ঢাকা     সোমবার   ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৩ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

এমন বাংলাদেশ দেখেনি কেউ

কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১২, ২৫ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ২১:০০, ২৬ আগস্ট ২০২৪
এমন বাংলাদেশ দেখেনি কেউ

এ এক অন্য বাংলাদেশ! এমন বাংলাদেশ দেখেনি কেউ। মানুষের বিপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে-পাশে দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করার নজির যদিও এ দেশের অভিজ্ঞতায় একেবারে কম নয়, তবে এবারের ঘটনা যেন অতীতের রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। যেভাবে ছাপিয়ে গেছে এমন বন্যার পূর্ব ইতিহাস। 

বন্যায় ভাসছে ১১ জেলা- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জনপদের ১০ লাখ পরিবার এখন পানিবন্দী। এসব পরিবারের সদস্যরা বেশীরভাগই জানেন না এই দুর্দিনে কে কোথায় আছে, কেমন আছে? কোনো কোনো জেলার মানুষের কাছে এমন বন্যার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। এখানকার ষাট, সত্তর, আশি এমনকি নব্বই বছর বয়সী মানুষও স্মৃতি হাতড়ে বলেছেন- এরকম বন্যা তারা কখনওই দেখেননি! বিশেষ করে কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালীর মানুষ। এমনকি এসব জনপদের যেসব স্থানে বন্যার পানি ওঠার ঘটনা অতীতে কখনওই ঘটেনি এবার সেখানেও পানি উঠেছে। মুহূর্তেই মানুষ কতোটা অসহায় ও বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে এই বন্যায় স্পষ্ট হয়েছে। ওই সব জনপদের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানির তোড়ে আক্রান্ত হয়েছেন; পানি বেড়েছে হু হু করে। 

এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল একটা জনপদ পানিবন্দী হয়ে ওঠার নজিরও সম্ভবত এই প্রথম। এসবই বিপদের খবর, আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তার খবর। কিন্তু না, এরকম আকস্মিক ও ভয়াবহ বন্যার পরও আমাদের দুশ্চিন্তা ও শঙ্কার কিছু নেই। কারণ, বন্যাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা দেশ। দেশের ছাত্র সমাজ। যার অগ্রভাগে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মুখ। এসবই আমাদের জন্য আশার আলো, দেশকে নিয়ে গর্ব ও গৌরব করার পাথেয়, অমূল্যে এক সম্পদ বিশেষ।

এগারো জেলায় এমন একটা সময়ে বন্যা আঘাত করেছে, যখন আকাঙ্ক্ষিত এক গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ হাঁটছে নতুন স্বপ্ন পূরণের পথে। সকলের মতো আমরাও আশাবাদী হতে চাই এই ভেবে যে, এবার নিশ্চয় লক্ষ্যভেদী হবে সকল স্বপ্ন। এবার কেন? কারণ, এবারের নেতৃত্বের অগ্রভাগে সরাসরি রয়েছে এদেশের ছাত্র সমাজ। যদিও এরকম স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটা বাংলাদেশের ললাটে একেবারে নতুন কিছু নয়। এই ভূখণ্ডের জনগণ বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের পথে বারবার হেঁটেছে। কিন্তু সেই পথ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই স্বৈরাচারের আবির্ভাব হয়েছে। হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিরেখা। আশাহত হয়েছেন এ দেশের আপামর মানুষ। তারা ধরে নিয়েছেন ‘রাজা যায় রাজা আসে’র মতো কেবল ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে, জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। 

বেদনার হলো ভিন্নতর প্রেক্ষাপটের সূচনা লগ্নেই প্রথম ধাক্কাটা এল ১১ জেলায় বন্যার মতো সর্বগ্রাসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটায়। যখন সবার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের সংস্কার ও প্রশাসনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, তখন বন্যা হয়ে উঠল সকলের মনোযোগের ভরকেন্দ্র। কারণ, মানুষ বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। এখন সময় মানুষ হয়ে মানুষের পাশ দাঁড়ানোর। যার পক্ষে যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত প্রসারিত করার।

