ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আই অ্যাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অব বাংলাদেশ

মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২৯ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আই অ্যাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অব বাংলাদেশ

সাকা চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত একটি নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী)।

 

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাকপটু এই রাজনীতিক বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মকাণ্ড ও মন্তব্যের জন্য খবরের শিরোনাম হয়েছেন।

 

ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালেও নানাভাবে আলোচিত হয়েছেন এই বিএনপির নেতা। বিতর্কও হয়েছে তাকে নিয়ে অনেক। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নয় কার্যদিবস  জবানবন্দি দেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

 

আলোচিত সেই জবানবন্দি

আমার নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জন্ম ১৩ই মার্চ ১৯৪৯। আমার কাজিনদের মধ্যে রয়েছেন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাঈনুর রেজা চৌধুরী, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ফজলে করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমান প্রমুখ। আমার বাবার নাম এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার সূত্রেই আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। তাই তার ব্যাপারে তো বিস্তারিত বলতেই হবে! এখানে একজন প্রফেসর সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন, যিনি ৪০ বছর ধরে নিজের জন্মস্থান নিয়ে মিথ্যা বলছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯১৯ সালের ২৬ শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল, বরিশাল বিএম কলেজ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে। মেধাবী এবং এলিট পরিবারের শিক্ষার্থীরা সেই হোস্টেলে থাকতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী দুই বার ওই হোস্টেলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। ফর্মাল চার্জে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তার প্রতিটি লাইনের জবাব আমি দিব। তারা নবাব সিরাজউদ্দোলা থেকে শুরু করেছেন আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি, আমি সিরাজউদ্দৌলার আগে যাব না। আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ফর্মাল চার্জে বলা হয়েছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। এ বক্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অবমাননাকর। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ২৮৮ পৃষ্ঠার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ, তিতিক্ষার বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসিকিউশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তা বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব। এটা খুবই প্রলুব্ধকর। বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে অন্য কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভক্তি হয়েছিল সে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানাই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা। আর বাংলাদেশের বিচারপতিদের সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হয়েছে। দেশে ফেরার তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মিত্র বাহিনীর সদস্যদের দেশ ত্যাগ করিয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের এক মহত্তম ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপান যা করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু তা করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। আজ চাচার (বঙ্গবন্ধু) বই নিয়ে এসেছি। আমার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল? আমি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কে তা তো এখানে বলতেই হবে। আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষার জন্যই এখানে লড়াই করছি না, আমি আমার মর্যাদা রক্ষার জন্যও লড়াই করছি। ৩৩ বছর ধরে সংসদে আছি। ছয় বার জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে। ১৯৭৮ সালের শেষদিকে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। সংবিধান ২ অনুচ্ছেদের ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থা স্থাপন করেই আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করি। (যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে- ক) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যেসকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদ্‌বহির্ভূত।) এ সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। ২ অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্ধারিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি সুনিশ্চিতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গীকার প্রকাশ পায়। প্রসিকিউশন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি এক ধরনের বিদ্রূপ। যে তত্ত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। এ প্রস্তাব বাংলাদেশকে বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

 

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এ বক্তব্যে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমনসহ প্রসিকিউটররা বলতে থাকেন, এটা যাবে না। জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, এটা আমার বক্তব্য। আপনারা আপনাদের যুক্তির সময় জবাব দিবেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব কথাগুলো জবানবন্দি থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে সালাউদ্দিন কাদের তার জবানবন্দিতে বলেন, এ প্রস্তাব বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব তা আমি বলতে চাই কিন্তু কিছু লোক তাতে আহত (বিরক্ত) হবেন, তাই আমি তা বলছি না। দ্বিজাতিতত্ত্বের সুবিধাভোগী কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আইনজ্ঞ যাদের নাম আমি স্মরণ করতে পারি তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সাত্তার, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ আরো অনেকের কথা। যাদের প্রত্যেককে নিয়ে এ জাতি গর্বিত। এ বক্তব্যের ব্যাপারে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব আমাদের জন্য কীভাবে সুফল বয়ে এনেছে তা বোঝানোর জন্যই এটা বলা প্রয়োজন। আমাদের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে নিয়েও আমি গর্বিত। তিনিও দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক (জওহরলাল নেহেরু) তার নিজের সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এভাবে, সংস্কৃতিগতভাবে আমি মুসলিম, শিক্ষাগত দিক থেকে ইংরেজ এবং দুর্ভাগ্যজনিত জন্মগত কারণে হিন্দু। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি জন্মসূত্রে চট্টগ্রামী। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। মতিলাল নেহেরুর ছেলের মতো আমি নিজেকে দুর্ভাগাও মনে করি না। চট্টগ্রাম কখনোই নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসিত অঞ্চলের অংশ ছিল না। আমি সিরাজউদ্দৌলাকে স্বীকার করি না। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ। আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সারা দুনিয়াতেই এখন মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলছে। সোমালিয়া, বসনিয়া, গুজরাট, ফিলিস্তিন সারা দুনিয়ায় এখন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার। মুসলিমদের প্রতি আমার কমিটমেন্টের কোনো রাজনৈতিক সীমানা নেই।

