ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছাদবাগানে রূপকথার শান্তির পায়রা  

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৯, ১ জুন ২০২১   আপডেট: ১৭:৩৩, ১ জুন ২০২১
ছাদবাগানে রূপকথার শান্তির পায়রা  

২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা মহামারি অন্যান্য দেশের মতো আঘাত হানলো বাংলাদেশেও। শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষার্থে ১৬ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। শুরু হয় দুর্যোগে ভরা এক নতুন জীবন। শঙ্কা এবং মৃত্যু চিন্তায় মানুষ তখন পাগল প্রায়। সেই সময় সব শিশু ঘরে বন্দী হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গ্রামের শিশুরা শহরের শিশুদের চেয়ে কিছুটা হলেও উন্মুক্ত হাওয়ায় নিজেদের বেশ সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে। 

করোনা মহামারির এই সময়ে গ্রামের শিশুদের শারীরিক বা মানসিক বিকাশে গ্রামের খোলা মাঠ, পুকুর এবং গাছ-পালা ঘেরা উঠানের ইতিবাচক প্রভাব বেশিই ছিল। কিন্তু শহরের চার দেয়ালের ফ্ল্যাট বাড়ির শিশুদের না আছে গ্রামের মতো খোলা মাঠ, না আছে পুকুর, না আছে গাছে ঘেরা আাঙিনা। পার্কগুলোও ছিল বন্ধ। কোথাও যাওয়ার কোনো উপায়ও ছিল না। করোনাকালীন এই দুর্যোগে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাব শহরের শিশুদের প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে।

আজ এক কিশোরীর গল্প শোনাবো। তার নাম রূপকথা। বয়স ১২ বছর। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্য শিশুদের মতো ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ছোট্ট রূপকথাও ঘরে বন্দী হয়ে পড়ে। তখন সে পড়তো পঞ্চম শ্রেণিতে, বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। ঘরে বন্দী মানেই যে মনে বন্দী নয়, সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা ছোট্ট রূপকথা তার সৃষ্টিশীল ভাবনা আর কাজ দিয়ে করোনাকালীন দুর্যোগে গত দেড় বছরে তা ভুল প্রমাণ করলো।

শুরু হলো করোনা মহামারির এই দুর্যোগে রূপকথার জীবনকে ঘিরে সৃষ্টিশীল নতুন সব ভাবনা। শুরুতে রূপকথা আর্ট করতো এবং সবাইকে তা উপহার দিতো। কিন্তু এতে তার মনের খোরাক পূরণ হচ্ছিল না। এদিকে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধে বাসায় সব বিষয়ের শিক্ষক আসা বন্ধ। আত্মীয়-পরিজনের সাথেও দেখা করা যাচ্ছিল না। রূপকথার অস্থিরতা দেখে তার মা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সালমা আহমেদ রূপকথাকে নিয়ে ছাদে যাওয়া শুরু করলেন। সঙ্গী বাসা সহকারী শিউলি আর রূপকথার সাইকেল।

এই দুর্যোগে ছাদের মাঝেই ছোট্ট রূপকথার স্বপ্ন বুননের শুরু। রূপকথা আবিষ্কার করলো তার ছাদেও কিসের যেন অভাব। প্রায়ই ছাদ থেকে এসে তার মাকে বলতো, কবে যে স্কুলে যাব! আবারো খেলার মাঠে খেলবো! মা বুঝতে পারতেন, খালি ছাদ রূপকথাকে আকর্ষণ করছে না। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, মেয়ের মন ভালো করার জন্য এমন কী করা যায়, যেখান থেকে রূপকথা মনে স্বস্তি পাবে। একদিন গল্পের ছলে জানতে চাইলেন কীসের শূন্যতা এই ছাদে? উত্তরে রূপকথা বলেছিল, ছাদে কোনো গাছ নেই, কোনো অক্সিজেন নেই। আমার দম বন্ধ লাগে।

মেয়ের কথা শুনে মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রূপকথাকে দেখলেন। তারপর ভাবলেন, ঠিকই তো। ছাদে অক্সিজেন নেই। সেদিন মা আদর করে রূপকথার কাছে জানতে চাইলেন, তাদের ছাদে অক্সিজেন তৈরি করতে চাইলে কী করা যেতে পারে? রূপকথা চট জলদি উত্তরে বলেছিল, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। আমরা গাছ লাগালে ছাদে অক্সিজেন তৈরি হবে। এই বাড়ির সবাই ঘরে থেকেই প্রচুর অক্সিজেন পাবো। কারোই অক্সিজেনের অভাব হবে না। সেজন্য আমরা ছাদকেই বাগান বানাতে পারি।

