ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বন্দ্ব এবং পূজা-যজ্ঞ

প্রদীপ অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ১ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ০৯:০১, ২ অক্টোবর ২০২২
ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বন্দ্ব এবং পূজা-যজ্ঞ

ব্রাহ্মণ, সনাতন ধর্মের চতুর্বর্ণের এক বর্ণ। শাস্ত্রমতে যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন বা দর্শন করেছেন তিনিই ব্রাহ্মণ। সনাতন সমাজের বর্ণাশ্রম অনুযায়ী একজন উপনয়ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে হন দ্বিজ, বেদ পাঠের মধ্য দিয়ে হন বিপ্র, এবং ব্রহ্ম সাক্ষাৎ লাভ করলে হন ব্রাহ্মণ। এ কারণে বেদে ব্রাহ্মণকে বিপ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ব্রাহ্মণ, শূদ্র ব্রাহ্মণ এই রকম বলা হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ৪র্থ অধ্যায়ে, জ্ঞানযোগের,১৩শ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:

“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবীভাগশঃ। তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্।” অর্থাৎ প্রকৃতির তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) ও কর্ম অনুসারে আমি মানব সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।

১৮শ অধ্যায়ে, মোক্ষযোগে, ৪১শ শ্লোকে তিনি আবার বলেছেন: “ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণ্ঞ্চ পরন্তপ। কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ।” অনুবাদ, স্বভাবের গুণেই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র এই চারি জাতির কর্ম বিভক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ চারি বর্ণ সৃষ্টি জন্ম, বংশ বা উপাধির ভিত্তিতে নয়, গুণ-কর্ম এবং স্বভাবের ভিত্তিতে। যিনি সেবা এবং শ্রমের উচ্চমার্গে তিনি শূদ্র, যিনি সম্পদ অর্জন-পেশার উচ্চমার্গে তিনি বৈশ্য, যিনি বীরত্ব গৌরবের উচ্চমার্গে তিনি ক্ষত্রিয়, যিনি জ্ঞানের উচ্চমার্গে তিনি ব্রাহ্মণ। 

এখানে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ মূল্যায়নের মানণ্ড নেই, কর্মগুণে ব্রাহ্মণ বংশজাত শূদ্র হতে পারে, আবার শূদ্র বংশজাত ব্রাহ্মণও হতে পারে। ১৮শ অধ্যায়ের,  ৪২শ শ্লোকে ভগবান ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম নির্দেশ করেছেন। “শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ। জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।” অর্থাৎ শম, (সংযম) দম (দমন), তপ (তপস্যা), শৌচ (শুচিতা),  ক্ষান্তি (সহন ক্ষমতা) সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এগুলি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম। এসকল স্বভাবজাত কর্ম-গুণ যার রয়েছে তিনিই ব্রাহ্মণ। এক্ষেত্রে জন্ম বা বংশপরিচয়ের কোন ভূমিকা নেই। 

পুরোহিত শব্দটি সংস্কৃত ‘পুরস্’ এবং ‘হিত’ শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। পুরস্ শব্দটি (পুর-পুরোধা বা প্রধান)  সম্মুখ অর্থে, এবং হিত শব্দটি স্থিত বা অবস্থান অর্থে। মাঙ্গলিক কর্মে প্রধান ব্যক্তি বা সম্মুখভাগে যিনি অবস্থান করেন তিনিই পুরোহিত। ধর্মসমাজে এটি একটি পেশা। পুরোহিত নিজ ধর্ম পালনের জন্য অথবা অন্যের নামে সংকল্প করে পূজা-যজ্ঞাদি করে থাকেন। যার নামে সংকল্প করে পূজা করা হয় তাকে যজমান বলে। যজমান নিজেও পূজা করতে পারেন, তবে সাধারণত যজমান পুরোহিতকে পূজা করে দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে আনেন এবং জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বর্ণের লোকেরাই পৌরোহিত্য করেন, যা অপ্রয়োজনীয়।