 

নিজেকে বঙ্গবন্ধুর এক নিকটজন দাবি করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় তখনকার সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষে আমার অবস্থান। কোনো বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বা দলের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নেই। তিনি বলেন, ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক সময়ই বড় ফারাক থাকে। এ প্রসঙ্গে তার বন্ধু ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ঘটে যাওয়া এক কৌতূহল-উদ্দীপক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। সাক্ষ্যের এক পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, মরেই তো যাব। কিছু রেকর্ডে রেখে যাই। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, পছন্দসূত্রে আমি একজন বাংলাদেশি, জন্মসূত্রে নয়। আমি যখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন সেখানে একটি সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বিচারপতি স্যার জাফর উল্লাহ খান। যিনি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক ছিলেন। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়ায় তার দেশপ্রেম নিয়ে একজন ছাত্র প্রশ্ন তুলেছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তুমি পাকিস্তানি কারণ তোমার মা পাকিস্তানি। যখন আমি নিজ পছন্দের কারণে পাকিস্তানি। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি লন্ডনের বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি ঢাকায় আসি। ব্রিটিশ ভ্রমণ ডকুমেন্ট নিয়ে আমি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগে প্রবেশ করেছিলাম। আমি সে ব্রিটিশ ডকুমেন্ট ইমিগ্রেশন বিভাগে জমা দিয়েছিলাম এবং তখনকার একজন সংসদ সদস্যের সুপারিশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। সে সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের সুপারিশ বাধ্যতামূলক ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে সে পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। এটা রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া বহু মানুষ আর বাংলাদেশে ফিরেননি। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে লিংকন্স ইন থেকে আমি বার এট ল’ পরীক্ষার প্রথম পর্ব শেষ করি। ১৯৭৪ সালে আমি দ্বিতীয় পার্টের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং কাউটস অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করছিলাম।

 

এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, প্রসিকিউশনের বর্ণনামতো চুপি চুপি আমি বাংলাদেশে ফিরিনি। প্রসিকিউশন যেমনটা দাবি করেছে সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৪ অথবা ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত আমি কখনোই আত্মগোপনে ছিলাম না। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে আমি কিউসি শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি বেশ কয়েক বার ব্যবসায়িক কারণে বিদেশ সফরে গিয়েছিলাম। এটাও সত্য যে, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের কালো দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধে কিছু করতে না পারা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য খুবই দুঃখের বিষয়। প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচানো যাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল, আজ ৩৮ বছর পর আমরা তাদের মায়াকান্না দেখছি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমার মরহুম পিতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার সম্পর্ক বঙ্গবন্ধু নিজে তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। যে জাতীয় ঐতিহ্য (বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী) বঙ্গবন্ধুর এক নিকটজনের এ নিপীড়নমূলক বিচারে প্রদর্শনী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রসিকিউশন অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আমি আমার জীবনে প্রথম বার গ্রেপ্তার হয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর। খোন্দকার মোশতাক আহমদের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে। যিনি আমার পিতার ধানমন্ডির বাড়ি দখল করেছিলেন। মুসলমানদের বন্ধন মুক্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা উল্লেখ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমিও সেই মুসলিম উম্মাহার সদস্য। তিনি বলেন, ২০০ বছর ধরে ভারতে মুসলমানরা ব্রিটিশরাজের ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। যারা ভাগ এবং শাসনের (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি অনুসরণ করেছিল। ব্রিটিশরা হিন্দুদের সুবিধা দিয়েছিল আর মুসলিমদের করেছিল বঞ্চিত। বাংলা ভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধিতা মুসলিমদের আহত করেছিল। ব্রিটিশরাজও এতে বিরক্ত হয়েছিল। যার ফলে ১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলন হয়েছিল। আলাদা রাষ্ট্রের জন্য মুসলমানরা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছুটে যান লাহোরে। যেখানে তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যে প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, এটা আমার বিশ্বাস যে ধারণার সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবতার ফারাক থাকে। এ প্রসঙ্গে রেকর্ডেড জবানবন্দির বাইরে তিনি বলেন, আমার সম্পর্কে ধারণা থেকে অনেক কথা বলা হয়। অনেকে হয়তো আমার নাম শুনলেই ভেবে বসেন পাকিস্তানের কথা, ভাবেন আমি এন্টি ইন্ডিয়ান। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, জর্জটাউন স্কুল অব ফরেন সার্ভিসে পড়ার সময় যশবন্ত সিং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমি এবং আমার স্ত্রী তার পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। একসময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে যশবন্ত সিংও বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময় আমার অফিসের স্টাফরা আমাকে না জানিয়ে এক ঝুড়ি আম যশবন্ত সিংয়ের কাছে পাঠানোর জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমের ঝুড়ির সঙ্গে একটি ভিজিটিং কার্ডও দেওয়া হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে রেড অ্যালার্ট জারি করে। আমাকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় ঝুড়িতে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য আছে কি না! প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জবানবন্দিতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, উনি অনেক ভালো ইংরেজি বলছেন। বহুদিন এত ভালো ইংরেজি শুনি না। শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু এ মামলার সঙ্গে এসব বক্তব্যের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব বক্তব্য বাদ দিতে হবে।

