তরুণরা সড়কে কতটা নিরাপদ
তরিকুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
আন্তর্জাতিক যুব দিবস আজ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী তরুণ ও যুবক। তারাই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত করিগর। বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন অকালে ঝরছে তরুণদের প্রাণ। যার অন্যতম কারণ সড়ক দুর্ঘটনা (রোড ক্রাশ)। দেশে পাঁচ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল চালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনার (রোড ক্রাশ) শিকার হচ্ছেন এবং অন্যদের শিকার করছেন। মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করার কারণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
বিদায়ী ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি থাকায় দুর্ঘটনায় নিহতের পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা বেশি। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে উদ্যোগ নেওয়া না হলে এই বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও রাস্তা পারাপার ও নেশাজাতদ্রব্যের ব্যবহারের ফলে সড়কে তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
প্রতিবছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। এটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে সামনে চলে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, গত ৫ বছরে দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ২৮ হাজার ২৯৯টি দুর্ঘটনায় ৩৯ হাজার ৫২২ জন নিহত এবং ৫৮ হাজার ৭৯১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে হতাহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৪১ জন শিক্ষার্থী।
গত ৫ বছর আগে ২০১৮ সালে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তায় দ্রোহ আর স্লোগানে কিশোর তরুণ-তরুণীদের হাত ধরে কেবল ৯ দিনে অন্য এক বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী। কেবল ২০১৮ সালেই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরেও এটি বিরল। এই ধারাবাহিকতায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৯ দফা দাবি মানার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। পাস হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে সপ্তাহব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম চালায় ডিএমপি। আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের কঠোর হাতে দমনে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। তবে এত কিছুর পরও কতটুকু নিরাপদ হতে পেরেছি আমরা? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ ছাড়াও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে রাস্তা পারাপারের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারি বিজ্ঞান স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তার সহপাঠীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়কে নেমে আসে। এ ছাড়াও ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর রামপুরায় বাসচাপায় শিক্ষার্থী মো. মাইনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয় নিহতের প্রতিবাদে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাকচাপায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রামপুরা ব্রিজের ওপর একপাশে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তরুণ শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের ঘটনা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে দেখা যায়। সবশেষ চলতি মাসের গত ৬ তারিখে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রাকের চাপায় আনিকা আক্তার শরিফা নামে এক স্কুলছাত্রী নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শত শত শিক্ষার্থী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।
বিআরটিএ’র তথ্যানুযায়ী গত জুলাই মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৬৬টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫৩৩ জন এবং আহত হয়েছে ৯৩৪ জন। পুলিশের বরাতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, ২০২২ সালে ৫ হাজার ২০০ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৬৩৮ জন নিহত হয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিআরটিএ কার্যালয়ে বিগত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী দাবি করেন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে, ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু অর্ধেক কমিয়ে আনতে হবে।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে আনুমানিক ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়কে। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। কিন্তু ১০ বছরেও দেশে কমেনি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা।
বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। আমাদের দেশে এটি নিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কাজ করে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের আওতায়ও সড়ক রয়েছে। ফলে সড়ককে আরও নিরাপদ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ভবিষ্যতে যারা দেশ পরিচালনা করবে, দেশের সুনাম দেশের বাইরে পৌঁছে দিবে সেই সব তরুণদের নিয়ে আমরা কতটুকু ভাবছি? এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তরুণরা সড়কে কেন নিরাপদ নয়? শুধু তরুণ নয়, সকলের জন্য সড়ক নিরাপদ করতে প্রথমেই প্রয়োজন একটি উপযুক্ত আইন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে আইনটি আছে তা হলো সড়ক পরিবহন আইন। বা মোটরযান আইন। যা সড়ক নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে না। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কোন আইন নেই। ২০১৮ সালের আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক বা সড়কে তাদের নিরাপত্তা। তাদের স্বরে স্বর মিলিয়ে আজ যুব দিবসে আমারও দাবি একটি উপযুক্ত সড়ক নিরাপত্তা আইন ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। সেই সাথে আমি আশাবাদী সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য পূরণে বিষয়টি আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিবেন।
লেখক: অ্যাডভোকেসি অফিসার, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
তারা//