ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সম্ভাবনার বাংলাদেশ

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:৫৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২০
সম্ভাবনার বাংলাদেশ

সামনেই বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। গত পাঁচ দশকে নানা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ মহামারির কালে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির ৬৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে নবম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও বৈশ্বিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট।  প্রতিনিয়ত হচ্ছে উন্নয়ন। আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এ সম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিশালী দেশ। এসব সম্ভাবনা আর এগিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য এই প্রতিবেদন। 

গরু পালনে বিশ্বে ১২তম বাংলাদেশ

বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী এ বছর বাংলাদেশে পালনকৃত গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি।  শুধু তা-ই নয়, গবাদিপশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ১২তম স্থানে রয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে ২০২০ সালে প্রায় ১৪৬ কোটি ৮০ লাখ গরু পালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৭ লাখ পালনের মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত ১৮ কোটি ৯০ লাখ, তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীন ১১ কোটি ৩৫ লাখ, চতুর্থ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ৮ কোটি ৯২ লাখ এবং পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় ৫ কোটি ৪০ লাখ গুরু পালন হয়েছে এ বছর।

বর্তমানে পালন হওয়া গরুর সংখ্যায় শীর্ষ ১৫-তে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনা ৫ কোটি ১০ লাখ, সুদান ৪ কোটি ১৯ লাখ, পাকিস্তান ৩ কোটি ৮২ লাখ, মেক্সিকো ৩ কোটি ২৪ লাখ, অস্ট্রেলিয়া ২ কোটি ৯২ লাখ, তানজানিয়া ২ কোটি ৪৫ লাখ, বাংলাদেশ ২ কোটি ৪০ লাখ, কলম্বিয়া ২ কোটি ৩১ লাখ, নাইজেরিয়া ২ কোটি ও রাশিয়া ১ কোটি ৯৯ লাখ গরু পালন হচ্ছে চলতি বছর।

মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদন

মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদন করছেন জামালউদ্দিন। দিনাজপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বেলবাড়ি বাজারসংলগ্ন বাড়ির পাশেই নার্সারি গড়ে তিনি চারা উৎপাদন করছেন। চারা উৎপাদনে মাটির বদলে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিকের ট্রে ও প্লাস্টিকের ছোট ছোট গ্লাসে কচুরিপানা ও কোকোডাস্টের (নারিকেলের ছোবড়া) সংমিশ্রণ।  পলি হাউসে প্লাস্টিক ট্রেতে বীজ বপন করা হয়। মাটির বদলে নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি কোকোপিট প্রক্রিয়াজাত ও জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয়। চারার সুরক্ষার জন্য ওপরে শেডনেট জুড়ে দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর পলিশেডের নিচে ছোট–বড় ৫৫টি বেড। প্লাস্টিকের ট্রে ও গ্লাসে ২ পাতা–৪ পাতাবিশিষ্ট টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপির চারাসহ বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করছেন জামালউদ্দিন।

জামালউদ্দিন জানান, বর্তমানে নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১০ লাখ চারা রয়েছে।  প্রতিটির চারার দাম দেড় টাকা থেকে ২৫ টাকা। বেলবাড়ি বাজারে চায়ের দোকানে পরিচয় হয় গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মাঠকর্মী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। সংস্থাটি কৃষকদের মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদনের কাজ করছিল। জামালউদ্দিন বলেন, প্রথম থেকেই তাদের পরামর্শ গুরুত্ব দিয়ে শুনেছি। তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিই। সেখান থেকেই জানতে পারি, প্রচলিত পদ্ধতিতে একই জমিতে বারবার চারা উৎপাদন করায় জমিগুলো রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করলে অল্প খরচে সুস্থ–সবল চারা উৎপাদন করা যায়। প্রশিক্ষণের পর চারা তৈরি জন্য ট্রে, প্লাস্টিকের গ্লাস, নেট, নারিকেলের ছোবলাসহ যাবতীয় কাঁচামাল কিনে চারা উৎপাদন শুরু করি। প্রাথমিকভাবে খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা।

জামালউদ্দিন জানান, বাড়ির ভেতরে ৫০ বর্গফুটের চৌবাচ্চা। সেখানে নারিকেলের ছোবড়া, গোবর, কচুরিপানাসহ প্রয়োজনীয় কিছু রাসায়নিক সার দিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখেন। আস্তে আস্তে সেগুলো পচে যায়। পরে সেগুলো গুঁড়া করে পরিমাণমতো ট্রে ও গ্লাসে দিয়ে বীজ বপন করা হয়। তিন দিনের মধ্যে বীজ থেকে অঙ্কুর বের হয় এবং ১৫ দিন পরে চারা বিক্রির উপযোগী হয়। দৈনিক ৮-১০ হাজার চারা বিক্রি করেন। গড়ে প্রতিদিন ১২-১৪ হাজার টাকার চারা বিক্রি হয়। খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি লাভ থাকে।