 

এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আপনারা আড়াই বছর বলেছেন। অথচ আমাকে বলতে দিচ্ছেন না। আমার সম্পর্কে তো আমাকে বলতে দিতে হবে। এটা তো হ্যামলেটের ভূত নয়। আমাকে তো আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। রাজনীতি মুষ্টিযুদ্ধ নয়। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলামকে এ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া বঙ্গবন্ধুর কোনো সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এর মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারই প্রকাশ পেয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যার বিরুদ্ধে আমার প্রকাশ্য অবস্থান রয়েছে। প্রসিকিউশন এ বক্তব্যে তীব্র আপত্তি জানায়। পরে তা বাদ দেওয়া হয়।

 

প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বারবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বললে তিনি বলেন, ফাঁসি তো দিবেনই। তাড়াহুড়ার কী আছে? ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পরাজয়কে তিনি বর্ণনা করেন ‘জনগণের ইচ্ছার কাছে শক্তির পরাজয়’ হিসেবে। রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতের সংস্কৃতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হিসেবে আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবাই জানে আমার মুখে যা আসে তা-ই আমি সামনাসামনি বলে ফেলি। আমার দোষ একটাই, আমি পুরো পলিটিশিয়ান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নিপীড়ন দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো রূপকথার বিষয় নয়। এ যুগে শুধু জ্যামিতিক হারে নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে। ঔপনিবেশিক যুগে রাজনীতিবিদদের কারারুদ্ধ করা হতো তাদের বাড়ি, ভিআইপি গেস্টহাউস অথবা কখনো কখনো কারাগারের কোয়ার্টারে। রাজবন্দিদের শারীরিক নির্যাতনের কোনো নজির তখন ছিল না। রাজবন্দিদের তাদের চাহিদা অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো। তাদের ব্যক্তিগত আয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হতো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং তার পিতা পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুসহ অনেককে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে ব্রিটিশরাজের ব্যবহার ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ। রাজবন্দিদের প্রতি এ ধরনের শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ- এমনকি ১৯৪৭ সালের পরেও বহাল ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনীতে এ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। পাকিস্তান আমলের দুঃসহ ২৩ বছরেও আমি এমন একটি ঘটনা মনে করতে পারছি না, যেখানে কারাবন্দি রাজনৈতিক নেতাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ আমি শুনিনি।

 

