বিষমুক্ত ফল ও সবজিতে আড়াই মাসেই সাফল্য
রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম
মাস্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন ইশতিয়াক। স্বপ্ন ছিল চাকরি নয়, কৃষিতে কিছু একটা করার। বাজারের ভেজাল সবজি দেখে চিন্তাটা মাথায় আসে। সিদ্ধান্ত নেন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত সবজি ও ফল উৎপাদন করবেন তিনি।
বন্ধু কৃষিবিদ শাহদাতেরও স্বপ্ন ছিল ‘কৃষক মানেই ছেড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা রুগ্ন মানুষ’ এ ধারণা বদলে দিতে। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাড়ির পাশে নিজেদের পতিত প্রায় দেড় বিঘা এবং সামান্য কিছু জমি লিজ নিয়ে স্বপ্ন বাস্তায়নে হাত লাগান দুই বন্ধু। রমজানের চাহিদার কথা মাথায় রেখে চাষ করেন শসা, বেগুন ও হলুদ তরমুজ। পরবর্তী সময়ে লাগান অনান্য সবজিও। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফলন আসা শুরু হয়।
৭ শতাংশ জমিতে লাগানো জমিতে গত সপ্তাহ পর্যন্ত শসা বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। প্রতিদিন বেগুন বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকা। এখন জমিতে দুইজন শ্রমিক সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। এপর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন লাখ টাকার মতো। বেড়া, পানির পাম্প, মাচা, বেড তৈরিসহ প্রাথমিক কাজের জন্য খরচ বেড়েছে। আগামীতে এসব খরচ লাকবে না। বছরে বিনিয়োগের শতভাগ ফেরত আসবে আশা তার।
তরুণ কৃষক ইশতিয়াক বলেন, ‘যে জমিতে ফার্ম গড়ে তোলা হয়েছে, ফসল হতো না বলে তা বছরের পর বছর ছিল পতিত। আমরা দুই বন্ধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ শুরু করলে স্থানীরা আমাদের পাগল বলতো। বাঁকা চোখে দেখে হাসাহাসি করতো, টিপ্পনী কাটতো। এখন তারাই বিষ্ময় নিয়ে ফার্ম দেখতে আসেন। উৎসাহ দেন। নিজেরাও এভাবে ফার্ম করার আগ্রহ দেখান। শুরুতে বাবা-মাও অসুন্তষ্ট ছিলেন। বলতেন, এত লেখাপড়া করালাম কৃষি কাজ করার জন্য! ফলন আসার পর তারাও অনেক খুশি। আনন্দে পরিণত হয়েছে আমাদের পরিশ্রম।’
সবজি বাগানটি ঘুরে দেখা গেছে, শুধু শসা বা বেগুন নয়, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, করলা, চিচিংগা, ঝিংগা, ডাটাসহ সব সবজিতেই ঠাসা ইশতিয়াকদের ফার্মে মাচা। তবে সবচেয়ে তাক লাগানো সাফল্য এসেছে হলুদ তরমুজে। প্রতিটি মাচায় ঝুলছে তৃপ্তি জাতের শত শত হলুদ তরমুজ। দেখে মনে হবে হলুদের রাজ্য।
সারি সারি মাচা। কোনোটায় দুলছে হলুদ তরমুজ। কোনোটায় লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শষা, চিচিংগা, করলা, উচ্ছে, কিংবা ঝিংগা। মাচার ফাঁকে ফাঁকে থরে থরে বেগুন, ঢেঁড়স, ডাটা, পেঁপে, পুই শাকের প্লট। চোখ জুড়ানো এ দৃশ্য দেখা মিলবে গাজীপুর শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট দেওড়া এলাকার কৃষিবিদ শাহাদাত হোসেন ও ইশতিয়াক মুনীমের কৃষি খামারে।
বিষমুক্ত সবজি ও ফল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় দুই একর জমিতে ওই দুই তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেন ফার্মটি। নাম দিয়েছেন ‘বায়ো গ্রিন এগ্রো ফার্ম’। মাত্র আড়াই মাসেই পেয়েছেন তাক লাগানো সাফল্য। এতে উৎসাহিত হচ্ছেন অনেক বেকার ও সাধারণ চাষি।
অপর উদ্যোক্তা শাহাদাত বলেন, ‘তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে আধুনিক মালচিং পদ্ধতির চাষাবাদ। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য মাটি এক ধরনের বিশেষ প্লাস্টিক কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে কাগজ ফুটো করে চারা লাগানো হয়। বিশেষ এ কাগজ মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত মান ঠিক রাখে। সেচ কম লাগে। আগাছা জন্মাতে পারে না। জৈব সারের সক্ষমতা ধরে রাখে এক বছর। ফার্মে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবসার হয় না। পোকামাকড় মারতে ব্যবহার করি ফেরোমিন ফাঁদ প্রযুক্তি।’
শাহাদতের মতে, তাদের সাফল্যের পেছনে আরেকটি কারণ হলো বীজ নির্বাচন। পারপল কিং ও স্থানীয় চুমকি জাতের বেগুন, সামার শট জাতের ঝিংগা, সুপ্রিম প্লাস জাতের শসা, বারোমাসি লাউ ময়না, ডায়না ও বারী-৪ জাতের বীজ বপন করেন।
লাউয়ের বীজ মার্চের ১৫ তারিখে বপন করার পর ২৮ দিনেই ফলন আসতে শুরু করে। আর ফার্মের যে হলুদ তরমুজ নিয়ে চারদিকে এত হৈচৈ, সেটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত তৃপ্তি জাতের। মার্চের ১০ তারিখে বীজ রোপণ করার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি ফল আসতে শুরু করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কাটা হয়েছে ফল। হলুদ তরমুজের জন্য প্রতিদিনই বুকিং হচ্ছে।
তিনি জানান, তাদের সব সবজি ও ফল ফার্ম থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তারপরও কৃষিতে বড় প্রতিবন্ধকতা পণ্যের বাজার মূল্যে ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। লেখাপড়া জানা মানুষ কৃষিতে আসবে না, এ ধারণা পাল্টাতে হবে।
ভবিষতে একটি কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং স্বনির্ভর আধুনিক শিক্ষিত কৃষক সমাজ তৈরির স্বপ্ন রয়েছে এই দুই যুবকের।
গাজীপুর/মাহি
আরো পড়ুন