যে, মেয়েরা নিঃশ্বাসটাও নিজেদের স্বাধীনতায় নিতে পারে না। সেখানে কতগুলো মেয়ে এইসব রক্তচক্ষু, নিষেধাজ্ঞাকে পেছনে ফেলে মাঠে নেমে পড়েছে, এটাই তো বড় ঘটনা। 

চিন্তা করে দেখুন পাহাড় থেকে আসা এই দলের মেয়েগুলোর কথা। ওখানে যে মানুষ থাকে, তাই তো এই নগর বিশ্বাস করতে চায় না। ঘর নেই, পানি নেই, খাবার নেই। সেখান থেকে তারা পৌঁছে গেলো কিনা দশরথ স্টেডিয়ামে। হিমালয়ের পাদদেশে এভারেস্ট ছাপিয়ে তারা উঁচু করে ধরলো একটা ট্রফি। 

আমি ১৬ বছর ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেছি। এটুকু বুঝি যে, এই ট্রফির বিশ্ব বিচারে খুব মূল্য নেই। কিন্তু এই মেয়েগুলোর খেলা দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, তাদের অনেকেরই বৈশ্বিক স্তরে খেলার যোগ্যতা আছে। তার চেয়ে বড় কথা, ফুটবল মান দিয়ে আপনি এই ট্রফির বিচার করতে পারবেন না। এ তো একটা কাব্যের জয়। শত অপ্রাপ্তি আর শাসনের ভেতর থেকে উঠে এসে এভারেস্ট জয়ের সমান ট্রফি। 

এই ট্রফি জয়ের জন্য অবশ্যই মেয়েগুলোকে আমাদের জননী বলে মেনে নিতে হবে। তবে এই জননীদের এই অবধি আশার জন্য কিছু মানুষকে আমরা যেনো ধন্যবাদ দিতে ভুলে না যাই। কলসিন্দুর স্কুলের সেই কোচ, পাহারের বুকে বাসা বেঁধে থাকা সেই বাবা-মা কিংবা একজন স্বার্থহীন টিম বয়কেও আমাদের মনে করতে হবে। 
আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা আজ থেকে অর্ধযুগ আগে থেকে এই মেয়েগুলোকে নিয়ে লিখছে, তাদের নিয়ে নানারকম প্রচারণা করে তাদের আলোচনায় রেখেছে। তাই এই সময়ে পত্রিকাটিকে ধন্যবাদ দিতে হবে। 

সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য নিশ্চয়ই গোলাম রব্বানী ছোটনের। ছোট ভাই নিজের জীবনটাই এই মেয়েদের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। অনেক কটুকথা, অশ্লীল রসিকতা সয়ে এই মেয়েগুলোকে আগলে রেখেছেন ছোটন ভাই। তিনি এদের সামান্য কোচ থেকে পিতা হয়ে উঠেছেন। 

বাফুফেকে ধন্যবাদ ছোটনকে তার স্পেসটা দেওয়ার জন্য। বছরের পর বছর তাকে এই কাজটা চালিয়ে নিতে দেওয়ার জন্য। হ্যাঁ, তারা হয়তো খরচ বাড়বে বলে ছোটনকে সরিয়ে ‘বড়’ কাউকে আনেননি। তাতে শাপে বর হয়েছে। এ ছাড়াও যে যেভাবে এই দলটার পাশে থেকেছেন, সবাইকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। 

জননীদের একটা কথা বলবো, যে ক্যামেরার আলো কাল দেখতে পেলেন, তাতে ভুলবেন না। আপনাদের অনেক কাজ বাকী। নিজেদের বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে হবে। সে অবধি মাথা ঠান্ডা রাখুন। আপনাদের নিয়ে অনেক উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। অনেক কার্টুন, ছবি তৈরি করা হচ্ছে। সেসব ফাঁদে পা দেবেন না। 

আপনাদের এই লড়াই কারো বিপক্ষে নয়। আপনারা ফুটবলই খেলুন। ব্যর্থ বিপ্লবীর বাসনা পূরণ করার চেষ্টা করবেন না। আপনারা এই সমাজের অংশ। সমাজ নিয়েই আপনাদের চলতে হবে। কালই তো দেখলেন লাখো মানুষ আপনাদের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। ফলে মানুষ আপনাদের সাথে আছে। কাউকে শত্রু বানানোর দরকার নেই। 

জননীরা আমার, আমরা সাংবাদিকরা বড় মন্দ মানুষ। আজ সাফল্য পেয়েছেন, আপনাদের জন্য বাস বানানোর প্রক্রিয়াও আমরা লাইভ করেছি। কাল ব্যর্থ হলে আপনাদের পাশে ওই ছোটন ভাই আর পরিবার ছাড়া কেউ থাকবে না। মনটা শক্ত করে এসব ভুলে যান। একটু বিশ্রাম নিন। তারপর নতুন অভিযানে ঝাপিয়ে পড়ুন। 
আরও অনেকবার এমন মায়ের মধুর হাসি দেখতে চাই। 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়