পোশাকধারী ব্যক্তিদের দ্বারা আমি প্রথম দুর্ব্যবহারের শিকার হই ২০০৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারের সময় যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। সে সময় একজন ‘দেশপ্রেমিক’ সেনা কর্মকর্তা ঔদ্ধত্য দেখিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে। ধানমন্ডির বাসা থেকে ৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং নয় ফুট প্রস্থের একটি সেলে না নেওয়া পর্যন্ত আমাকে ওই অবস্থাতেই রাখা হয়। আমার পাশের সেলেই আটক ছিলেন আমাদের বর্তমান মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরের ৪৮ ঘণ্টা আমাদের টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে সময় আমাদের ‘সামরিক আতিথেয়তা’ দেওয়া হয়। সেটা ছিল ২০ মাসের আঘাতের শুরু। রাজনীতিবিদদের শারীরিক নির্যাতনের এ প্রক্রিয়ার আরো শিকার ছিলেন আবদুল জলিল, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকে। নির্যাতনের মাধ্যমে অনেকের কাছ থেকে তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি আদায় করা হয়েছিল। তখন নিপীড়ক সরকারের সহযোগী সংবাদমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রকাশও করা হয়েছিল। প্রত্যেক পেশার মানুষেরই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সমিতি রয়েছে। আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদেরও সমিতি রয়েছে। কিন্তু অসহায় রাজনীতিবিদদের নিজের স্বার্থ রক্ষায় কোনো সমিতি নেই। বরং রাজনীতিবিদরা মাংসাশী প্রাণীর মতো নিজ শ্রেণির মানুষদের গ্রাস করতে ভূমিকা রাখেন। মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর সন্তান হিসেবে জন্মের পর থেকেই রাজনীতির সঙ্গে আমার এক ধরনের সংযোগ ছিল। ভিন্নমতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ সত্তরের দশক পর্যন্ত ছিল। কিন্তু সমসাময়িক রাজনীতিতে তা আর নেই।

 

তার দীর্ঘ জবানবন্দিতে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীকে রাষ্ট্রদ্র্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই মামলায় ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ২ মাস ২৪ দিন নিজের পক্ষে দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তখন আমরা পরাধীন ছিলাম। অথচ এখন স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র তিন দিন জবানবন্দি দেওয়ার পরই আমাকে টাইম ম্যানেজমেন্টের কথা শোনানো হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ বক্তৃতা। ফাঁসি দেওয়ার দিবেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে আমার কথা বলতে দিতে হবে। পুরোনো এক প্রবাদ বাক্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি তুমি কাউকে হত্যা করতে না পারো, তবে তাকে একটি খারাপ নাম দাও। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীতে ১৬ কোটি মানুষকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে অভিযুক্ত করার যোগ্য করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাকে চাপিয়ে আইনে এ সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নিপীড়ন বাংলাদেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটা জনপ্রিয় এবং নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে আরো বেশি সত্য। এক-এগারোর নায়কেরা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল, যেন তাদের নির্বাচন এবং ক্ষমতার বাইরে রাখা যায়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ ত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে চাপ দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন দেশে না ফেরেন।

 

খালেদা জিয়াকে তার বাসা ত্যাগ করে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তৎকালীন নাম) যেতে চাপ দেওয়া হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের দস্যুদের এ দুটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। এ দুজন জাতীয় আইকনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এবং লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত আদালতে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে এ দুই জাতীয় আইকনসহ জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের পার্লামেন্টের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আদালতের মুখোমুখি করা হয়েছিল। এ অপবিত্র কাজের সঙ্গী হয়েছিলেন ভাড়াটে শ্রেণির কিছু লোক। মিডিয়ার একটি অংশ, সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের একটি অংশ এবং কিছু আইনজ্ঞ তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যে আইনজ্ঞরা এক-এগারোর শাসন সমর্থন করেছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের সুবিধাভাগী একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। এক-এগারোর দস্যুরা যে উদ্দেশ্যে রাজনীতিবিদদের নিপীড়ন করেছিল, সে একই উদ্দেশ্যে এখনো রাজনীতিবিদদের ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। ১৯৭৯ সাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে আমি একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। এরপর সব নির্বাচনেই আমি অংশ নিয়েছি, যেসব নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও অংশ নিয়েছিল। সমঝোতা অথবা একদলীয় কোনো সরকারে আমি কখনোই অংশ নিইনি। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করে প্রতিটি সংসদেই আমি প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। আমি আমার বিজয় ভাগ করে নিয়েছিলাম প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সমালোচকদের সঙ্গে। সংসদের তৈরি আইনের অধীনে আমাকে এখানে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছায় সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং সহযোগী বাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য এ আইন করা হয়েছিল। প্রথম যে বিল সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে ‘ব্যক্তি’ কথাটি যুক্ত ছিল। কিন্তু পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় তা বিল থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে চলতি সংসদের দ্বারা সংশোধিত আইনে ‘ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিবর্গ’ কথা যুক্ত হয়। এর মাধ্যমে ১৬ কোটি মানুষকে এ আইনে বিচারের যোগ্য করা হয়েছে।

 