আশার কথা, এই সময়েও আমাদের ছাত্রসমাজ নতুন আলোর পথরেখা নির্মাণ করেছে। আমাদের আশাবাদী হওয়ার ইতিহাস রচনা করেছে। বন্যায় ১১ জেলার মানুষ যখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন, তখন তাদের পাশে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার যোগান দিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে আমাদের ছাত্র সমাজ। বন্যার্তদের চোখে-মুখে যখন চিন্তার রেখা, ছাত্রদের চোখে-মুখে তখন আশ্বাসের বাণী। ত্রাণ সংগ্রহে এবং তার যথোচিত বিলি বন্টনে জেগে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জেগে রয়েছে টিএসসি, জেগে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ সারি ধরে সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। এমনকি যাদের আমরা নিঃস্ব মনে করি, যাদের দেখে আমাদের এই ধারণা হয়েছে যে, এরা বুঝি কেবল নিতেই অভ্যস্ত, তারাও সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। মুটে-মজুর-কুলি-ভিক্ষুকেরাও বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। এই যে, মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা- এই তো আমাদের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে আটকিয়ে রাখার সাধ্যি কার?

প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন এ দেশের মানুষ প্রয়োজনে একতাবদ্ধ হতে পারে, ঠিক তেমনি মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগেও তারা হয়ে উঠতে পারে দুর্নিবার এক প্রতিরোধ শক্তি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে সম্মিলিত সাহসে, অনিবার্য এক বজ্র নির্ঘোষে। এ কারণেই এ দেশে রচিত হয় গণঅভ্যুত্থানের নতুন ইতিহাস। দক্ষিণ এশিয়ায় যার নজির রয়েছে কেবল বাংলাদেশে।  

আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থান বলতে বোঝানো হয় আকস্মিক জাগরণ। অবৈধভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে দলগতভাবে অবস্থান তুলে ধরে ক্ষমতাচ্যুত করাকে গণঅভ্যুত্থান বলে। কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। মনে রাখতে হবে, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান কোনো দল দ্বারা সংগঠিত হয়নি। এখানে ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে, সরকারের বাইরে থাকা সকল দল তাতে সমর্থন যুগিয়েছে কেবল। এই গণঅভ্যুত্থান ছাত্রদের নেতৃত্বে যেমন সংঘটিত হয়েছে, তেমনি অভ্যুত্থান পরবর্তী যে সরকার তার সঙ্গে তারাও গভীরভাবে যুক্ত ও পরিচালনার অগ্রভাগে রয়েছে। 

আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, পৃথিবীতে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যার বাসিন্দারা মাত্র সাড়ে তিন দশকের মধ্যে দুইবার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। আবার আরও একটু এগিয়ে এভাবেও বলা যায়, এই ভূখণ্ড মাত্র ছয় দশকের মধ্যে তিনবার গণঅভ্যুত্থান দেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের এ রকম যুগান্তকারী সাফল্যের পরও কাঙ্ক্ষিত বিজয় কেন অর্জিত হয় না? এর উত্তর একটাই আমরা অনেক বেশি দ্বিধাবিভক্ত সমাজে বসবাস করি। ঘরে-বাইরে সর্বদা দ্বিধাবিভক্ত মানসিকতার চর্চা জারি রাখি। যার পেছনে রয়েছে অযথা সন্দেহ, অবিশ্বাস, আর অহেতুক হিংসাবৃত্তি। বিভক্ত সমাজ, বিভক্ত নাগরিক নিয়ে একটা দেশ কখনোই তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

