ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নরসিংদীর আনারসের খ্যাতি দেশজুড়ে

এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২১, ৫ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৩:২৮, ৫ জুলাই ২০২১
নরসিংদীর আনারসের খ্যাতি দেশজুড়ে

নরসিংদীর আনারসের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে সারাদেশে এখানকার আনারসের একটি আলাদা পরিচিতি রয়েছে। একটি প্রবাদও আছে, ‘রাবানের আনারস রসে টস টস’। রাবান হলো, জেলার পলাশ উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ কৃষকের ফসলই হলো আনারস চাষ। 

এছাড়ও আনারস উৎপাদনের দিক থেকে এ উপজেলা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধতম একটি স্থান। এ উপজেলার ঘোড়াশাল ও জিনারদী ইউনিয়নের প্রায় তিন চতুর্থাংশ জমি আনারস চাষের উপযোগী। তাই এ এলাকার কৃষকদের প্রধান অর্থকরী ফসলই হচ্ছে আনারস।

কৃষকরা জানান, সাধারণত পাহাড়ি লাল এটেল মাটিতে আনারস চাষের উপযোগী। দেশের অনেক জায়গায় আনারসের চাষ হলেও রাবানের আনারসের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। সেই সুবাদে রাবানের সুস্বাদু আনারসের চাহিদা ও দাম দুটিই রয়েছে আলাদা।

নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাব উপজেলায় কমবেশি আনারস উৎপন্ন হলেও জেলার উৎপাদিত আনারসের ৯০ ভাগই উৎপন্ন হয় পলাশ উপজেলায়।

পলাশ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর এ উপজেলায় শুধু রাবানেরই ১৪৫ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ করা হয়েছে। এতে প্রতি হেক্টরে ১১ টন হারে আনারসের ফলন হয়েছে ১ হাজার ৫৯৫ মেট্রিক টন। এখানকার আনারস সুস্বাদু হওয়ায় দেশজুড়ে রয়েছে এর খ্যাতি।

স্থানীয় আনারস চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় বহু বছর আগে থেকেই ঘোড়াশালে দেশীয় জাতের আনারসের চাষ হতো। এখানকার চাষকৃত দেশীয় প্রজাতির আনারস তেমন মিষ্টি ও সুস্বাদু ছিল না। পরে দেশীয় প্রজাতির আনারস চাষাবাদের ধীরে ধীরে গুণগতমান ও গঠনগত আকৃতি লোপ পায়।

ঘোড়াশালের জনৈক ব্যক্তি সিলেটে বেড়াতে গেলে সেখান থেকে কয়েটি আনারসের চারা এনে রোপণ করেন। পরে আস্তে আস্তে এ থেকে ঘোড়াশালের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। পরবর্তী সময়ে ঘোড়াশালে দেশীয় প্রজাতির আনারসের জাতটির বিলুপ্ত ঘটে।

সিলেটের আনারসের এই জাতটি ঘোড়াশালের আবহাওয়া ও মাটির সাথে খাপ খেলে এবং আনারস চাষে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় গঠনগত স্বাদের দিক দিয়ে আনারসটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে এখাকার আনারস রসালো ও সুস্বাদু হয়ে ওঠে।

ঘোড়াশালে চাষকৃত সিলেটের এ প্রজাতির আনারসটি জলডুগি আনারস নামে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল হানিকুইন।

এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এই এলাকায় ৫০০ একর জমিতে আনারসের চাষ হয়। প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৮ হাজার আনারসের চারা রোপণ করা হয়। আনারস চাষের এলাকাগুলো হচ্ছে, ঘোড়াশাল, জিনারদী ইউনিয়নের রাবান, বরাব, সাতটেকিয়া, বিলপাড়, ভালুকাপাড়া, ছয়দড়িয়া, বাঘাব, কুড়াইতলীসহ আরও কয়েকটি গ্রামে। তবে অধিকাংশ বাগানে এখন আনারসের চাষ হয় সনাতন পদ্ধতিতে।

আনারস চাষি অনিল জানান, এ বছর তিনি ১০ বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেন। প্রায় ৩২ বছর যাবৎ আনারসের চাষ করে আসছে। প্রতি বিঘা জমিতে আনারস চাষে ২০ হাজার টাকা খরচ হলে আনারসের ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘার আনারস বিক্রি হয় প্রায় ৭০/৮০ হাজার টাকা। এতে দেখা যায়, লাভ হয় দুই থেকে তিন গুণ। গত বছরের তুলনায় এ বছর আনারস বাগানে ফলন তেমন ভালো হয়নি। তবে বাজারে রাবানের আনারসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় তেমন কোনো ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি।

পলাশ উপজেলার কুড়াইতলী গ্রামের আনারস চাষি সুনীল দাস বলেন, আনারস চাষে নিয়মিতভাবে তেমন শ্রম দিতে হয় না। চারা রোপণে পুঁজি বিনিয়োগের তুলনায় লাভ বেশি পাওয়া যায়। প্রতি পিস আনারস ১০ থেকে ১৫ টাকায় জমি থেকেই কিনে নিয়ে যায় পাইকারি ক্রেতারা।

কাটাবেড় গ্রামের চাষি প্রদীব দাস বলেন, কাঁঠাল বাগান, আম বাগান, লটকন বাগান ও লিচু বাগানের মধ্যেও আনারসের চাষ করা যায়। ফলন শুরু হলে আনারস ও চারা বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। তবে এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় আনারসের ফলনটা একটু কম হয়েছে। তবে বাজারে দাম ভালো রয়েছে।

তবে কৃষকরা আরও বলছেন, আধুনিক যুগে এখনো সনাতন পদ্ধতির মাধ্যমেই আনারসের চাষ হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আনারস চাষ করতে পারলে আরও অধিক ফলন হতো এবং দেশও অর্থনৈতিকভাবে একটু লাভবান হতো।

এদিকে আনারস চাষিদের দাবি, আনারস একটি পচনশীল ফল হিসেবে এর সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা দরকার। সংরক্ষণ করতে পারলে আরও লাভবান হতো। কিন্তু এজন্য একটি হিমাগারের প্রয়োজন। সংশ্রিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন কৃষকদের আনারস সংরক্ষণর জন্য একটি হিমাগার স্থাপন করেন।

পলাশ উপজেলার জিনাদী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শিখা রায় বলেন, রাবানের মাটি তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় সেখানে জন্মানো ফলমূল অন্যান্য এলাকা থেকে একটু বেশি সুস্বাদু হয়ে থাকে। আমারা আনারস চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছি। আনারসের ফলন যাতে বৃদ্ধি পায়, সেজন্য কৃষকদের সময়মতো সুষম সার, খরায় পানির সেচ ও বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য মাটির পাশাপাশি বিশেষ যত্নের কারণেও এই গ্রামের আনারস বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, আনারসের চাষ বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলার মনোহরদী, বেলাব ও পলাশ উপজেলায় আনারসের চাষ হয়। তবে রাবানের আনারস রসালো ও সুস্বাদু হওয়ায় সারাদেশে এর আলাদা খ্যাতি রয়েছে। করোনার কারণে চাষিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে।

নরসিংদী/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়