আইন তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংসদ সার্বভৌম। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি হচ্ছে নারীকে পুরুষ অথবা পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া সংসদ সব কাজই করতে পারে। নবম সংসদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাকে চাপিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীতে ‘ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিবর্গ’ শব্দ আইনে যুক্ত করা হয়। ২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে এ আইনে আমাকে আটক রাখা হয়েছে। অথচ কোনো আটকাদেশ আমি এখনো পাইনি। এ সময়ে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রেসিডেন্ট আমাকে সমন পাঠিয়েছেন। সংসদে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আমি এ ট্রাইব্যুনালে আবেদন দায়ের করেছি। অথচ ট্রাইব্যুনাল তার বিচারিক ইচ্ছা অনুযায়ী আমার আবেদনগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জবানবন্দির এ পর্যায়ে আবারও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। প্রসিকিউকর তুরিন আফরোজ বলেন, এরই মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১০ সেশন জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি যেসব কথা বলছেন তা এ মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের আইনের মধ্যে থেকে এগোতে হবে। জবাবে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, আপনারা ১০ সেশনের হিসাব করছেন। আর আমি হিসাব করছি আমার জীবনের। আমাকে আমার কথা বলতে দিতে হবে। ব্রিটিশ আমলে মাওলানা মোহাম্মদ আলী দুই মাস ২৪ দিন নিজের পক্ষে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে আমাকে প্রতিদিন টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখানো হচ্ছে। শাহবাগ চত্বর ডাক দিল আর আপনারা আইন সংশোধন করে ফেললেন? এখন তো দেখছেন আপিল বিভাগ সাতজন এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছে। প্রসিকিউশন যেভাবে ভাবছে, কাল সকালেই আমার ফাঁসি হয়ে যাবে- সবকিছু এত দ্রুত হবে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, এ মামলায় প্রসিকিউশনের আনা হাজারো মিথ্যার মধ্যে একটাই সত্য আমি মরহুম এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে। তিনি বলেন, ফর্মাল চার্জে প্রসিকিউশন আমার পিতাকে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাকে বর্ণনা করা হয়েছে হিন্দুবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে। তার অর্জনকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সে সময়ে তিনি থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে। সে সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শিষ্য হিসেবে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভারত ত্যাগ না করা পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নেতাজির দেশত্যাগের পর ফজলুল কাদের চৌধুরী ছয় মাসের জন্য আল্লামা মাশরিকির দলে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সমাবেশে সভাপতিত্ব করা নিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী সবচেয়ে গর্বিত ছিলেন। প্রসিকিউশন ঐ ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করেছে যে, ১৯৪০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, যখন আমার পিতা চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, কলকাতার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে আমার পিতার রাজনৈতিক অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের আত্মজীবনীর বহুস্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে কথা বলেছেন। এ মামলা চলার সময়েই যে আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে।

 

স্যামুয়েল জনসনকে স্মরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, সত্য এমন এক গাভি, যা প্রসিকিউশনকে দুধ দেয়নি যে কারণে তারা ষাঁড়ের কাছে গেছে দুধের জন্য। আমার পিতা এবং আমাকে নিয়ে ফর্মাল চার্জে যে অকল্পনীয় কল্পকাহিনি তৈরি করা হয়েছে যা কল্পকাহিনির লেখকদের কল্পনাকে হার মানায় তার জবাব দেওয়ার মধ্যেই আমি আমার জবানবন্দি সীমাবদ্ধ রাখব। দর্জিদের মতো নিজের ইচ্ছামত ইতিহাস তৈরির প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে, তবে সুখের বিষয় হলো ইতিহাস তা অনুমোদন করে না। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম। সেসময় বিমানে আমার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিকী। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইয়ারমেট ছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাতও ওই বিমানে ছিলেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী ছিলেন। এ মামলার ফর্মাল চার্জে আমাকে মনোবিকারগ্রস্ত খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়নি। মানসিক প্রতিবন্ধীর অভিযোগও তারা আমার বিরুদ্ধে আনেনি।

 