১১ জেলার বন্যা মোকাবিলায় ছাত্র সমাজ যে নজির তৈরি করে চলেছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হবে বলে আমরা মনে করি। বন্যার্তদের পাশে এখন অনেকেই এগিয়ে আসছেন। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সেসব হ্রস্ব। রাজনৈতিক সরকারের সময় যে ভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এগিয়ে আসে, সেই তুলনায় অনেক কম। এতে প্রমাণিত হয়- রাজনৈতিক সরকারের সময় যারা এগুলো করে তাদের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ। ওই সময় ওগুলো করা হয় মূলত দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। যা হলে খুলে যাবে অবৈধ কিছু করার পথ। তাদের উদ্দেশ্য যতি সত্যিই মানবসেবা হতো তাহলে নিশ্চয় এখনও তারা একই ভূমিকা পালন করতেন।

বন্যার অভিজ্ঞতা দেশবাসীর কাছে বৃহত্তর অর্থে একেবারে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর্যুপরি পরিচয়। এ কারণে সাহিত্যেও তার চিত্র উঠে এসেছে নানাজনের লেখায়। বন্যায় মানুষ ও প্রাণী কীভাবে একত্রে বাঁচার চেষ্টা জারি রাখে, তার বিবরণ আমরা বিভিন্ন সময় পেয়েছি। পত্রিকায় এসেছে, একজন পানি পার হওয়ার সময় একটা সাপও তার পাশ ঘেঁষে পার হয়েছে। আমরা ইব্রাহীম খাঁর ‘ভাঙ্গা কুলা’ গল্পে এরকম বর্ণনা পাই। তিনি লিখেছেন, ‘অনেকগুলি বাড়ী গেলাম। ঘরের ভিতরে মাচা পেতে তারই উপর অভাগারা কোন রকমে বসে আছে। রাতে ওরই ওপর জড়াজড়ি করে শোয়। মায়ের কোল হতে ঘুমের মধ্যে বাচ্চা হয়তো গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়, সকালে উঠে আর তাকে পাওয়া যায় না। অন্ধকারে দড়ির মত গায় বাজে-কি জানি কি! বিষম ঠাণ্ডা! বোঝে, ও ওদেরই মত বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছে...আঘাত না করলে এখন কিচ্ছু বলবে না। সকালে মাচা হতে নেমে গিয়ে কাছের কোন ধুমচা গাছের ডালে কোন রকমে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে, কেউ ওদের কিছু কয় না। গরুরা দিনের পর দিন গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, কারো কারো বাড়িতে সাঁতার। গিরস্থ গরুর দড়ি খুলে দিয়ে বলছে : যারে যা, যদি পারিস, তবে গিয়ে কোথাও ওঠ। আমি তোদের বাঁচাতে পারলাম না। ওরা অকুল দরিয়া পাড়ি দিতে ভাটি পথে চলে : যতক্ষণ দেখা যায় গিরস্থ এক দৃষ্টে চেয়ে দেখে, তারপর ওরা অদৃশ্য হয়ে যায়, গিরস্থ বুক চেপে ধরে মাচায় এসে ওঠে। একটা আক গাছ দেখলাম- সাপ ব্যাঙ শিয়াল মুরগী : এ ঘোর বিপদে ওরা হিংসা ভুলে একত্রে বসে আছে।’
এই গল্প উনি লিখেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর। তারপর গড়িয়েছে অনেক সময়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার খাসলত খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা বাস্তবায়ন করেছি- এমন কথা হলফ করে বলা যাবে না। দেশের নদ-নদীগুলোকে ঠিক মতো ড্রেজিং করা হয়নি। যেগুলো করা হয়েছে, তাতে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো চিন্তার ছাপ নেই। খনন পরবর্তী সময়ে বালু বা মাটি এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে বর্ষা এলেই ওসব আগের জায়গায় ফিরে যায়। ফলে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। 