কৃষি ও পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা

রাজধানী ঢাকার কাছে দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা। কৃষি ও প্রবাসী অধ্যুষিত উপজেলা দুটিতে রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপনা। ঢাকার নিকটবর্তী পদ্মা ও আড়িয়াল বিলসংলগ্ন দোহার ও নবাবগঞ্জ জনপদ দুটি সরকারি সহায়তায় গড়ে উঠতে পারে কৃষি ও পর্যটন শিল্প এলাকা হিসেবে। এ এলাকার কৃষকরা সারা বছর উৎপাদন করছেন নানা জাতের ধান, পাট, শাকসবজি, আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, বাদাম, সরিষা, তিল। প্রতি বছর দোহার ও নবাবগঞ্জে পিচ ফলেরও বাম্পার ফলন হচ্ছে। বাঙ্গি, পেঁপে, কলা, কুল, বেল, লেবু, লিচু, আতাফল, আমড়া, জাম, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি অর্থকরী ফসলও উৎপাদন হচ্ছে। এসব ফসল ও ফল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের চাহিদা মেটাচ্ছে।
বাবগঞ্জের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে স্থানীয় শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা স্বপ্ন দেখছেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে কলাকোপায় আধুনিক শিশুতোষ পার্ক গড়ে উঠেছে।  কৃষি ও প্রবাসী অধ্যুষিত নবাবগঞ্জ ও দোহারের অর্থনীতিকে চাঙা  করতে পারে কৃষি ও পর্যটন শিল্প, এমনটা ভেবে অনেকে এগিয়ে আসছেন।  

বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ কিনতে চায় চার দেশ

বাংলাদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব, ভারত, নেপাল ও ভুটান। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ভুটান ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য প্রস্তাব দিয়েছে আর অনানুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব ও নেপাল। বিষয়টি জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।  মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ কথা জানান তিনি। 

মন্ত্রী বলেন, ভুটানে রপ্তানির জন্য আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।  যা নেপালকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।  দেশে দ্রুত বর্ধনশীল ব্যান্ডউইথের চাহিদা মেটাতে একনেক সভায় ৬৯৩.২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় সৌদি আরব, ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যান্ডউইথ কেনার বিষয়টি ওঠে আসে। 

টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর বেশিরভাই পার্বত্য অঞ্চল এবং দুর্বল নেটওয়ার্ক সম্পন্ন হওয়ায় সেখানে মুম্বাই বা চেন্নাই থেকে ব্যান্ডউইথ পরিবহন খুবই ব্যয়বহুল। সেখানে বাংলাদেশ ত্রিপুরা রাজ্যে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করছে। 

কাপাসিয়ায় চা চাষের নতুন সম্ভাবনা

চা চাষ মানেই পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ি এলাকা সিলেট কিংবা পার্বত্যাঞ্চলকেই চা চাষের উপযোগি হিসেবে ধরা হয়। আর এসব ছাপিয়ে এখন নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভাওয়াল পরগণার গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। এ শুধু স্বপ্নই নয়, বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।  আর এই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন কাপাসিয়ার লুৎফর রহমান নামের একজন শিক্ষক।

কাঁঠালের রাজধানীখ্যাত এই এলাকায় ফলে না এমন উদ্ভিদের দেখা মেলা ভার হলেও, দীর্ঘদিন ধরেই চাষ না হওয়া ফসলের তালিকায় ছিল চা-চাষ। এবার সেই অসাধ্য কাজটি সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন অধ্যাপক লুৎফর রহমান।  কাপাসিয়ার নিজের পৈত্রিক বাড়ির অব্যবহৃত ৩ হেক্টর জমিতে তিনি চা চাষ শুরু করেছেন। তার আশা, গাজীপুরে চা চাষ করে সম্ভাবনার দাড় উন্মোচন করবেন। পেশার তাগিদে চায়ের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের চেনা-জানার সূত্র ধরেই চা চাষের পরিকল্পনা করনে তিনি। আর বেছে নেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার চিনাডুলি গ্রামের পৈত্রিক সম্পত্তির পরিত্যক্ত জায়গাগুলো।

লুৎফর রহমান বলেন, হাজারো উদ্ভিদের মধ্যে একমাত্র চা গাছ ব্যতিক্রম। গাজীপুর যেহেতু বন্যামুক্ত এলাকা, উঁচু চালা জমি সমৃদ্ধ, সেজন্য বাড়ির আশপাশের প্রায় ৩ হেক্টর জমি বেছে নিয়ে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ২০১৯ সালে সিলেট থেকে ১০ হাজার চারা এনে রোপন করি। অল্পদিনেই এই চা গাছগুলো বেড়ে উঠে।  সঙ্গে সঙ্গে এর সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় এ বছর বাড়ির পাশের শীতলক্ষ্যা নদীর চরে আরও বেশ কিছু জমিতে চা গাছ রোপন করেছি। আশা করছি, কয়েক বছরেই এই বাগান থেকে উৎপাদনে যেতে পারবো।

আগে আমাদের দেশে সিটিসি (অর্থোডক্স) জাতীয় চা চাষ হতো।  দিন দিন এ জাতীয় চা চাষ কমে গেছে। বর্তমানে এ জাতীয় চা শুধু ভারতের দার্জিলিংয়ে উৎপাদিত হয়।  অর্থোডক্স অর্থাৎ প্রাচীন চা গাজীপুরে উৎপাদন করতে চাই। সে লক্ষ্যেই পথচলা। বর্তমানে সারা দেশেই চা চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে। গাজীপুরের পাশেই ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় চা চাষ হচ্ছে। সে হিসেবে গাজীপুরে চা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। 

তথ্যঋণ:
প্রথম আলো (৩০ নভেম্বর ২০২০), বণিক বার্তা (নভেম্বর ২৩ ও ডিসেম্বর ৪, ২০২০), রাইজিংবিডি (১৮ নভেম্বর ২০২০), যায়যায়দিন (২ ডিসেম্বর, ২০২০), ঢাকা ট্রিবিউন (২ ডিসেম্বর, ২০২০)।

ঢাকা/এসবি/টিই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়