আমি আমার মরহুম পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর রাজনীতির অনুসারী ছিলাম, এ সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি হিসেবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালে বেঙ্গল অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে আমার পিতাকে মনোনয়ন দিতে মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়। মুসলিম লীগের অর্থের যোগানদাতাদের একজন খান বাহাদুরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে ফরমান উল্লাহ খান, মাজহার কুদ্দুস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কলকাতায় মুসলিম লীগ অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ফজলুল কাদের চৌধুরী একটি বিবৃতি দিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। যে নির্বাচনে আমার পিতা পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের সমঝোতা প্রচেষ্টা চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং আমার পিতা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ববর্তী সময়ে তার নিজের এবং তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ভূমিকার বিশদ বর্ণনা দেন সালাউদ্দিন চৌধুরী। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে সময় আমার ধানমন্ডির বাসায় নিয়মিত আসতেন শেখ কামাল, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সিরাজুল আলম খান, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, সালমান এফ রহমান, শাহজান সিরাজসহ আরো অনেকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসাদকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার ১০ ফুট দূরত্বের মধ্যেই ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশেও অংশ নিয়েছিলাম। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে দাবি করা হয়ে থাকে। যদি তা-ই হয়, তবে আমি দাবি করতে পারি, আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থক ছিলাম।

 

১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকায় বাস করতাম। যেহেতু ঢাকায় আমাদের কোনো ড্রাইভার ছিল না, সে কারণে আমরা পিতার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমিই গাড়ি ড্রাইভ করতাম। আমার ধানমন্ডির বাড়িটি আমার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের আড্ডাখানা ছিল। আমার জানামতে, আমিই একমাত্র ছাত্র ছিলাম যে ধানমন্ডিতে একাকী একটি বাড়িতে বাস করতাম এবং আমার একটি গাড়ি ছিল। আমার পিতা চট্টগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। এমএলএ, এমএনএ, মন্ত্রিসভার সদস্য, স্পিকার এবং ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট থাকার সময় আমার পিতা চট্টগ্রামের জন্য যে অবদান রেখেছিলেন তার স্বাক্ষর আজও বহন করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি প্রভৃতি। ১৯৬০ সালে যখন আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম তখন থেকে আমি নিজস্ব পদ্ধতির জীবন যাপন করতাম, যা আমার পুরো শিক্ষাজীবনেই বহাল ছিল। যার মধ্যে সাদিক পাবলিক স্কুল, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের সময় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৬৫ সালের শেষ এবং ’৬৬ সালের শুরুর চার মাস সময়, যখন আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম সে সময় ছাড়া ’৬৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমি কখনোই চট্টগ্রামে আমার পারিবারিক বাসভবন গুডস হিলে বাস করিনি। চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার সামাজিক যোগাযোগের পুরোটাই ১৯৭৪ সালের পরের। ১৯৭৯ সালের পূর্বে চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায়ও আমার নাম ছিল না। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে আমার পিতা যখন মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার হন, তখন থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি গণপরিষদের একজন স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, যে আন্দোলনের ফলে আইয়ুব শাসনের সমাপ্তি হয়। তখন সাধারণভাবেই তার যোগাযোগ ছিল মুসলিম লীগার নন, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, এয়ার ভাইস মার্শাল আসগার খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, নুরুল আমীন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

 

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তখন আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। যদিও আমি নিজে কখনো কোনো ছাত্রসংগঠনের সদস্য ছিলাম না। আমার বন্ধুদের সঙ্গে ’৬৯ সালে আমি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। সে আন্দোলনের একটি ধানমন্ডি অধ্যায়ও ছিল। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা প্রায়শই আমার ধানমন্ডির বাসায় মিলিত হতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ধানমন্ডিতে থাকতেন এবং যারা ধানমন্ডির বাইরে থাকতেন, তারা আমার বাসায় আসতেন। তাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল তারা হলেন- তাওহিদ সামাদ, সালমান এফ রহমান, শেখ কামাল, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নিজাম আহমেদ, খায়রুল বাশার, ইরফান খান, ইমরান আহমেদ, কাজী আনোয়ার, আবদুস সামাদ, কাইয়ুম রেজা চৌধুরীসহ আরো অনেকে। সিনিয়রদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তার সমসাময়িক যেমন- আবদুর রউফ, তোফায়েল আহমেদ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল আলম খান, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজদের আমন্ত্রণ জানাতেন। আন্দোলনকে বেগবান করতে তারা আমার বাড়িতে মিলিত হতেন। সিনিয়রদের এসব মিটিংয়ে আতিথেয়তা দেওয়াই ছিল আমার কাজ। এসব নেতার অনেকে আমার পিতার সঙ্গেও প্রায়শই দেখা করতেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের সঙ্গে আমিও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশে অংশ নিয়েছিলাম।

 