যেহেতু জন্মসূত্রে চারি বর্ণের ধারণাটি শাস্ত্রানুযায়ী ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক ফলে জন্মসূত্রে  ব্রাহ্মণ বংশের অযোগ্য ব্যক্তির দ্বারা পৌরহিত্য করানো অনুচিৎ এবং অপরাধমূলক। সাধারণ বিবেচনায় নিম্নলিখিত গুণসম্পন্ন যে কোনো বর্ণের পুরুষ বা স্ত্রীলোক পৌরহিত্য করার যোগ্য।
১. সংস্কৃত ভাষা লেখা ও পড়ার দক্ষতা 
২. হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান থাকা 
৩. নিত্যকর্ম ও পূজাবিধি সম্পর্কে তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক জ্ঞান ও ধারণা থাকা 
৪. ধর্মশাস্ত্রে এবং শাস্ত্রীয় রীতি-নীতি ও প্রথার উপর অভিজ্ঞতা থাকা 
৫. সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মানুরাগী, প্রগতিশীল ও জনসাধারণের প্রতি মমত্ববোধ থাকা
৬. শুদ্ধভাবে ধর্মশাস্ত্র পাঠ ও মন্ত্র উচ্চারণের দক্ষতা থাকা 
৭. বিভিন্ন পূজা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, নিয়ম-নীতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা
৮. পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা
৯. আচারণগত দিক থেকে ধৈর্যশীল, সৎ, ন্যায়পরায়ণ
১০. কথা ও কাজের সমন্বয় থাকা
১১. সুকণ্ঠি, সদাচারী, শিষ্টাচারসম্পন্ন, সম্মানিত ও আদর্শ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া

বৈদিক যুগে সনাতন ধর্মে জন্ম-বংশভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথা ছিল না। ছিল না কোনো ধর্মীয় নিপীড়ন। ছিল ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের সাধনা, হাজার হাজার অব্দ-খ্রিস্টাব্দ ছিল যাগ-যজ্ঞ, দান-ধ্যান। একাদশ দাদ্বশ শতাব্দী ব্যাপী গোপন-ব্রাহ্মণ শাসক, সেন শাসনামলে রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায়,  শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বারংবার নির্দেশিত বিধান উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠিত হয় জন্মভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথা, নৃশংস বর্ণবাদ। 

রাজা বল্লালসেন, লক্ষণসেনের সময়কালে কর্ণাট থেকে আমদানী করা ব্রাহ্মণ, রাজসভার পঞ্চরত্ন-পঞ্চব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ কবি-শাস্ত্রকার, ব্রাহ্মণ রাজকর্মচারীদের পরিমণ্ডল থেকে জন্ম নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মণদের আধিপত্য,  ব্রাহ্মণগণ তৈরি করতে থাকে সমাজিক বিধিবিধান। ব্রাহ্মণ,পুরোহিত, দিক্ষাগুরু হয়ে যায় একই বর্ণ। কুক্ষিগত হয় ধর্মাধিকার, শাস্ত্রাধিকার। প্রতিষ্ঠিত হয় কৌলীন্য প্রথা। বন্ধ হয়ে যায় আন্তবর্ণ খানাপিনা, আত্মীয়তা। ছিন্ন হতে থাকে হিন্দু সমাজের আন্তরিকতার বন্ধন। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে এবং উদ্ভূত  বর্ণবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয় অসংখ্য তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায় পৃথিবীর অনাদী প্রাচীন, তাবৎ মানবিক গুণাবলী সংশ্লেষিত সনাতন ধর্ম। এই সংকটের উপশাখা হচ্ছে পুরোহিত পেশা সংকট।