রাস্তাগুলো যেভাব উঁচু করে নির্মাণ করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। রেল লাইনগুলোও সমতল থেকে আগে যতটা উচ্চতা ছিল তার যথাযথ সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে, বিপদাপন্ন মানুষের সাময়িক আশ্রয়ের কোনো জায়গা নেই। স্কুল-কলেজ ও প্রার্থনালয়গুলোকে এ কাজে ব্যবহার করা যেত। নীচতলাকে পুরোটাই পিলারে দাঁড় করিয়ে দোতলা তিনতলা পাঠদান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ব্যবহার করার নিয়ম করা যেত। শাসক-প্রশাসক বর্গ এসবে দৃশ্যমান ও টেকসই কোনো ভূমিকা পালনের নজির সৃষ্টি করেনি। কেবল রুটিন ওয়ার্ক আর ফাইল চালাচালিতেই ওরা দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ করেছেন। 

এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই এ দেশে প্রাণহানি। অর্থসম্পদ নাশ এবং বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তির অপচয়। এবারের বন্যা এসেছে একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যরকম এক সময়ে। এ রকম সময় জাতির ভাগ্যে সবসময় আসে না। এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছে অরাজনৈতিক সরকার। রাজনৈতিক সরকারের অনেক সময় হাত-পা বাঁধা থাকে। যেটা বর্তমান সরকারের নেই। এখন এই সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষম। 
ইব্র্রাহীম খাঁর ওই গল্পের শেষটা হয়েছে এভাবে : ‘শুনতে পাচ্ছেন না, ঐ যে পানির গর্জন? ঐখানে একটু আগে একটা নৌকাডুবি হয়েছিল। সবাই পারে দাঁড়িয়ে হায় হায় করতে লাগল, এমন সময় ঐ লোকটি কোথা থেকে এসে পানিতে লাফিয়ে পড়ল। দুটি মানুষ ডুবেছিল, ডুব দিয়ে খুঁজে দুজনকেই তুলেছে; কিন্তু নিজে হয়রান হয়ে পড়েছে।
ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে বসলাম। তার মুখের উপর গভীর তৃপ্তির একটা স্নিগ্ধ জ্যোতি ছড়িয়ে আছে। চিনলাম, এ আমাদের বড়মিঞা! 
ক্যাম্পের ডাক্তার সাথে ছিল, দেখতে বল্লাম। ডাক্তার হাত দেখল, বুক দেখল, তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বল্ল- সব শেষ! হার্ট ফেল করেছে।
আমি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর তার বিদেহী আত্মার প্রতি মনে মনে ছালাম জানিয়ে বল্লাম : বন্ধু, দুনিয়ার দফতরে যারা মানুষের নাম লিখে রাখে, তাদের নজরে তুমি পড়বে না জানি। কিন্তু আলিমুল গায়েব বলে যদি কেউ থেকে থাকে, তবে তার দফতরে তোমার কীর্তি নিশ্চয় সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকবে।’

এই গল্পের বড় মিঞা আবার ফিরে এসেছে। ওরা বারবার ফিরে ফিরে আসে যে কোন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়ানের অবিচল লক্ষ্যে। এই বাংলাদেশে কখনও ওরা বড়মিঞা, কখনওবা ওরা মুগ্ধ, কখনওবা নাম না জানা মহৎ কোনো প্রাণ। কিন্তু ওরা আছে। ওরা থাকে এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে। এখন যদি কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যান কিংবা শরীরচর্চা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তা হলে দেখবেন ওখানে অসংখ্য বড়মিঞা, মুগ্ধ বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন। এই বাংলাদেশ, যারা দেখেনি কখনও তাদের আমরা স্বাগত জানাই। আসুন, দেখুন অন্য এক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ কারও অনুগ্রহে নয়, নিজের শক্তিতেই বলিয়ান। এই বাংলাদেশ নিয়েই সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন:
‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ 

এই বাংলাদেশ জেগে আছে এ দেশের সাধারণ মানুষের বুকের গভীরে গভীর-গভীরতর এক ভালোবাসায়। আমাদের গভীরতর প্রত্যয় ও প্রতীতি হলো, এ রকম বাংলাদেশ কখনো দেখেনি কেউ।

লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়