মায়ের সঙ্গে রূপকথা, বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সে

রূপকথার ভাবনা শুনে মা বিস্মিত হন। এত ছোট্ট একজন মানুষ করোনাভাইরাসের এই দম বন্ধ অবস্থায় সবার অক্সিজেন প্রাপ্তির সমাধানে চিন্তিত! এভাবেই ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রাকৃতিক উপায়ে অক্সিজেন তৈরির ভাবনা থেকেই রূপকথার ছাদ বাগানের যাত্রা। করোনার এই বন্দী জীবনে অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি ছাদবাগান তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রূপকথা। ছোট্ট মেয়েটির স্বপ্ন সাজাতে সবসময় সহযোগী হিসাবে পাশে ছিলেন তার মা।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে মাত্র ১৫টা গাছ দিয়ে রূপকথার ছাদ বাগানের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে গাছের সংখ্যা বেড়ে ২০২১ সালের মে মাসে সেই বাগানে এখন প্রায় ৩০০টি গাছ জায়গা করে নিয়েছে। রূপকথা নিজেই গাছের পরিচর্যা করে। পানি দেওয়া, সার দেওয়াসহ সব নিজের হাতেই করে। আগাছা পরিষ্কারের কাজটি মাকে সঙ্গে নিয়ে করে। তাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে বাসা সহকারী শিউলি। স্কুলের নিয়মে অনলাইন ক্লাসও কিন্তু চলছে। পড়াশোনাতেও সমান মনোযোগী রূপকথা। ক্লাস শেষ হলেই ছাদে গিয়ে গাছের সঙ্গে সময় কাটায়।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রূপকথার গল্পে যুক্ত হলো আরেক ভাবনা। ছাদ বাগানের পাশাপাশি মাকে একদিন বললো, ছাদে একটা ছোট্ট কবুতরের ঘর বানাতে চাই। মা কারণ জানতে চাইলে রূপকথা বলেছিলো, কবুতর শান্তির প্রতীক। ছাদে ওদের ঘর করলে আমাদের বাড়ির সবাই শান্তিতে থাকবো। বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাবে। আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবো।

মায়ের কাছে রূপকথার কথাগুলো গল্পের কোনো রাজকন্যার কথার মতো মনে হচ্ছিল। করোনা থেকে মুক্তির জন্য কবুতর যে শান্তি আনতে পারে, ছোট্ট রূপকথার সেই সম্ভাবনার কথা শুনে মা সেদিন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। মনে মনে মেয়ের জন্য মায়ের সমর্থনের পাশাপাশি মানুষের জন্য যেন রূপকথা বড় হয়ে কাজ করতে পারে, সেই দোয়াও ছিল।

করোনার এই দুর্যোগে কবুতরের ঘর বানানোর জন্য বাইরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল সেই সময়। মেয়ের ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মায়ের বন্ধুর সহযোগিতায় একটি বারো খোপ বিশিষ্ট ছোট্ট কবুতরের ঘর বানিয়ে নিয়ে আসা হয় তাদের ছাদে। মায়ের বন্ধুর পাঠানো আটটি কবুতর দিয়েই যাত্রা। দুইমাস সেই কবুতরগুলোকে নেটের ভেতর বন্দী রেখে ছাদের পরিবেশের সাথে খাপ-খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতেও বাঁধ সাধলো রূপকথা। ওর ছটফট এবং অস্থিরতা দেখে মা একদিন জানতে চাইলেন, কবুতর চেয়েছো শান্তি ফেরাতে। এখন তো দেখি তুমিই অশান্ত।