পুরোহিত পেশা সংকটের দুটো দিক। প্রথমত, পুরোহিতদের সংকট, দ্বিতীয়ত, পুরোহিত সংকট। বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস, মানুষের মধ্যে রজঃ এবং তমঃ গুণ বৃদ্ধি, সম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় দেশান্তর, আর্থসামাজিক সংকট ইত্যাদি নানা প্রতিকুলতার কারণে পূজা-উৎসবের সংখ্যা হ্রাস  পাওয়ায় ফলে পুরোহিত পেশার আয়ের মাধ্যমে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। তদোপরি পুরোহিতগণের প্রতি পূজারীগণের আর্থিক অবহেলা এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। যেমন ২০২১ এর দুর্গোৎসবের পরিসংখ্যানে, অধিকাংশ পূজায় ঢাকীকে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে পুরোহিতকে দেওয়া হয়েছে তার প্রায় অর্ধেক। পূজায় পুরোহিতের প্রাপ্য উপকরণগুলোও হয় অত্যন্ত নিম্নমানের, ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার অযোগ্য।

অপর দিকে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, এবং জন্মগত-বংশগত ব্রাহ্মণই পুরোহিত, গণমানসে এই দুই ভ্রান্ত বিপজ্জনক ধারণা বিদ্যমান। ফলে  বন্ধ হয়ে গেছে বৈদিক যুগের ন্যায়, ব্রহ্মত্ব অর্জনের সাধনা, বন্ধ হয়ে গেছে যোগ্য পুরোহিত হওয়ার প্রক্রিয়া প্রচেষ্টা প্রতিযোগিতা। জ্ঞান-প্রজ্ঞাহীন, সাত্ত্বীক আহার-আচরণহীন, ত্রিসন্ধ্যা-গায়ত্রীহীন, বাংলা-সংস্কৃত জ্ঞানহীন, ভুল আচার-উচ্চারণ-মূদ্রা-মন্ত্রের পুরোহিত দ্বারা সাধিত হচ্ছে দায়সারা অপরাধমূলক পূজা-যজ্ঞ।

সংকট উত্তোরণের জন্য প্রয়োজন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গণমানস থেকে কিছু বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিপদজনক ধারণা উপড়ে ফেলতে হবে। মুছে ফেলতে হবে জন্মভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথা, মুছে ফেলতে হবে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের ধারণা। মুছে ফেলতে হবে বংশগত ব্রাহ্মণ পূজা-যজ্ঞে পৌরহিত্য করার ধারণা। মুছে ফেলতে হবে বর্ণবাদী খানাপিনা প্রথা। ব্রহ্মত্ব একটি গুণ, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নয়, এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। একজন ডাক্তারের সন্তান ডাক্তার নয়, শিক্ষকের সন্তান শিক্ষক নয়, তেমনি ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ হতে পারে না। 

পৃথিবীর অপরাপর ধর্মে যেমন ইমাম, মাওলানা, ভিক্ষু, পাদ্রী গুণের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন তেমনি গুণের ভিত্তিতেই নির্বাচিত হবেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। এটাই পবিত্র গীতার নির্দেশ। এই নির্দেশের বিচ্যুতির ফলেই সৃষ্টি হয়েছে ধ্বংসাত্মক বর্ণবাদ, বদ্ধমূল হয়েছে একবর্ণ অন্য বর্ণের হাতে ভাত খেলেই জাত যাবে এমন গর্হিত মানসিকতা। আমাদের এ মানসিকতা  থেকে বেরিয়ে আসার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ আজ নিজের ফাঁদে নিজেই বন্দি হয়ে মৃত্যুশয্যায়। এখন সবাইকে সচেতন হতে হবে, মনে রাখতে হবে মন্ত্র-উপাচারহীন পূজা অপরাধ নয়, ভুল মন্ত্র-উপাচারে পূজা পাপ।  পৌরহিত্যের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে সকল বর্ণের দ্বার উন্মুক্ত হলে শুদ্ধ-পাপমুক্ত হবে আমাদের পূজা-যজ্ঞ।  ঋদ্ধ হবে সনাতন ধর্ম, কলঙ্কমুক্ত হবে হিন্দু সমাজ।

লেখক: সভাপতি, হিন্দু কল্যাণ সংস্থা, টঙ্গী শাখা
 
 
   


 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়