সেখানে ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করেছিলেন। এটা দাবি করা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা। ঐ ঐতিহাসিক সমাবেশে আমার উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে পারেন, এমন বহুসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, মনিরুল হক চৌধুরী, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, সালমান এফ রহমান, খায়রুল বাশার, নিজাম আহমেদ, কাইয়ুম রেজা চৌধুরী, ড. বেলাল বাকী, তাওহিদ সামাদসহ আরো অনেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর একাধিক বৈঠক হয়। ঐসব বৈঠকের খবর সে সময়কার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময় বাংলাদেশে ছিলেন না বলে দাবি করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম। প্রথম তিন সপ্তাহ ছিলাম করাচিতে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লাহোরে। যেখানে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করি। সেখানে একই সঙ্গে পড়তেন শামীম হাসনাইন (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি)। অক্টোবরের ১০ তারিখে লাহোরে শেষ বারের মতো আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। অক্টোবরের ১২ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশে লাহোর ত্যাগ করি। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন এবং নির্বিচার গণহত্যার পর ঢাকা পরিণত হয় এক আতঙ্কের নগরীতে। আমি এবং আমার বন্ধুরাও এর বাইরে ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সব সদস্যও ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। ৭ কোটি নিরস্ত্র বেসামরিক জনগোষ্ঠীর জীবন পরিণত হয়েছিল পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর করুণার বিষয়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তাদের নিজেদের এবং তাদের আপনজনদের জীবন রক্ষার এবং টিকে থাকার পথ খুঁজেছিল। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ বিকেলে আমি করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলাম। আমাকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে দিয়ে এসেছিলেন আমার কাজিন কাইয়ুম রেজা চৌধুরী। পিআইএলের ম্যানেজার হামিদ জংয়ের সহযোগিতায় আমি ফ্লাইটে একটি সিটের ব্যবস্থা করেছিলাম। করাচি বিমানবন্দরে আমাকে নিতে এসেছিলেন আমার স্কুলজীবনের বন্ধু মুনীব আর্জুমান্দ এবং মাহমুদ হারুনের ব্যক্তিগত সহকারী। করাচির ভিক্টোরিয়া রোডে হারুনদের পারিবারিক বাসস্থানে আমি অবস্থান করেছিলাম। হারুনরা তিন ভাই ছিলেন। তারা হলেন- ইউসুফ এ হারুন, মাহমুদ এ হারুন এবং সাইয়েদ এ হারুন। তাদের পিতার নাম স্যার আব্দুল্লাহ হারুন। যিনি ব্রিটিশ শাসনামলে আমার পিতার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হারুন ভাইয়েরা ৫০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি তাদের মালিকানাধীন আলট্রা ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা ছিলেন। করাচিতে আমি মাহমুদ এ হারুন, তার স্ত্রী এবং তাদের দুই কন্যার অতিথি ছিলাম। আমি করাচিতে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেছিলাম। সে সময় ইউসুফ এ হারুনের সঙ্গেও আমার কয়েক দফায় দেখা হয়েছে। তখন তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ডন গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের মালিক হারুন ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের পুরোটা সময়ই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর হিথরো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু প্রথম যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি হলেন মাহমুদ এ হারুন। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ইউসুফ এ হারুন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, সাদিক স্কুলে আমার ক্লাসমেট ও রুমমেট ছিলেন মোহাম্মদ মিয়া সুম্র। পরে তিনি ২০০৮ সালে পাকিস্তানে কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সুম্র ও মুনীর আর্জুমান্দের সঙ্গে করাচি অবস্থানকালে আমার সামাজিক যোগাযোগ ছিল। তারা আমার করাচি অবস্থানের ব্যাপারে লিখিত অ্যাফিডেভিট দিয়ে আমাকে জানিয়েছেন। এ ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষী দিতেও আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি। করাচিতে অবস্থানকালে ঢাকার বন্ধুদের মধ্যে সালমান এফ রহমান, নিজাম আহমেদ, কাউয়ুম রেজা চৌধুরী, ওসমান সিদ্দিকী, রেজাউর রহমানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার বন্ধু ওসমান সিদ্দিকী, যা আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছিল, তার পিতা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে আমি লাহোরে চলে যাই। আমি সেখানে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে ভর্তি হই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ফাইনাল ইয়ারে ভর্তি হই। সেখানে আমি দেখা পাই আমার বন্ধু শামীম হাসনাইনের। তাকে ১৯৬৬ সাল থেকে আমি চিনতাম। নটর ডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও আমরা বন্ধু ছিলাম। তিনি বলেন, জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসের পুরোটাই আমি লাহোরে ছিলাম। এ সময় আমি ও শামীম হাসনাইন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে দীর্ঘ সময় কাটাই। আগস্টে আমার ফাইনাল পরীক্ষা হয়।

