ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মাশরুম চাষে সাড়া ফেলেছেন সাইফুল 

আবু কাওছার আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ১৮ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৩:৩০, ১৮ এপ্রিল ২০২১
মাশরুম চাষে সাড়া ফেলেছেন সাইফুল 

লক্ষ্য ঠিক করে সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে যে কোনো কাজে সফল হওয়া সম্ভব। এমনটাই প্রমাণ করেছেন টাঙ্গাইলের বাসাইল সদর ইউনিয়নের রাশড়া গ্রামের বাচ্চু মিয়ার ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম (৩০)। করোনাকালে সৌদি আরব থেকে ছুটিতে এসে আবার কর্মস্থলে ফেরত না যেতে পেরে প্রবাসী সাইফুল তার বেকার জীবন ঘুচাতে শুরু করেন মাশরুমের চাষ।

সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০০ সালে ব্র্যাক স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে নানার বাড়ি পার্শ্ববর্তী উপজেলার মির্জাপুর বাঁশতৈল উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হন। ২০০৪ সালে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর লেখাপড়ায় আর তার মন বসে না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ৪ বছর অপচয় করেন। নিজ ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে ২০০৮ সালে তিনি আরব আমিরাতে চলে যান। সেখানে দুই বছর কাজ করে ২০১০ সালে ছুটিতে বাড়ি এসে বিয়ে করেন। 

বিয়ে করে আবার তিনি চলে যান। সেখানে আরও দুই বছর থেকে ২০১২ সালে বাড়ি চলে আসেন। কিছু দিন বেকার থাকার পর সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ২০১৩ সালে ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। ৮ লাখ টাকা খরচ করে ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুর যান। এক বছর থেকেই ২০১৬ সালে চলে আসেন। দুই সন্তান রেখে জীবিকার তাগিদে ২০১৮ সালে সৌদি আরব যান। দুই বছর কাজ করে ২০১৯ এর শেষের দিকে তিন মাসের ছুটিতে আসেন। ছুটি কাটিয়ে আবারও সৌদি যাওয়ার সময় দেশে পুরোদমে লকডাউনে আটকে যান তিনি। 

এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এক দিকে সংসারের খরচ, অপর দিকে বিদেশ যাওয়ার সময়ে ধার-দেনা, এসব মিলিয়ে অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে। একটা কর্মসংস্থানের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। অবশেষে কৃষির উপরই কিছু করবেন বলে স্থির করেন সাইফুল। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে সাভার জাতীয় মাশরুম ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করেন এবং করোনাকালীন সময়ে মোবাইলে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে জুমের মাধ্যমে ১০ দিনব্যাপী একটি অনলাইন প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আরও ৭ দিন সাভারে হাতে-কলমে বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা শেষে সেখান থেকে বীজ নিয়ে আসেন।

মাশরুমের তৈরি বিভিন্ন খাবারের সমন্বয়ে একটি ফাস্টফুডের দোকানও দেন তিনি। মাশরুমের চাষ করে এখন প্রতিদিন প্রবাস জীবনের চেয়েও বেশি উপার্জন করছেন সাইফুল। পুনরায় সৌদি আরব যেতে না পেরে স্ত্রী-কন্যা এবং পরিবারের চিন্তা, যখন তার জীবনকে ক্রমাগত অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল, তখন বাসাইল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাশরুম চাষের বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেন। সেই থেকে সাইফুলের শুরু, এরপর বছর পার হয়ে গেছে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজের বসত ঘরের পাশে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০ হাত একটি ঘর নির্মাণ করেন। ১২/১৫ টাকা দরে ৩৫০টি স্পুন (কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, চুন দিয়ে তৈরি) এবং খড়ের (ধানের খড় দিয়ে তৈরি) প্যাকেটের বীজ নিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করেন তিনি। মাত্র এক মাস পর থেকেই মাশরুম সংগ্রহ শুরু হয়, যা প্রতি সপ্তাহে একবার করে পর্যায়ক্রমে আড়াই মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। 

খামারের ফ্লোরে রাখা প্রতিটি স্পুন প্যাকেট থেকে ২৫০ গ্রাম এবং ঝুলিয়ে রাখা খড়ের প্যাকেট থেকে ৫০০ গ্রাম করে মাশরুম পাওয়া যায় প্রতিবার। এভাবে ৩৫০টি বীজ থেকে প্রতিবার ৫/৬ কেজি করে মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে সাইফুলের খামারে মাশরুম সংগ্রহের মতো প্রায় ৭০০ প্যাকেট রয়েছে। 

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লক্ষ্য ঠিক করে সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে যে কোনো কাজে সফল হওয়া সম্ভব। প্রবাসের বেকারত্বের অন্ধকার জীবন থেকে মাশরুমের খামার আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছে। মাশরুমের খামার এবং মাশরুম ফাস্টফুড বিক্রি করে প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকা উপার্জন করছি। ১২/১৫ টাকার একটি খড়ের প্যাকেটের বীজ থেকে ৭৫ থেকে ৯০ দিনে তিন থেকে চার কেজি মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। বাজারে যার খুচরা মূল্য দুইশত টাকা প্রতি কেজি। বাসাইলে মাশরুমের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, সেটা আমি একা পূরণ করতে পারি না। আশা করছি দুই হাজার প্যাকেট বীজ নিয়ে চাষ করতে পারলে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে আমি খামার বৃদ্ধি করতে এবং একটি মাশরুম ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। সরকারি সহায়তা পেলে বাসাইলে একটি মাশরুম বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।’

বাসাইল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নাজনীন আক্তার বলেন, ‘মাশরুম একটি উপকারী, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। মাশরুম দিয়ে সাবান, পাউডার, স্যুপ, চপসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাবার তৈরি করা যায়। আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সাভারে প্রশিক্ষণ শেষে সাইফুল ইসলাম মাশরুম খামার করেছেন এবং দুই থেকে আড়াইমাস পর প্রতিদিন ৫/৬ কেজি মাশরুম উৎপাদন করতে পারছেন।’ 

‘যে কোনো পরামর্শে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সবসময়ই তার পাশে থাকবে। বাসাইলের বেকার যুবকদের জন্য সাইফুল অনুকরণীয়। তাকে দেখে বেকার যুবকরা মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে চাইলে তার আবেদনে সুপারিশ করে সাভারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেবে বাসাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।’

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়