উত্তরে রূপকথা বলেছিলো, করোনার কারণে আমার মতো কতো শিক্ষার্থী ঘরে বন্দী। কবুতরগুলোর অবস্থাও তো আমাদের মতো বন্দী মা! ওদের ছেড়ে দাও। এই বন্দী জীবন ভালো লাগছে না। ওরা অন্তত স্বাধীনভাবে আকাশে উড়ুক। মেয়ের কথা শুনে তার মা বলেছিলেন, কবুতরগুলো তো এখনো আমাদের পোষ মানেনি। ছেড়ে দিলে ফিরে নাও আসতে পারে। উত্তরে রূপকথা বলে, ফিরে না আসলেও আমি কষ্ট পাবো না। আমার মতো বন্দী জীবন কবতুরগুলোর না হোক। মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মা শুধু অবাকই হননি, এই স্বাধীন চিন্তার ধারক ১১ বছরের মেয়ে রূপকথার ভাবনার গভীরতা অনুধাবন করে বিস্মিতও হয়েছিলেন। এও বুঝতে পেরেছিলেন মা, বন্দী জীবনে কতোটা হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়ে রূপকথা।

২০২০ সালের ১২ নভেম্বর। সেদিন রূপকথার মায়ের জন্মদিন। সকালে মাকে নিয়ে ছাদে যায় রূপকথা। আর ছাদে গিয়েই কবুতরের ঘরের নেটটি খুলে দেয়। হেসে বললো, মা, তোমার জন্মদিনে কবুতরগুলোকে স্বাধীন করে দিলাম। তুমি নিশ্চয় খুশি হয়েছো? রূপকথার এই স্বাধীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখে আনন্দে আত্মহারা হন তার মা। তাদের দুজনের আনন্দে যুক্ত হয়, তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী সহকারী শিউলি। সেদিন উড়িয়ে দেওয়া আটটি কবুতরের একটি ফেরত আসেনি। তাতে রূপকথার কোনো আক্ষেপ হয়নি। 

শুধু বার বার ছাদে গিয়ে খুঁজেছিল চলে যাওয়া কবুতরটি ফিরে এসেছে কি না। মা বুঝতে পারছিল রূপকথার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সেই কষ্ট ছোট্ট রূপকথা সেদিন খুব কৌশলে লুকিয়েছিল, যা মায়ের চোখ এড়ায়নি। এরপর ডিসেম্বরের শীতে আরও একটি কবুতর মারা গেলো। কবুতর তখন সংখ্যায় ছয়টি। অথচ আজ ২০২১ সালের মে মাসে সেই ছয়টি কবুতর সংখ্যায় বেড়ে হয়েছে ২৫টি। রূপকথাও পা দিয়েছে ১১ থেকে ১২তে।

করোনাভাইরাসের কারণে যখন থমকে গেছে পুরো বিশ্ব, তখন ছোট্ট রূপকথাও বাইরের জগতের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিল ছাদ বাগান। উদ্দেশ্য অক্সিজেন তৈরি করা। একইসঙ্গে কবুতর যে নিজের বাড়ি এবং নিজের দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার যে চিন্তা শিশু রূপকথা বিগত দেড় বছর ঘরে বন্দী থেকেও ভেবেছে এবং বাস্তবায়িত করেছে, এটি সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। মায়ের সার্বিক সহযোগিতায় রূপকথা এই করোনাকালীন মহামারির মাঝে থেকেও মনের সব ভয় দূর করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছে- এই গল্প থেকে অন্য শিশুদেরও কিছু ভাবনার পরিবর্তন আসবে বলেই বিশ্বাস রূপকথার মায়ের। রূপকথার গল্পের মতো অন্য শিশুরাও বিকল্প এবং সৃষ্টিকাজে উদ্বুদ্ধ হোক এটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ করেছেন রূপকথার মা। তিনি বলেন, পরিবারের সব শিশুর মনের যত্ন নিন। যার যার সাধ্য মতো করোনার এই দুর্যোগকালীন সময়ে পরিবারের ছোট্ট শিশুদের মনের জোর বাড়াতে রূপকথার মতো স্বপ্ন বুননে সহযোগিতা করুন। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কাজের বিকল্প নেই। তাদের সৃষ্টিশীল কাজের সাথে জড়িয়ে নিন।

ছোট্ট রূপকথার ছোট ছোট স্বপ্ন আরও ছড়িয়ে পড়ুক দেশ থেকে দেশান্তরে। রূপকথার মতো সব শিশু করোনার এই দুর্যোগে জীবনের বিকল্প সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলো নিয়ে এগিয়ে যাক, এই প্রত্যাশা আর শুভকামনা থাকলো আমাদের।

ঢাকা/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়