 

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীতে আমার উপস্থিতির মিথ্যা গুজবের জন্মদাতাকে চিহ্নিত করতে এ ট্রাইব্যুনাল আমাকে সুযোগ দিয়েছে। প্রসিকিউশনের একজন সাক্ষী ওই দিন আমার কুণ্ডেশ্বরীতে উপস্থিত থাকার কথা বলেছেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন তিনি তা শুনেছেন ভারত থেকে ফিরে আসার পর। এ দাবি মিথ্যায় প্রতিপন্ন হয় এই কারণে যে, নূতন চন্দ্র সিংহর ছেলে সত্য রঞ্জন সিংহ ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আমার মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রস্তাবক ছিলেন।

 

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল আমি বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে ছিলাম। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ কল্পকাহিনি, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যা তৈরি করেছে। রাউজানে তিনটি নির্বাচনে আমি পরীক্ষা দিয়েছি। প্রতিবারই আমি আমার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছি। এ অভিযোগের প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেননি যে তিনি আমাকে অতীতে দেখেছেন। রাজনৈতিক কারণে আমাকে এ বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহই নেই যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ব্যাপকমাত্রার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ ভূমির এক সন্তান হিসেবে এবং যেহেতু আমি ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তু নই, তাই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত সীমানায় সৃষ্ট বাংলাদেশের প্রতি আমার প্রেম এবং আনুগত্য শর্তহীন। অর্থনৈতিক এবং বস্তুগত সুবিধা দিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। আমি এটা বিশ্বাস করি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথের কারণে আমরা ৩০ লাখ শহীদের নাম গোপন রেখেছি। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের নাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফটকে টানানো আছে। এটা দুঃখজনক যে ৪২ বছরে আমরা ৩০ লাখ শহীদের নাম চিহ্নিত করে তাদের স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তবে এটা সুখের বিষয় যে আমার বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জে কিছু নতুন শহীদের নাম উন্মোচিত হয়েছে, ৪২ বছরে যাদের কথা বলা হয়নি। এদের বেশিরভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং শত্রু সম্পত্তি অধ্যাদেশ জারির পর বহু হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নূতন চন্দ্র সিংহ ছাড়া চার্জে উল্লিখিত মৃত ব্যক্তিদের কারো নামই ’৭০ সালের ভোটার তালিকা অথবা কোনো ভূমি রেকর্ডে ছিল না। ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি এ কথা এ কারণে বলছি নিহত হয়েছেন বলে এমন অনেকের কথা বলা হয়েছে, যারা ’৭১ সালে বাংলাদেশেই ছিলেন না। তিনি বলেন, ঊনসত্তরপাড়ার ঘটনা নিয়ে ১৯৭২ সালে মামলা হয়েছিল। যে মামলায় আমাকে আসামি করা হয়নি, এটা স্বীকার করে যে, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। মধ্যগরিয়া, বণিকপাড়া এবং সুলতানপুরের ঘটনায় কোনো থানায় কোনো মামলা হয়নি, আবারও এটা স্বীকার করে যে, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়নের স্পনসর হচ্ছেন ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া কিছু হতাশ সমাজতন্ত্র প্রেমিক। তারা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষের শক্তিতে বিভক্ত করতে চান। এ অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই মুসলিম উম্মাহর নেতাদের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ অপচেষ্টার শিকার হিসেবে আমি এ ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়েছি। বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের এই বিভক্তির সময়ে আমি প্রতিনিধিত্ব করি হুমকির মুখে থাকা বিশ্বাসীদের এবং আমি নিজেও বিশ্বাসী। এজন্য আমি অবিশ্বাসীদের টার্গেট হয়েছি, যারা প্রথাগতভাবেই আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বলেন, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আবারও বলছি ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১৯৭৪ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। জবানবন্দি শেষে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জেরায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি এত দিন যা বলেছেন তা জেনেবুঝে বলেছেন কি না? জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আই অ্যাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অব বাংলাদেশ। যখন যা বলি জেনে-বুঝে এবং অর্থপূর্ণতাসহ বলি।
আজ আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় অবশেষে ফাঁসির কাষ্ঠেই ঝুলতে যাচ্ছেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত এ বিএনপির নেতা।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই/মেহেদী/সুমন মুস্তাফিজ/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়