ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শ্রমিক লীগে অনৈক‌্য, ভেঙে দেয়া হতে পারে কমিটি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ০১:২৬, ২৭ জানুয়ারি ২০২২
শ্রমিক লীগে অনৈক‌্য, ভেঙে দেয়া হতে পারে কমিটি

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ‌্যে অনৈক‌্য, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, অভ‌্যন্তরীণ কোন্দল আর ঐক‌্যের বদলে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় থাকা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন শ্রমিক লীগ বহিস্কার-পাল্টা বহিস্কারে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

নতুন কমিটি গঠনের একবছরে সংগঠন গোছানো দূরের কথা পুরো কমিটি একজায়গায় একবারের জন‌্যও বসতে পারেনি। দৃশ‌্যত কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই সংগঠনে। শ্রমিক লীগের এসব কর্মকাণ্ডে বিরক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পরিস্থিতির উত্তরণ না হলে ভেঙে দেয়া হতে পারে কমিটি।

২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনে ফজলুল হককে সভাপতি এবং কেএম আযম খসরুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সম্মেলনের প্রায় ১১ মাস পরে ১১ অক্টোবর শ্রমিক  লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন শ্রমিক লীগের চূড়ান্ত কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়। তবে জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক মন্টু মারা গেলে সভাপতির পদটি শূন্য হওয়ায় জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি মো. নূর কুতুব আলম মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটি ঘোষণার পর থেকেই সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতার মাঝে অনৈক‌্যের বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করে। প্রয়াত ফজলুল হক মন্টু জীবিত থাকা অবস্থায় সাধারণ সম্পাদক আজম খসরুর সঙ্গে মনস্তাত্বিক দূরত্ব ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া নূর কুতুব আলমের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়। মূলত শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান এবং আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজের সঙ্গে মন্টু এবং নূর কুতুবের ‘অতি সম্পর্ক’ ফাটল ধরিয়েছে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতার মাঝে। শ্রমিক লীগে সংগঠনের বাইরের প্রভাবশালী বলয়ের হস্তক্ষেপ থাকায় দিন দিন বিভেদ আরও বেড়েছে। পরিস্থিতি এতোটাই নিয়ন্ত্রনহীণ হয়ে পড়ে যে, দলীয় কর্মসূচিগুলোও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পৃথকভাবে তাদের নেতৃত্বে পালন করেছেন। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক একে অন‌্যের ছায়াও দেখেন না। আর সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাও দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। যে কারণে ব‌্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সংগঠন।

শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিভক্তি সর্বশেষ প্রকাশ‌্যে আসে ২২ জানুয়ারি। সেদিন শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাদের একটি অংশ বৈঠক করেন। সেখানে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন না। তাকে জানানোও হয়নি। বৈঠকে সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে এই দায়িত্ব দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই খবর সংগঠনের বিভিন্ন নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে পোস্টও দেন। তবে ওই বৈঠকে সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নান।

তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে বহিস্কার করিনি, সেই সাংগঠনিক ক্ষমতাও আমার নেই। তাছাড়া এটা করতে গেলে দুই-তৃতীয়াংশের ভোট লাগে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, শোকজের পর বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।’

সাধারণ সম্পাদককে না জানিয়ে বৈঠক করার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রা্প্ত সভাপতি নূর কুতুব বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক কেন আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করেন আমি নিজেও জানি না। তাকে ডাকলে তিনি আসেন না। আমি মিটিং দিতে বললেও তিনি দেন না। এসব ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। তিনি সবসময় সংগঠনে একক নেতৃত্ব চান, প্রভাব চান। তার কাছ থেকে সংগঠনের কোনো সহযোগিতা পাইনি। কিন্তু সংগঠন তো এগিয়ে নিতে হবে।’

‘সামনে নির্বাচন। সেখানে শ্রমিক লীগের ভূমিকা রাখতে হবে। এজন‌্য তৃণমূল গোছাতে হবে। যেখানে কাউন্সিল দরকার সেখানে করতে হবে। এভাবে অসহযোগিতা করলে তো হবে না। এজন‌্য আমি চিন্তা করেছি সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। সে আসলে আসবে, না আসলে না আসবে। এজন‌্য তাকে ছাড়াই মিটিং করেছি।’

এদিকে ২২ জানুয়ারি না জানিয়ে বৈঠক করায় এবং তাকে সরিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শুনে শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক আযম খসরু শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির চারজনকে বহিস্কার করেন। বুধবার গণমমাধ‌্যমে এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠান। এতে বলা হয়, গঠনতন্ত্র ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাদের বহিস্কার করা হয়েছে। বহিস্কার করা অপর ৩ জন হলেন— সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খান সিরাজুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বি এম জাফর এবং দপ্তর সম্পাদক ফজলুল হক।

সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে বহিস্কার করতে পারেন কি না জানতে চাইলে আযম খসরু রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কার্যনির্বাহীর প্রধান হিসেবে ১৫ (ঘ) ধারা অনুযায়ী তাদের বহিস্কার করেছি।’

ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করলে, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে ব‌্যবস্থা না নেয়া ছাড়া তো আর কিছু করার থাকে না।’

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সংগঠনের জন‌্য কাজ করেন না দাবি করে আযম খসরু বলেন, ‘নূর কুতুব সিন্ডিকেট করেন। তিনি সেই সিন্ডিকেটের বাইরে আর কাউকে চেনেন না। আমি তার বাসায় গিয়ে হাত ধরে বলেছি আসেন সংগঠনের স্বার্থে কাজ করি। এরপরও তিনি আমার সঙ্গে মিলে কাজ করেন নাই। উল্টো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যোগাযোগ করেন। মনে হয় সংগঠন তার একক ইশারায় চলবে। তিনি সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেন।’

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরেরও বেশি সময়ে সংগঠন কোনো মিটিং আয়োজন করতে পারেনি এই কমিটি। পুরো কমিটি একসঙ্গে কখনো বৈঠকও করতে পারেনি। উপরন্তু দলীয় ও রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিও পৃথকভাবে আয়োজন করেছে। এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও ফুল দিয়েছে আলাদা আলাদা। সংগঠনের দীর্ঘদিনের এই বিভেদ, দ্বন্দ্ব এবং নিস্ক্রিয়তা নিয়ে বিরক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন সুক্ষ্মভাবে। পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে সংগঠনের স্বার্থে কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনও হতে পারে।

ঢাকা/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়