ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

রাসেলের ‘পথকলি’

এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ১২ মে ২০২১   আপডেট: ১২:৪৬, ১২ মে ২০২১
রাসেলের ‘পথকলি’

আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল। প্রচার বিমুখ মানবসেবায় নিবেদিত একজন মানুষ। পেশায় একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। নরসিংদী শহরের ব্রাহ্মন্দী মহল্লায় তার বাড়ি। এ শহরেই বিগত ১০ বছর ধরে মেতে আছেন অসহায় পথশিশুদের নিয়ে।

যেখানেই তিনি দেখেন একজন অসহায় মানুষ ও পথশিশু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন, সেখানেই তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহযোগিতার হাত। তিনি স্বপ্ন দেখেন প্রতিদিন যেন ভালো একটি কাজে অংশ নিতে পারেন।

সেই মানসিকতা নিয়ে সমাজের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের সহযোগিতার হাত বাড়ায় তারই গড়া ‘আলোকিত নরসিংদী’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। আর এ সংগঠনের কাজই অসহায় পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানো।

তেমনই এক দৃষ্টান্ত উদাহরণ শহরের রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে অবহেলিত পথশিশুদের নিয়ে গড়ে তোলা পাঠশালা। এই পাঠশালার নাম রাসেল দিয়েছেন ‘পথকলি’।

‘আলোকিত নরসিংদী’ সংগঠন সূত্রে জানা যায়, রাসেল ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করনে এ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে ২০২০ সালে চালু করেন পথশিশুদের পাঠশালা ‘পথকলি’। প্রথমে ১১ জন শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। 

বর্তমানে রয়েছে ৬২ জন পথশিশু। তার মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ জন শিশু পথকলিতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এ পথশিশুদের সপ্তাহে দুদিন শুক্র ও শনিবার এবং প্রতিদিন বিকালে নরসিংদী রেলস্টেশন সনিকট বঙ্গবন্ধু উদ্যানে একটি গাছতলায় পাঠদান করছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল নিজেই।

পথকলি পাঠশালায় শুক্রবার সকাল থেকে দল বেঁধে আসতে শুরু করে শহরের পথশিশুরা। কেউ খালি গায়ে, কেউ ছেঁড়া জামা-প্যান্ট গায়ে চাপিয়ে।

নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়ে উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসেই রাসেলের দেওয়া সকালের হালকা নাশতা সেরে ফেলে আগত শিশুসহ সবাই। তারপর শুরু হয় মূল কাজ। এর মধ্যে সারিবদ্ধভাবে গোলবৃত্তাকারে বসে যান পথকলিরা। এ সময় গাছের নিচে বোর্ড আর মার্কার হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন শিক্ষক।

শিক্ষক বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে চান গল্পের ছলে ছলে। পথশিশুদের চোখে-মুখে বুনে দিতে চান স্বপ্নের বীজ। এসময় পথশিশুরাও তাদের করুণ বাস্তবতা থেকে ডুব দেয় আনন্দ আর স্বপ্নীল জীবনের ভেতর।

বেলা যখন আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসে, তখন এ পথকলিদের দুপুরের খাবারও এ উদ্যানেই ব্যবস্থা করে থাকেন রাসেল তার নিজস্ব অর্থায়নে। দুপুরের খাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় বিরতি, খেলাখুলা ও তারপর আবার পাঠকার্যক্রমে ফিরে আসে এ পথকলিরা।

এভাবে পাঠদানের ভেতর কাটিয়ে দেয় সারা বিকেল। দিনভর আনন্দ আর অর্জিত জ্ঞান নিয়ে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে এ শিশুরা ফিরে যান তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে।

পরদিন শনিবার, আবার সকাল থেকে শুরু পাঠদান, সন্ধ্যা পর্যন্ত রুটিনওয়ার্ক, শিশুদের কলরবে মুখরিত উদ্যানের পরিমন্ডল। শুক্র ও শনিবার ছাড়াও সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় বিকালবেলা চলে পাঠদান কার্যক্রম। এ পাঠকার্যক্রমের মূল অংশে থাকে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি ও ধর্ম শিক্ষার বিষয়।

রাসেলের পথকলিদের মধ্যে অনেকের পিতা-মাতা নেই। তাদের কেউ বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে পানি, বাদাম বিক্রি করে। কেউ আবার ভিক্ষাবৃত্তি করে রাতের বেলায় রেলওয়ে স্টেশনে ঘুমায়। 

আসন্ন ঈদ উপলক্ষে সোমবার (১০ মে) নরসিংদী সরকারি কলেজের তমাল তলায় শতাধিক ছিন্নমূল শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে দিয়েছেন নতুন জামা। এর আগে ৯ মে বিকালে নরসিংদীর পূর্ব ব্রাহ্মন্দী এলাকায় হতদরিদ্র ৬৫ জন পরিবারের মানুষের মাঝে উপহারসামগ্রী হিসাবে দিয়েছেন সেমাই, দুধ, চিনি, কিচমিচ, তৈল, সাবান ইত্যাদি।
ঈদ উপহারসামগ্রী পেয়ে অশ্রুসিক্ত অসহায় খালেদা আক্তার বলেন, কত দিন ধরে সেমাই খাই না। এ বছর ঈদে পরিবার নিয়ে সেমাই খেতে পারবো। প্রতি বছরই ওনি (আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল) আমাদের ঈদ উপহার দেন। আল্লাহ ওনাকে বাঁচিয়ে রাখুন।

আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল বলেন, আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে থেকে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সমাজে অসহায় মানুষের জন্য আমার মন সবসময় কাঁদে। এ মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে যখন দিনাতিপাত করছিল, বিষয়টি আমাকে ভাবায়। তাই তাদের কষ্ট দেখে প্রথমে নিজের জমানো ৬০ হাজার টাকায় তাঁদের খাদ্যসহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেই। পরে হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ শুরু করি। 

প্রথমেই শুরু করি রিকশা ও ভ্যানচালকদের সহযোগিতার মাধ্যমে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ও জনসমাগম এড়াতে স্বাস্থ্য বিধিমেনে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ৫০ জনকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করি এবং তাদের জরুরি ওষুধসহ খাদ্যসামগী ও মাস্ক প্রদান করি।

আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, আমি চাকরি পাওয়ার পর থেকে অসহায় মানুষের জন্য বেতনের কিছু টাকা আলাদা করে রাখি। প্রয়োজনে বন্ধুদের সহযোগিতা নেই। ইতোমধ্যে নরসিংদী রেলস্টেশনের ছিন্নমূল শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি দূর করতে চালু করি পাঠশালা পথকলি। আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে পথশিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়া। পাশাপাশি তারা যেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে নিজেদের দুর্বল না ভাবে। ওরা যেন সমাজের বোঝা না হয়।

‘পথকলি’ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, আমি এ পথশিশুদের জন্য স্থায়ী একটি ব্যবস্থা করতে চাই। খাওয়া-দাওয়া আর জামা কাপড়ের জন্য ওদের জীবন যাতে থেমে না থাকে, এমন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যেন আমি না থাকলেও ওদের সমস্যা না হয়।

নরসিংদী/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়